যুদ্ধক্ষেত্রে মানবতা রক্ষায় জেনেভা কনভেনশন

দিদিয়ের বুরখালতের
দিদিয়ের বুরখালতের

আজ থেকে ১৫০ বছর আগে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ও অসুস্থ সেনাদের শুশ্রূষার জন্য প্রথম জেনেভা কনভেনশন গৃহীত হয়। এর মূলের ধারণাটি এ রকম যে যুদ্ধক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত মানবিকতার বোধ সমুন্নত রাখা উচিত। সুইজারল্যান্ড ও ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রস (আইসিআরসি) সে সময় বিশ্বপরিসরে এই রীতিটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারা এখন এই রীতিটি যথাযথভাবে পালনের জন্য উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। তবে দুনিয়ায় এমন কোনো কার্যসাধনপদ্ধতি নেই, যার মাধ্যমে এই রীতি পালন নিশ্চিত করা যায়।
বর্তমান জামানার যুদ্ধ আর ১৯ শতকের যুদ্ধের মধ্যে যোজন যোজন তফাত। যুদ্ধ এখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জনবহুল এলাকায় স্থানান্তর হয়েছে। বিবদমান রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধ এ ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম। বিবাদের প্রকৃতিও এখন আর আন্তর্জাতিক নয়। আজকের দিনে বেসামরিক লোকেরাই সশস্ত্র যুদ্ধের মূল ভুক্তভোগী হচ্ছে।
এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় মর্মাহত হয়ে ১৯৪৯ সালের চারটি জেনেভা কনভেনশনে দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলো এ মর্মে ঐকমত্য পোষণ করে যে যারা কোনোভাবে বৈরিতায় সম্পৃক্ত নয়, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে—আহত ও অসুস্থ সেনা, যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক মানুষ। ১৯৭৭ ও ২০০৫ সালের আরও তিনটি প্রটোকলের মাধ্যমে এই রীতিটিতে সম্পূরণ ঘটানো হয়। কিছু যুদ্ধোপকরণ যেমন জৈবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র, গুচ্ছ অস্ত্র ও মানববিধ্বংসী মাইন ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে।
এই রীতিতে এ-ও বলা হয়েছে যে সবচেয়ে অরক্ষিত মানুষের যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে হবে। এর বাস্তবায়নে কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। যেমন সেনাদের প্রশিক্ষণ ও সবচেয়ে জঘন্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়াতে তা দেখা গেছে। এর কৃতিত্ব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের (আইসিসি)।
তার পরও দুনিয়ার নানা জায়গা থেকে প্রতিদিনই আমরা সশস্ত্র যুদ্ধে মানুষের অসহনীয় যন্ত্রণাভোগের খবর পাচ্ছি। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘনের কারণে এমনটা হচ্ছে। আর পেছনে রয়েছে আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। ১৯৪৯ সালের চারটি জেনেভা কনভেনশনে আর্টিকেল ১ অনুসারে, প্রতিটি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের যেকোনো পরিস্থিতিতে এসব বিধান মেনে চলার কথা। তবে শুরু থেকেই এসব পালন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পন্থা বের করা সম্ভব নয়। এই অক্ষমতার পরিণাম হচ্ছে, যুদ্ধে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যু ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ।

পিটার মরার
পিটার মরার

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন সারা দুনিয়াতেই প্রযোজ্য। তার পরও এটার পালন নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন, কারণ এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে মানুষ এগুলো এমনি এমনি মেনে চলবে। যে অধিকার সব সময়ই লঙ্ঘিত হয়, সেটার কোনো আবেদন মানুষের মনে আর থাকে না। বিশেষ করে, এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করা না হলে তো কথাই নেই। সশস্ত্র যুদ্ধের ভুক্তভোগীদের দুর্দশা আমাদের চিন্তারও বাইরে।
সে কারণে আন্তর্জাতিক আইনের যথাযথ মান্যতার ব্যাপারে সুইজারল্যান্ড ও আইসিআরসি ২০১২ সাল থেকে আলোচনা করে আসছে। রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্টের ৩১তম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাদের এ ব্যাপারে অগ্রসর হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারা নিশ্চিত যে মান্যতা নিশ্চিত করার উপায় খুঁজতে হলে একটি ফোরাম প্রয়োজন, যেখানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বসে আলোচনা করবেন। রাষ্ট্রগুলো কীভাবে তাদের দায়দায়িত্ব পালন করবে, তা নিয়ে সুসংবদ্ধ ও নিয়মিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এই ফোরাম থেকে নির্দেশনা দেওয়া হবে, রাষ্ট্রগুলো যে এসব পালন করছে, তার একটি রূপকল্প তৈরি করার। আর এটা করতে গিয়ে কোন কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, সেটারও বিবরণ থাকতে হবে। এর ভিত্তিতে তারা শেষমেশ আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারে, যেমন এই আইন মানার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জনে রাষ্ট্রগুলো একে অন্যকে সহায়তা করতে পারে। তারা একে অন্যকে হালনাগাদ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করতে পারে, এই জটিল কাজ সমাধা করতে মতবিনিময় করতে পারে।
এই ফোরামের আরেকটি কাজ হবে, যুদ্ধ যাতে আইন অনুসারে পরিচালিত হয়, সেটা নিশ্চিত করা, এর উল্টোটা নয়। এর জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চলমান ইস্যুগুলো নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হলে যেকোনো রাষ্ট্র যেন যথাযথভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে, ভবিষ্যতে এরূপ অপরাধ সংঘটন রোধ করতে পারে বা বেসামরিক মানুষকে যাতে আর ভুগতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে পারে। এরূপ লঙ্ঘনের কারণ খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত করাটাও প্রয়োজন। উপর্যুক্ত ম্যান্ডেট অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ড ও আইসিআরসি রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্টের ৩২তম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করবে। ২০১৫ সালের শেষের দিকে জেনেভায় এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সে সময় করণীয় ঠিক হবে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ১৫০ বছর আগে গৃহীত হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। এর বিধানগুলো আমাদের মানুষ হিসেবে প্রজাতিগত যেসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার সুরক্ষা দিচ্ছে, যেমন মানবতা। এ অধিকার কখনো হারানোর নয়। যুদ্ধের বর্বরতা রোধ করার লক্ষে্য এ আইন প্রণীত হয়েছে।
সব দেশের সব সংস্কৃতিতে এর ভিত নিহিত রয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের ওপর এখন সে ভার বর্তেছে, এসব অর্জন ধরে রাখা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে এসব পরিপালন নিশ্চিত করার। কার্যকর করতে হলে এর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা থাকতে হবে। মানবেতিহাসে আমরা কখনোই সমাধানের এত কাছে যেতে পারিনি, এ সুযোগ আমাদের নিজেদেরই গ্রহণ করতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
দিদিয়ের বুরখালতের: সুইস কনফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট।
পিটার মরার: ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রসের প্রেসিডেন্ট।