সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় কেন?

কর্নেল আবু তাহের
কর্নেল আবু তাহের

অনেক বছর আগে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপচারিতার ওপর ভিত্তি করে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের একটি লেখা কয়েক কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল। ওই লেখায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অধ্যাপক রাজ্জাক বলেছিলেন, আবুল বরকত পুলিশের ইনফরমার ছিলেন। লেখাটি ছাপা হওয়ার পর অধ্যাপক রাজ্জাক মনঃক্ষুণ্ন² হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারেননি ‘সরদার’ এটা ছেপে দেবেন। যেহেতু বরকত একজন ভাষাশহীদ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তাঁকে নিয়ে জনমনে অনেক আবেগ আছে, এ ধরনের তথ্য সেই আবেগকে মলিন করে দিতে পারে।
আমি ওপরের উদাহরণ দিলাম এ জন্য যে অধ্যাপক রাজ্জাক, অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম—তাঁদের কেউ মিথ্যা কথা বলেছেন বলে পাঠক মনে করেন না। প্রশ্ন হলো, যখন কেউ গবেষণা করবেন কিংবা ইতিহাস লিখবেন, তখন এ ধরনের উক্তি বা তথ্য ব্যবহার করা উচিত হবে কি না। এখানে প্রশ্ন উঠবে ভ্যালু জাজমেন্টের। এ নিয়ে প্রাণবন্ত অ্যাকাডেমিক আলোচনা হতে পারে।
গোপন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সব সময় সবকিছুর দালিলিক প্রমাণ থাকে না। সেটা সম্ভবও নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের নির্ভর করতে হয় একটা বিশেষ ঘটনার বা সময়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কুশীলবদের। তাঁদের কোন কথাটা গবেষণার কাজে উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে, তারও সর্বজনীন রীতিপদ্ধতি নেই। এখানে বিচার্য হতে পারে, যিনি একটি বিশেষ উক্তি করেছেন, তিনি কোন পরিপ্রেক্ষিতে করেছেন, কিংবা তিনি কেমন মেজাজের মানুষ, তাঁর চিন্তাধারা বা দর্শন কেমন। লেখক-গবেষককে এ ক্ষেত্রে একটা ঝুঁকি নিতে হয়। কেননা, ওই সময়ের কুশীলবদের সঙ্গে অনেকেরই আবেগের সম্পর্ক থাকতে পারে এবং তাঁরা আহত বোধ করতে পারেন। এ জন্য লেখার সময় অনেকেই অনেক তথ্য এড়িয়ে যান অথবা তথ্য গোপন করেন। ফলে নির্মোহ ইতিহাস লেখা হয়ে ওঠে না। এ ক্ষেত্রে আমি একটু ঝুঁকি নিয়েছি। এখন দেখতে পাচ্ছি, এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। মোদ্দা কথা হলো, কথ্য ইতিহাস (ওরাল হিস্ট্রি) কতটুকু গ্রহণযোগ্য এবং এই গ্রহণযোগ্যতা কে নির্ধারণ করবেন?
আমার লেখার বিষয় হচ্ছে ‘জাসদ’। এটা নিকট অতীতের বিষয় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এখনো জীবিত এবং রাজনীতিতে সক্রিয়। জাসদের রাজনীতি নিয়ে আমাদের অনেকেরই আছে প্রচণ্ড আবেগ। এই আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেকের প্রতি ভালোবাসা, অনেকের প্রতি ঘৃণা। এসবের ঊর্ধ্বে উঠে সব রকমের চশমা ফেলে দিয়ে সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে পারলেই আমরা ইতিহাস লেখার উপাদান সৃষ্টি করতে পারব৷ অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আমি শতভাগ একমত, আমি ছাত্রলীগ-জাসদ-গণবাহিনীর কোনো উঁচু পদে ছিলাম না। থাকার কথাও নয়। ওই সময় যাঁরা উঁচু পদে ছিলেন, সবকিছুর দায়দায়িত্ব তো তাঁদেরই নিতে হবে, সেটি ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক।
আমার পাণ্ডুলিপির অল্প একটি অংশ প্রথম আলো ছেপেছে এবং এটা আরও কয়েকটি পত্রিকায় উদ্ধৃত হয়েছে। ইতিমধ্যে আমি বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। কেউ কেউ আমাকে জানিয়েছেন, তথ্যগত কিছু ত্রুটি আছে। আমি এতে উপকৃত হয়েছি এবং আমার পাণ্ডুলিপি পরিমার্জন করেছি কিছু কিছু জায়গায়। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনও তাঁর প্রতিক্রিয়ায় অনেক প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ এ জন্য যে আমি আবারও তথ্য যাচাই-বাছাই করার সুযোগ পেলাম।
অধ্যাপক হোসেন অনেকগুলো বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। আমি দেখলাম, তথ্যসূত্র অনুযায়ী আমার উল্লেখ করা সব কথাই মোটামুটি অভ্রান্ত। শুধু একটি বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। আমি লিখেছিলাম, ‘সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক আহমদ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহের উপস্থিত ছিলেন।’ সামরিক আদালতে বিচারের সময় আবু তাহের যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, সেখানে অবশ্য তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘When I reached Banga Bhavan at mid-day, the swearing in ceremony was over. In the evening I sat down with the officers who were involved in the killing. They were headed by Major Rashid. I once again put forward to them the suggestings. I had made to Mushtaque that morning. ...During the latter part of our discussion, I called General Zia to join in... (আমি বঙ্গভবনে যখন পৌঁছালাম, তখন দুপুর। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় আমি হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসারদের সঙ্গে বসলাম। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর রশিদ। সকালে আমি মোশতাককে যে পরামর্শগুলো দিয়েছিলাম, সেগুলো আবার উল্লেখ করলাম। আলোচনার শেষ পর্যায়ে আমি জেনারেল জিয়াকে আলোচনায় যোগ দিতে ডাকলাম)।
তাহের মোশতাককে কী পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা আমার লেখায় উল্লেখ আছে।
আমি বলেছি, জাসদ কখনো সামরিক আইন জারি করার কথা বলেনি এবং এটা ছিল আবু তাহেরের নিজস্ব প্রস্তাব। এটা জাসদের দলীয় সিদ্ধান্ত ছিল কি না, তা জাসদের নেতারাই বলতে পারেন। আশা করি, তাঁরা এ বিষয়ে মুখ খুলবেন। যদি আমার

কথা ভুল হয়, আমি আমার পাণ্ডুলিপি সংশোধন করে নেব।
লরেন্স লিফশুলজের গ্রন্থ বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভল্যুশন (জেড প্রেস, লন্ডন, ১৯৭৯) থেকে আমি অনেক তথ্যের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছি। আবু তাহেরের জবানবন্দিটি এই গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। এই জবানবন্দির কোথাও বঙ্গবন্ধু কিংবা জাতির পিতা (ফাদার অব দ্য নেশন) শব্দাবলির উল্লেখ নেই।
আমি আবু তাহেরের জীবনী লিখতে বসিনি। আমার বিষয় ‘জাসদ’। তাহেরের প্রসঙ্গ এসেছে। কেননা, তিনি জাসদের সামরিক সংগঠন গণবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।
