দায়িত্বটা সরকারেরই

প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বের কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছেন। স্বজনদের জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কেবল ২০১২ সালে আত্মহত্যা করেছেন আট লাখ মানুষ। ডব্লিউএইচওর সব কটি অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। আত্মহত্যা একটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা—অনেক দেশে নিষিদ্ধও। সে কারণে আত্মহত্যার ঘটনা অনেক সময় লিপিবদ্ধ হয় না।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর আত্মহত্যার ধরন নির্ভর করে। কোন বয়সে মানুষ বেশি আত্মহত্যা করছেন? দেখা গেছে, ধনী দেশগুলোয় বেশি বয়সে মানুষ আত্মহত্যা করেন, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত দেশগুলোয় অল্প বয়সে আত্মঘাতী হন বেশি। বিশ্বে আত্মহত্যার যত ঘটনা ঘটছে, তার ৭৫ শতাংশের বেশি ঘটছে নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোয়। সেসব দেশের মধ্যে আবার এগিয়ে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশ। গোটা বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ লোকের বাস এই অঞ্চলে।
সাধারণভাবে নারীদের তুলনায় পুরুষেরা বেশি আত্মহত্যা করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থাভেদে এ চিত্রেরও ভিন্নরূপ দেখা যায়। ধনী দেশগুলোয় নারীদের তুলনায় পুরুষদের আত্মহত্যার হার তিন গুণ পর্যন্ত বেশি। কিন্তু নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশে এই হার ১ দশমিক ৫ জন পুরুষ: ১ জন নারী। বেশির ভাগ দেশে সত্তরোর্ধ্ব মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কিন্তু ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন।
নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোয় আত্মহত্যায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কীটনাশক বিষ। অন্যদিকে ধনী দেশগুলোয় মানুষ ফাঁসিতে ঝুলে বা গুলিতে আত্মহত্যা করেন বেশি। আত্মহত্যার প্রবণতা, ধরন ও পদ্ধতি বদলায় সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী ও সময়ের সঙ্গে। কাজেই আত্মহত্যা রোধে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হলে আত্মহত্যা ও আত্মহত্যা চেষ্টার সাম্প্রতিক তথ্য সরকারের হাতে থাকা দরকার। এই তথ্য সংগ্রহের কাজ বেশ জটিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মহত্যা কলঙ্কজনক ইস্যু, আইনত নিষিদ্ধ। সে কারণে সত্যিকারের পরিসংখ্যান পাওয়া বেশ কষ্টকর। যত দিন পর্যন্ত দেশ বা সম্প্রদায়গুলো আত্মহত্যাকে একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা বলে চিহ্নিত না করছে এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এমন মানুষের পাশে এসে না দাঁড়াচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত আত্মহত্যা প্রতিরোধের যুদ্ধ সফল হবে না।
আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সরকারকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। সবার আগে জাতীয় পর্যায়ে একটি কৌশল নির্ধারণ করতে হবে, আত্মহত্যা প্রতিরোধে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অঙ্গীকার করতে হবে। বিশ্বের মাত্র ২৮টি দেশে এ ধরনের কৌশলপত্র আছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ দরকার।
আত্মহত্যায় মানুষ যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে থাকে, সেগুলোর সহজলভ্যতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় কীটনাশকের সহজলভ্যতা নিয়ন্ত্রণ করে সুফল পাওয়া গেছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণও কাজে এসেছে। যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, দ্রুত তাদের কাছে স্বাস্থ্যকর্মীদের পৌঁছাতে হবে। সমাজের ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বৈরী পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোয় সাহায্য করতে হবে। তাঁদের বোঝাতে হবে, সবাই তাঁদের সঙ্গেই রয়েছেন। তাঁদের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে দিতে হবে। আর এ উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে সংবাদমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। আত্মহত্যা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে তথ্য দিতে হবে, আত্মহত্যার ঝুঁকি সম্পর্কে জানাতে হবে, প্রয়োজনে সাহায্য কোথায় পাওয়া যাবে, তা-ও জানাতে হবে। কিন্তু আত্মহত্যাকে গৌরবান্বিত করার কোনো চেষ্টা মেনে নেওয়া যায় না। সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংবাদমাধ্যমগুলো যেন এগিয়ে আসে, সে বিষয়ে সরকার সহযোগিতা করতে পারে। মানসিক রোগে কেউ ভুগছে কি না, মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ঝুঁকি কী—এসব বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য ও মাদক নিয়ন্ত্রণ নীতিকে সমন্বিতভাবে দেখতে হবে। সরকারকে সে জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দও করতে হবে।
গোটা বিশ্বে মৃত্যুর প্রথম ২০টি কারণের একটি আত্মহত্যা। মানসিক রোগ, বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি, নির্যাতন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট মানুষকে আত্মহত্যায় আগ্রহী করে তুলতে পারে। কৃষিনির্ভর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আত্মহত্যার প্রধান মাধ্যম কীটনাশক বিষ। কীটনাশক বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধের দায়িত্ব কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়, এ দায়িত্ব সবার। একযোগে শিক্ষা, শ্রম, পুলিশ, বিচারব্যবস্থা, ধর্ম, আইন, রাজনীতি ও সংবাদমাধ্যমকে কাজ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য কর্মপরিকল্পনার প্রধানতম অঙ্গ আত্মহত্যা প্রতিরোধ। এই কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ হারে আত্মহত্যার হার কমাতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন প্রতিবেদন ‘সুইসাইড প্রিভেনশন: এ গ্লোবাল পাবলিক ইমপারেটিভ’-এ জনস্বাস্থ্য নীতিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং একযোগে কাজ শুরুর গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ড. পুনম ক্ষেত্রপাল সিং: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক।