অনির্বাচিত প্রশাসন ও ঢাকা শহরের অব্যবস্থাপনা

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

প্রায় ৩৩ বছর আগে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণ নেওয়ার। যুক্তরাষ্ট্র বলে কথা! বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা সেই সামরিক স্টাফ কলেজে আসতেন পুরোপুরি সামরিক নয় এমন নানা বিষয় নিয়ে লেকচার দিতে। একবার সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা করতে এসেছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক। তাঁর নাম এখন মনে নেই, তবে তাঁর লেকচারের দু-একটি কথা মনে আছে এবং প্রায়ই মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, একটি দেশ কীভাবে চলছে এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শৃঙ্খলা কেমন, তা জানতে হলে সে দেশে মাসের পর মাস থাকার প্রয়োজন হয় না। তাঁর মতে, বিমানবন্দর যদি সিস্টেমেটিক হয়, সেখানে যাত্রীদের নানা অব্যবস্থাপনার কারণে হয়রানির সম্মুখীন না হতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে ওই দেশে একটি দক্ষ সরকার আছে এবং ওই সরকার মোটামুটিভাবে ভালো প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিতে পেরেছে। শুধু একটি সরকার নয়, দেশটি ধারাবাহিকভাবে ভালো শাসনব্যবস্থায় রয়েছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেছিলেন তা হলো, ওই দেশের সমাজে ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ও আইনের প্রতি জনসাধারণ থেকে শুরু করে ক্ষমতাবান পর্যন্ত সবাই শ্রদ্ধাশীল। তাঁর মতে, এর উদাহরণ পেতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। বিমানবন্দর থেকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো পর্যন্ত সড়ক ব্যবস্থাপনা এবং ওই শহরের ট্রাফিক শৃঙ্খলাই বলে দেবে দেশটিতে আইনের শাসন ও সমাজের শৃঙ্খলাবোধ কেমন। তখন তাঁর এ কথার তাৎপর্য নিয়ে মাথা ঘামাইনি, তবে এখন বুঝতে পারি তাঁর ওই বক্তব্যের তাৎপর্য।
আমাদের দেশের রাজধানীর একমাত্র বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা আর তার অবস্থা যাঁরা দেখেছেন বা অহরহ দেখছেন, তাঁরা ওই অধ্যাপকের মন্তব্য যৎসামান্য বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারবেন আমাদের দেশের ব্যবস্থাপনার হালহকিকত। দুই ঘণ্টার যাত্রা শেষ করে বিমানবন্দরে নামার পর মালপত্র পেতে লেগে যায় সফরের সময়ের প্রায় অর্ধেক। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার হয়ে কনভেয়ার বেল্টে আসতে যতটুকু সময় লাগে তার মধ্যেই ব্যাগেজ চলে আসে। ওসব দেশের বিমানবন্দর দেখে স্বভাবতই মনে হবে যে দেশের ব্যবস্থাপনায় তেমন বড় ধরনের বিচ্যুতি নেই। আপনি নির্বিঘ্নে বের হয়ে আসতে পারবেন। আর কোনো কারণে বাধাপ্রাপ্ত হলে তা হবে ওই দেশের আইনের আওতায়।
আমাদের দেশের প্রধান বিমানবন্দরের অভ্যন্তরেই নয়, এর বাইরের কথা একবার চিন্তা করুন। সাধারণ যাত্রী হিসেবে আপনি কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করে বের হলেন তো পড়লেন বৃহত্তর সমস্যায়। কোনো শৃঙ্খলাই নেই। হইচই-হট্টগোল আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে সাধারণ যাত্রীরা যাঁরা আসেন, তাঁদের নিয়ে তো রীতিমতো টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যায়। বেচারা যাত্রীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। এই ব্যবস্থাপনা শুধু বিমানবন্দরের? একবার ভেবে দেখুন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনা কীভাবে চলে আসছে বছরের পর বছর, সব সরকারের সময়। দিনে দিনে যেখানে অগ্রসর হওয়ার কথা সেখানে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি বলে অন্তত আমার কাছে মনে হয়। একবার বিআরটিএর অব্যবস্থাপনা ভেবে দেখুন! এক বছর পেরিয়ে গেলেও গাড়ির ডিজিটাল ব্লু বুক এখনো পাইনি।