তবে এটাও সত্য যে দিন–রাত বঙ্গবন্ধু কিংবা জাতির পিতা জপ করলেই শেখ মুজিবের প্রতি সম্মান দেখানো হয় না। আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছি, গ্রামের সাধারণ মানুষ চার অক্ষরের ছোট্ট একটা শব্দে তাঁর প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করত। হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়ে আসা শব্দটি ছিল ‘মজিবর’। যাঁরা এখন ২৪ ঘণ্টা বঙ্গবন্ধু আর জাতির পিতা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, তাঁদের ভাবসাব দেখলে মনে হয় তাঁরাই আওয়ামী লীগ তৈরি করেছেন, আর শেখ হাসিনা পরে তাঁদের দলে যোগ দিয়েছেন।
তাহের সম্পর্কে যে উদ্ধৃতি নিয়ে এত হইচই হচ্ছে, তারও একটা ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আমরা এটাকে ‘লুজ টক’ বা কথার কথা বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও শেখ মুজিবের প্রতি তাহেরের প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। শেখ মুজিব যেখানে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের পর তাঁকে একটি চাকরি দিয়েছিলেন, তিনি সেই চাকরির সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গণবাহিনী বানিয়েছিলেন মুজিব সরকারকে উৎখাত করার জন্যই। এ ছাড়া গণবাহিনীর আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ভূমিকা সবার জানা, কীভাবে একটার পর একটা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছিল, কীভাবে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল। আমাদের সমস্ত লালিত আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও মূল্যবোধ একের পর এক ধ্বংস করা হয়েছিল। গণতন্ত্রকে কবর দেওয়া হয়েছিল অত্যন্ত নোংরাভাবে। জনগণকে পদদলিত করে জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র।’ এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছিল ১৫ আগস্ট সকালে। তাই তাহের খুনি মেজরদের ‘অনুরোধে’ সকালেই ছুটে গেছেন ঢাকা বেতারকেন্দ্রে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বৈধ রাষ্ট্রপতির রক্তাক্ত মৃতদেহ সাড়ে ৩৩ ঘণ্টা অনাদরে, অবহেলায় পড়ে ছিল। একজন পাকিস্তান-প্রত্যাগত সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে নিজের প্রাণটি বিসর্জন দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং পরে বেসামরিক কর্মকর্তা কর্নেল তাহের বীর উত্তম একজন অবৈধ রাষ্ট্রপতিকে সামরিক আইন জারি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কী নিদারুণ বৈপরীত্য!
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট অনেকে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাবে এবং আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে একটা সমীকরণ তৈরি হবে। রাজনীতিতে এ ধরনের সমীকরণ নতুন কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে জোর করে আবু তাহেরকে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ বানানোর তো প্রয়োজন নেই। এই কাজটি করে যাঁরা নানা ধরনের ইহজাগতিক সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন, তাঁদের লোভের আগুনে তাহেরের লাশ আবারও পুড়ছে।
অধ্যাপক হোসেন তাহের প্রসঙ্গে আদালতের সাম্প্রতিক রায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। আদালতের এই রায়ই শেষ কথা নয়। উচিত হবে একটি ‘কমিশন’ গঠন করা, যাতে করে ১৫ আগস্টের ঘটনার পূর্বাপর এবং এর নেপথ্যের কুশীলবদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়।
আমার লেখার ভগ্নাংশ ছাপা হয়েছে। পুরো বইতে তাহের কেন্দ্রীয় চরিত্র নন। পাঠক আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন, ভাবনাচিন্তার খোরাক পাবেন, যখন বইটি আলোর মুখ দেখবে। তখন সুযোগ তৈরি হবে ফিরে দেখার, অ্যাকাডেমিক আলোচনার। এর আগেই যদি আমরা সত্য লুকাতে চাই এবং নির্মম সত্যকথনের জন্য লেখককে ব্র্যান্ডিং করতে চাই, সেটা কোনো উদারতার পরিচায়ক হবে না। আমাদের উচিত হবে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বাদ দিয়ে সত্যের মুখোমুখি হওয়া। একদা খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমকে যাঁরা ‘ভারতের দালাল’ ও ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে ব্র্যান্ডিং করে জেনারেল জিয়াকে সামনে রেখে বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন, তার পরিণতিতে খালেদ নিহত হয়েছিলেন আরও দুজন বীর উত্তম হুদা, হায়দারসহ। ক্ষমতার লড়াইয়ের এই বিপজ্জনক খেলায় তাহের নিজেও শিকার হয়েছিলেন। আমরা কি এখান থেকেও কোনো শিক্ষা নেব না?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
[email protected]