দূরপাল্লার দেশপ্রেম

লন্ডনে বাংলাদেশিদের উত্সব
লন্ডনে বাংলাদেশিদের উত্সব

ব্রিটেনে বছর ত্রিশেক আছেন, এমন একজন নারী এ দেশে তাঁর প্রথম দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করছিলেন। বলছিলেন, এ দেশে এসে প্রথম সুপার মার্কেটে গিয়ে চমৎকার একটা ডাইনিং টেবিলের কাভার কিনেছিলেন। বাড়ি ফিরলে তাঁর স্বামী বলেন, ‘তুমি গোল ডাইনিং টেবিল কাভার কিনেছ কেন, লন্ডনে আমাদের এই ডাইনিং টেবিলটা তো চারকোনা।’ ওই নারী বলছিলেন, ‘আমি কিন্তু ভুল করে কিনিনি। আমার মাথায় লন্ডনের কোনো ডাইনিং টেবিলই ছিল না তখন, ছিল ঢাকায় ফেলে আসা আমার গোল ডাইনিং টেবিল। আমি তো নিশ্চিত ছিলাম, কিছুদিন পরই আমি ঢাকায় ফিরছি এবং গোল ডাইনিং টেবিলেই সাজবে আমার সংসার।’
তারপর ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে, তাঁর আর লন্ডন ছাড়া হয়নি। ঘটনার পাকচক্রে আর দেশে ফেরেননি তিনি। কিন্তু লন্ডনে প্রথম দিনগুলোয় কেনা সেই গোল ডাইনিং কাভারটি তিনি সযত্নে রেখে দিয়েছেন তাঁর আলমারিতে। মাঝেমধ্যে বের করে দেখেন। সেই টেবিল কাভার এক অযাপিত জীবনের প্রতীক হয়ে আছে তাঁর কাছে। ব্রিটেনে আছি কিছুকাল, ঘুরি পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও, লক্ষ করি প্রবাসে প্রায় সব বাংলাদেশির তেমন একটা গোপন আলমারি আছে, যেখানে তাঁরা সঞ্চয় করে রাখেন যাঁর যাঁর নিজস্ব তেমন কোনো একটা গোল টেবিল কাভার। লক্ষ করি, তাঁদের পায়ের নিচে মাতৃভূমি নেই ঠিকই, কিন্তু সবাই বুকের ভেতর একটা ছোট মাতৃভূমি নিয়ে ঘুরে বেড়ান। অর্থনৈতিক, সামাজিক, নিরাপত্তাজনিত, এমনকি একান্ত ব্যক্তিগত কত বিচিত্র কারণে দেশ ত্যাগ করেন মানুষ। দেশ ত্যাগ করেন ঠিকই, কিন্তু প্রবাসে পুরোপুরি এসে পৌঁছান না। তাঁদের শরীর এসে পৌঁছায় নতুন দেশে, কিন্তু মনের ভেতর থাকে এক টুকরা বাংলাদেশ। অভিবাসীদের যাওয়া আছে, পৌঁছানো নেই।
অক্সফোর্ডে দেখা করতে গেলাম এক অগ্রজের সঙ্গে, এ দেশে আছেন বছর চল্লিশ। স্টেশন থেকে তাঁর গাড়িতে করে যখন আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর গাড়ির সিডিতে বাজছে ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়, তারই মাঝে প্রেম শুধু গড়ে খেলাঘর’। প্রথম যৌবনের মান্না দেকে ছাড়েননি অক্সফোর্ডের হিম তুষারেও। নিউক্যাসেলে কথা হয় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে, যিনি গত ১০ বছরে দেশে যাননি, কিন্তু এই ১০টা বছরের বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিটি ঘটনার এনসাইক্লোপেডিক তথ্য আছে তাঁর কাছে, ক্রিকেট মৌসুমে ডারহাম হাসপাতালের বাংলাদেশি ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে ওটির পোশাক খুলেই প্রথমে মোবাইল ইন্টারনেটে গিয়ে খোঁজ নেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্কোর কত, ম্যানচেস্টারের এক পরিচিত যেদিন যুদ্ধাপরাধের রায় ঘোষণা হয়, তার আগের রাতে ঘুমান না, পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে ক্ষণে ক্ষণে পরখ করেন রায় পাঠ শুরু হয়েছে কি না। লিডসে একজনকে জানি, কারি রেস্টুরেন্টের কাজ সেরে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে বাংলাদেশি টিভির চ্যানেলে চোখ রেখে রাতের পর রাত দেখেছেন সাভারের