বিমানবন্দর কোনোভাবে পার হওয়ার পর রাস্তায় উঠলেই রাজধানী ঢাকার চরম অব্যবস্থা চোখে পড়বে। ডাস্টবিন নেই। রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তূপ, তার ওপরে দুর্গন্ধ, মশা-মাছির জন্মস্থানে রূপান্তরিত হয়ে আছে। শহরের দু-একটি রাস্তা ছাড়া অক্ষত অবস্থায় কোনো রাস্তাঘাট নেই। এমনকি অভিজাত এলাকার রাস্তার অবস্থাও একই রকম। বারিধারার দূতাবাস এলাকার রাস্তাগুলোর করুণ অবস্থা। শহরের প্রশাসনে কোনো দায়িত্ববান নির্বাচিত ব্যক্তি নেই আজ প্রায় তিন বছর। অথচ সংসদের ভেতরে তথাকথিত বিরোধী দল এ ব্যাপারে কোনো কথা তো বলেই না। যাঁরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করছেন, তাঁদের তরফ থেকে প্রায় দুই কোটি মানুষের এই শহরের প্রশাসনে নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের দাবি তোলা হয় না। এখানে সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কথা নস্যি। এখানে রাজনৈতিক সুবিধাটাই মুখ্য।
বিশ্বের যে ১০টি শহর বসবাসের অযোগ্য শহর বলে চিহ্নিত হয়েছে, আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকা রয়েছে সেই তালিকায় একদম নিচের দিকে—৯ নম্বরে। তার নিচে রয়েছে রবার্ট মুগাবের দেশ জিম্বাবুয়ের রাজধানী, হারারে। এর আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে? চরম অব্যবস্থাপনায় চলছে রাজধানী শহর। বিশেষত, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় এমন চরম হতাশাজনক চিত্র বিশ্বের অন্য কোনো শহরে আমার চোখে পড়েনি। আমাদের এই মহানগরের বেশির ভাগ সড়কই বেশ প্রশস্ত। তার পরও শুধু অব্যবস্থাপনার জন্য যানজট লেগেই আছে। কিছু কিছু রাস্তার দুই ধারে অফিস আর নিত্যনতুন বহুতলবিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর কোনো নির্দিষ্ট ও পর্যাপ্ত পার্কিং-ব্যবস্থা নেই। রাস্তার দুই পাশ গাড়ির পার্কিং হিসেবে দখল। এমনকি বিভিন্ন বাণিজ্যিক অফিস, ব্যাংক ফুটপাতকেও নিজের সম্পত্তির ঘোষণা দিয়ে ‘প্রাইভেট’ সাইন লাগিয়ে রেখেছে। মতিঝিল এলাকা বাদই দিলাম। বনানী-গুলশান এলাকার রাস্তার অর্ধেক দখল, অবৈধ পার্কিং এবং বাদবাকি অর্ধেক দিয়ে শৃঙ্খলাহীন চরম অব্যবস্থায় গাড়ির চলাচল। ডান দিকে মোড় নিতে হলে পুরো রাস্তা ব্লক করে একাধিক লেনে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। বনানী ১১ নম্বরের রাস্তার দুই পাশে বহুতল বাণিজ্যিক দালানের অনুমতি দিয়েছে রাজউক। অথচ রাস্তার প্রশস্ততা তেমন নয়। এত গাড়ি কোথায় থাকবে, তার কোনো জায়গা নেই। অপর্যাপ্ত পার্কিং দেখিয়ে নকশার অনুমোদন নেওয়া।
ওপরে সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম সামান্য একটি জায়গার কথা। এটাই সমগ্র

রাজধানীর চিত্র। এর ওপরে অসহনীয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। বাসে যাত্রী ওঠানামার জন্য নির্দিষ্ট স্থান থাকলেও সেগুলো হকারদের দখলে। একাধিক বাস পাল্লা দিয়ে যাত্রী ওঠানামা করায় রাস্তার মোড়ে অথবা সবচেয়ে ব্যস্ত রাস্তার সংযোগস্থলে বেপরোয়া চালক। ট্রাফিক পুলিশকে যেমন মানে না, তেমনি ট্রাফিক সার্জেন্ট অথবা পুলিশের মাথাব্যথা থাকে না। থাকবেই বা কেন? হয় তারা প্রভাবশালীদের কারণে আইন প্রয়োগ করতে পারে না অথবা ঘুষ-বাণিজ্যের রমরমার কারণে আইন প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে। লেগে যায় যানজট। অথচ এই যানজট লাগার কথা নয়। ইদানীং বৈদ্যুতিক সিগন্যালের সঙ্গে কোটি কোটি টাকা খরচ করে অতিরিক্তভাবে লাগানো হয়েছে টাইমার, যেমনটা ইউরোপীয় শহরে দেখে এলাম। অযথা খরচে হয়তো কারও পকেট ভর্তি হয়েছে। এর ব্যবহার কী তা অনেকেই