ভবনধসের ছবি। ব্রিটেনজুড়ে বহু যুগ ধরে আছেন সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীরা। তাঁদের ভেতর বৃহত্তর সিলেটের জেলা, উপজেলা শুধু নয়, আছে গ্রামভিত্তিক অগণিত সমিতিও। পয়লা বৈশাখে ব্রিটেনজুড়ে প্রায়ই থাকে শৈত্যপ্রবাহ, তবু ওভারকোটের নিচে পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে প্রবাসীরা মিলিত হন কারও বাড়িতে ইলিশ ভাজার আসরে। খাওয়া শেষে তুমুল আড্ডা চলে, কথা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বা ফুটবল তারকা ডেভিড বেকহাম ঘুরে খুব অল্প সময়ে পৌঁছে যায় আওয়ামী, বিএনপির উত্তেজনাকর বিতর্কে। শীতে আগুন পোহানোর মতো বাংলাদেশ বিষয়ে দুশ্চিন্তায় তাঁরা উষ্ণ হয়ে থাকেন শীতল ব্রিটেনের নানা শহরের লিভিং রুমে। দেশ নিয়ে বিস্তর ক্ষোভে ফেটে পড়েন তাঁরা। সেই ক্ষোভের ভেতর যতটা না অভিযোগ, তার চেয়ে বেশি থাকে অভিমান।
প্রবাস এক মিশ্র অভিজ্ঞতার জাদুর বাক্স। প্রবাসজীবনের এই বাক্সে যেমন আছে প্রচুর অর্জনের আনন্দ, তেমনি আছে বিস্তর হারানোর বেদনাও। অর্জন আর হারানোর এই দাঁড়িপাল্লা নাগরদোলার মতো দোলায় প্রবাসীদের। কখনো মনে হয় অর্জনের পাল্লা বুঝি ভারী, কখনো হারানোর। এই দোলাচলে কেটে যায় দিন। অনেকেই দেশে গিয়ে মনের ভেতরের এই চড়াই-উতরাইয়ের কথা জানান না কাউকে, যাঁরা বিদেশে আসেননি তাঁদের মনে বিদেশ নিয়ে যে রূপকথার গল্পের মায়া আছে, সে মায়া ভাঙাতে চান না তাঁরা। অনেকে দেশের বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদির কথা বিবেচনা করে নিজের প্রবাসজীবনকে পরম সৌভাগ্য হিসেবেই দেখেন। কেউ আবার দেশ থেকে ফিরে এসে উচাটন হয়ে ওঠেন। তর্ক জুড়ে দেন হোক নিজের দেশ দরিদ্র, বিশৃঙ্খল, তবু ওখানেই মনের যা কিছু স্বস্তি। মনে মনে হিসাব কষেন, একদিন ফিরে যাবেন দেশে। তার মন তখন অনেকটা ছোটবেলায় শোনা সেই ছড়াটির মতো, যেখানে এক মেয়ে তার ভাঙা পুতুলটি হাতে নিয়ে বলছে ‘ভেঙে গেছে হাত পা গুলো চুলগুলো নেই কালো/ তবু সেটা আমার কাছে সবার চেয়ে ভালো’।
প্রবাসীদের মনের ভেতরের এই গোপন দেশপ্রেমকে খুব পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়েছে চীন আর মালয়েশিয়া। সেসব দেশের নেতারা জানতেন, বুকের ভেতর এভাবে মাতৃভূমিকে নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে আছে তাঁর দেশের মানুষ। দেশের মানুষের প্রতিদিনকার যে সংগ্রাম আছে, সেখান থেকে দূরে থাকার কারণে প্রবাসী অনেকের মনে গোপনে একটি অপরাধবোধও থাকে। দেশকে কেন্দ্র করে প্রবাসীদের এই আবেগকে সঠিক পথে চালিয়ে যদি দেশের স্বার্থে কিছু করার সুযোগ করে দেওয়া যায়, তাহলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধ্যমতো তারা তা করবেন, সে খবর চীন আর মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক নেতারা জানতেন। সেসব দেশের নেতারা তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা উদ্যোগ, প্রণোদনা, পথ তৈরি করেছিলেন, যাতে প্রবাসীরা দেশের উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন। আজকের চীন আর মালয়েশিয়ার অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা আছে প্রবাসীদের। মালয়েশিয়ার নেতা মাহাথির মোহাম্মদ এ ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সূত্রে আমার নানা দেশের ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। একবার এক মালয়েশিয়ান ছাত্র আমাকে জানিয়েছিল তার বাবা ছিলেন আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিষয়ে নামজাদা গবেষক। একদিন গভীর রাতে তার বাবা একটি ফোন পান। ঘুম থেকে উঠে ফোন ধরলে জানতে পারেন ওপারে যিনি ফোন ধরে আছেন তিনি মালয়েশিয়ার সদ্য ক্ষমতা নেওয়া প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। মাহাথিরের সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না তার বাবার। আমার সেই ছাত্রের বাবাকে মাহাথির মাঝ রাতে ঘুম থেকে তুলে নতুন মালয়েশিয়া গড়ার নানা স্বপ্নের কথা বলেছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন পুরোপুরি নয় অন্তত বছর খানেকের জন্য তিনি যেন মালয়েশিয়াতে এসে তাদের কৃষি গবেষণার প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে দিয়ে যান। আবেগাক্রান্ত মাহাথির, মালয়েশিয়ার আর আমেরিকার সময়ের পার্থক্যের কথাও ভুলে গিয়েছিলেন, ফলে তিনি যে একজনকে গভীর রাতে ঘুম থেকে তুলেছেন, সেটাও টের পাননি। ছাত্রের বাবা পরে জেনেছেন ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা কৃতী মালয়েশিয়ানদের তালিকা করেছিলেন মাহাথির এবং এক এক করে সবাইকে নিজে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করেছিলেন। ছাত্রের আপ্লুত বাবা ঘুম জড়ানো গলাতেই সেই মাঝরাতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি মালয়েশিয়াতে ফিরবেন।
আজ পৃথিবীর প্রায় সব কটি প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আমাদের প্রবাসীদের নানা অর্জন, উপার্জনকেও দেশের কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন আরও সুপরিকল্পিত পথ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কার্যক্রম। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন ঠিকই। কিন্তু প্রয়োজন সেই রেমিট্যান্সের উৎপাদনশীল ব্যবহার, পাশাপাশি প্রয়োজন পৃথিবীর নানা দেশে গবেষণা, শিক্ষা, ব্যবসায় প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছেন যে প্রবাসী বাংলাদেশিরা, তাঁদের মেধা এবং অর্থ দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। আমি নিশ্চিত, যেকোনোভাবে দেশের কাজে লাগানোর সুযোগ পেলে সর্বান্তকরণে সে সুযোগটি কাজে লাগাবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেখেছি যারা জীবনের একটি সিংহভাগ দেশে কাটিয়ে বিদেশে এসেছেন, সেই প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী বাংলাদেশিদের বুকে বরাবরই একটি দূরপাল্লার দেশপ্রেমের মোমবাতি জ্বলে। যে মোমের আগুনে একটু একটু করে পোড়ে তাঁদের হূৎপিণ্ড। রাতে বিছানায় শুয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশের শিশু মেয়েটি যখন টগবগে তুখোড় ইংরেজিতে তার মায়ের কাছে গল্প করে স্কুলে বন্ধু জুডিথ আর ক্লারা কী করেছে, তখন মা সেই গল্প শুনতে শুনতে গোপনে চোখ মুছে মেয়ের গালে চুমু খেয়ে বলে, ‘মা রে, তুই কি কোনো দিন একবার একটু শোনাবি না, “আতা গাছে তোতা পাখি ডালিম গাছে মৌ”?’
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
[email protected]