জানেও না। যেখানে সিগন্যাল বাতি চালু থাকা সত্ত্বেও ব্যবহার হয় না, সেখানে টাইমার লাগানো ফালতু খরচ নয়তো কী বলা যায়। আধুনিকায়ন তখনই হবে যখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতার প্রয়োগ ও চর্চা থাকবে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য শত শত কোটি টাকার বৈদ্যুতিক সিগন্যাল থাকলেও কোথাও কোথাও ডজন খানেক পুলিশ নিয়োজিত থাকে ট্রাফিক সামলাতে। সিগন্যাল বাতি দেখে চলার অভ্যাস করানো হয়নি চালকদের। আমার মনে হয় না সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কোনো মাথাব্যথা রয়েছে। চরম অব্যবস্থাপনায় রাজধানী, অবশিষ্ট দেশের চিত্র তো বোঝাই যায়।
কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফুটওভারব্রিজ বানানো হয়েছে। অথচ সেগুলো ব্যবহারে পথচারীদের অভ্যাস করানো হচ্ছে না। হালে ফুটওভারব্রিজ অত্যাধুনিক করা হয়েছে, যা আমার দেখা দেশগুলোর কোনো রাজধানী শহরে চোখে পড়েনি। এয়ারপোর্ট রোডের চেয়ারম্যানবাড়ি বলে কথিত জায়গায় চলন্ত সিঁড়ি বা ‘এসকেলেটর’ বসানো হয়েছে ওভারব্রিজে চড়ার জন্য। দু-চারজন মানুষ ছাড়া আমার চোখে পড়েনি এর ব্যাপক ব্যবহার। ঠিক তার দুই পাশ দিয়েই মানুষ হেঁটে বেপরোয়া রাস্তা পার হচ্ছে, যার কারণে লেগে যায় ট্রাফিক জ্যাম। জেব্রা ক্রসিংয়ে কখন পার হতে হবে তা নিয়েও সচেতনতা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ দেখিনি। প্রশ্ন থাকে যে এ ধরনের ফুটওভারব্রিজ, চলন্ত সিঁড়িসহ যা লন্ডনসহ অন্যান্য শহরে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন ছাড়া ওভারব্রিজের বেলায় চোখে পড়েনি, তা লাগিয়ে আমরা কী পেলাম যদি তা ব্যবহারের তাগিদই পথচারী বোধ না করে।
এক কথায়, ঢাকার রাস্তায় গাড়ির ঘনত্বের জন্য নয়, তার চেয়ে বেশি যানজট লাগে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে। বিশ্বের বহু শহরে গাড়ির ঘনত্ব বিশেষ সময়ে বৃদ্ধি পায় কিন্তু ঢাকায় সড়কের যেমন অভাব, তেমনি অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই যানজট লেগে থাকে। কত শ্রমঘণ্টা রাস্তায় কাটাতে হয় এবং কত তেল পোড়াতে হয়, তা গবেষকেরা মাঝেমধ্যে নিরূপণ করেন বটে, তবে ওই সব গবেষণা ফাইলবন্দীই হয়ে থাকে।
ঢাকার ট্রাফিকের ব্যবস্থাপনা যেমন, সার্বিকভাবে দেশের অন্যান্য শহরের চিত্র তার চেয়ে ভয়াবহ। এগুলো নিয়ে লিখতে বসলে মোটামুটি বৃহৎ আকারের বই রচনা করা যায়। ঢাকার ট্রাফিক আমাদের সমাজের চিত্র, যেখানে বিশৃঙ্খলাই শৃঙ্খলা। আর রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা আর ব্যবস্থাপনা? বিমানবন্দর আর শহর দেখলে সহজেই অনুমেয়। এ বিষয় নিয়ে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর বেশি বলার প্রয়োজন হয় না।
কেউ হয়তো বলতে পারেন, আমি যা নিয়ে আলোচনা করলাম তার তথ্য-উপাত্ত কোথায়? আমার কাছে নেই। তবে চাক্ষুষ প্রমাণ রয়েছে। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে অনুরোধ করব আমাদের রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আর বিমানবন্দরের হালহকিকত ওই আলোচিত অধ্যাপকের তত্ত্বের আলোকে নিরীক্ষণ করুন। তার মধ্য দিয়েই উপলব্ধি করবেন ওই তত্ত্বের বাস্তবতা। আরও পাবেন আমাদের রাষ্ট্রের ও সরকারের ব্যবস্থাপনার চিত্র। একটি দেশের রাজধানী যদি বসবাসের যোগ্যতার ক্ষেত্রে তলানিতে থাকে, তবে দেশের অন্যান্য শহরের কোথায় অবস্থান, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা এই অব্যবস্থাপনা থেকে কবে বের হতে পারব জানি না, তবে যত দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা না হবে, তত দিন পর্যন্ত তো নয়।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
[email protected]