মৃত্যুর আগে দেশকে কী বলেছিল রুবেল?

অসম্ভব লাজুক আর বিনয়ী ছিল রুবেল l ছবি: ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান–এর সৌজন্যে
অসম্ভব লাজুক আর বিনয়ী ছিল রুবেল l ছবি: ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান–এর সৌজন্যে

ব্রিটেনে ‘আউটসাইডার’ বাংলাদেশি তরুণ রুবেল নিজের মতো জীবন চেয়ে পেলেন করুণ মৃত্যু। আলব্যের কামুর আউটসাইডার উপন্যাসের নায়ক চেয়েছিল মৃত্যুর সময় তার চারপাশে থাকুক অনেক মানুষের কলরোল। ব্রিটেনের হাজতে ২৬ বছর বয়সী রুবেলের মৃত্যুর পরিবেশ জনবিরল ছিল না। কিন্তু পাশে থাকার সুযোগ হয়নি কারোরই। ‘অবৈধ’ অভিবাসীদের হাজতখানায় সবাই-ই তো তাঁরা বন্দী। রুবেলের সাহায্যের জন্য চিৎকার শোনা ছাড়া তাঁদের কিছুই করার ছিল না। মৃত্যুমুখে মানুষ শেষবারের মতো স্বজনের দেখা চায়। কেন চায়? একা একা মরে যেতে চায় না কেউই। কেন চায় না? হয়তো দরদি চোখের শেষ দেখাদেখিই মানুষের অন্তিম ও চিরন্তন ইচ্ছা। হয়তো একাকী মৃত্যুর বিভীষিকা বহুগুণ বেশি। আমাদের রুবেলও এভাবে একা একা মরে যায়। বুকে ব্যথার কথা জানা গেছে, নির্যাতন হয়েছিল কি না জানা যায়নি। ঘণ্টারও বেশি সময় গরাদের শিক ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে সাহায্য ভিক্ষা করে গেছে। কেউ আসেনি। সিলেটের বিয়ানীবাজারে মা তখন অপেক্ষায়, এই তো ছেলে ফিরল বলে।
বিলাতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাফ জানিয়ে দিয়েছে, রুবেল আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু রুবেলের সহবন্দীরা তা বিশ্বাস করেননি। ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় তাঁরাই বলেছেন, রাত সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত রুবেলের কণ্ঠস্বর তাঁরা শুনেছেন। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স এসেছে রাত সাড়ে ১১টায়। তখন সব শেষ। শেষের পরে শুরু হলো অন্য কাহিনি।
রুবেলের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবরটাও জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি মর্টন হল নামের ওই ডিটেনশন সেন্টারের কর্তারা। খবরটা রুবেলের উকিলের কাছে দেন সেখানকারই আরেক বন্দী। ঘটনা গত শুক্রবার রাতের। শনিবার সকালে কারাকক্ষগুলোর দরজা খোলার পর বিদ্রোহ করে বসেন অন্য বন্দীরা। তাঁরা রুবেলের মৃত্যুর প্রতিবাদ করেন, নিজেদের অমানবিক অবস্থার জন্য কারা প্রশাসনকে অভিযুক্ত করেন। রক্ষীরা তাঁদের সামলাতে ব্যর্থ হলে দাঙ্গা পুলিশ আসে। এর মধ্যে খবরটা ব্রিটিশ গণমাধ্যমে চাউর হয়। এত কিছু ঘটে যায়, অথচ লন্ডনের বাংলা পত্রিকা ইউকেবেঙ্গলি জানাচ্ছে, সেখানকার বাংলাদেশি দূতাবাস সম্পূর্ণ বেখবর!
পছন্দমতো জীবনের আশায় রুবেল আহমেদ পাঁচ বছর আগে লন্ডনে পাড়ি জমান। জীবনের অধিকারের মতোই মৌলিক পছন্দসই জীবনের অধিকার। কিন্তু সেটাই তঁার কাল হলো। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলো এর থোড়াই পরোয়া করে। যা হোক, ব্রিটেনে বসবাসের অনুমতি চেয়ে আবেদনও করেন রুবেল। সেই আবেদন এখনো ঝুলন্ত আছে। এই অবস্থায় গত রোজার সময় রেস্টুরেন্টে কর্মরত অবস্থায় ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে আটক করে। রুবেলের অপরাধ, তিনি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় উপস্থিত হয়েছিলেন।
লর্ড ক্লাইভের বঙ্গদেশে ব্যবসা করতে আসার জন্য নবাবের দরবার থেকে ভিসা নিতে হয়নি। যে পাঁচ লাখ ব্রিটিশ শেষ দিন পর্যন্ত ভারতবর্ষে ছিল, তাদের কারোরই ভিসা ছিল না। ভিসা-পাসপোর্টের বাধ্যবাধকতা মানলে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করতেই পারতেন না। সেটা এমন এক সময়, যখন পা-ই ছিল মানুষের আসল পাসপোর্ট, যার মেয়াদ কখনো ফুরোত না। আর এটা এমন এক সময়, যখন কালো বা সাদা সব টাকাই বিনা বাধায় যাওয়া-আসা করে, দখলদার সেনারা সীমান্ত পেরোয় অতর্কিতে, পুঁজি ও মুনাফা মুহূর্তে দেশ ছাড়ে, কিন্তু মানুষ তা পারে না।
এসব কথার দাম নেই আজকের দুনিয়ায়। যাঁর কথার দাম আছে, তাঁর কথা শুনি বরং। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক নবনিযুক্ত হাইকমিশনার জাইদ রা’য়াদ আল হুসেইন ৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ২৭তম অধিবেশনের উদ্বোধনী বক্তৃতা শেষ করেছেন অভিবাসীদের মানবাধিকারের দাবি তুলে। তিনি বলেছেন, ‘মানবাধিকার কেবল নাগরিকদের জন্য বা ভিসাধারীদের জন্য সংরক্ষিত নয়। প্রতিটি নাগরিক, তা তিনি যেখানকার অধিবাসী বা যে ধরনের (বৈধ বা অবৈধ) অভিবাসীই হোন; এটা তাঁর অবিচ্ছেদ্য অধিকার। আইন প্রয়োগের নামে ও নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধিক অভিবাসীদের অমানবীয় অবস্থায় ফেলার প্রবণতা বাড়ছে। তাতে করে অভিবাসীরা হিংস্র পরিবেশে পতিত হচ্ছেন, আইনের পূর্ণ সুরক্ষাও বেশি করে হারাচ্ছেন।’
ব্রিটেনে বা কাতারে এই হিংস্র অমানবিক দশারই শিকার আমাদের রুবেল আহমেদরা। এ বছরেই ব্রিটেনে নিরাপত্তা হেফাজতে দুজন আফ্রিকানের মৃত্যু হয়েছে। গত ২০ বছরে অভিবাসী হতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে জীবন দিয়েছেন ২০ হাজার মানুষ। ভারত সীমান্তে, বঙ্গোপসাগরে অথবা মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর থেকে আরব অবধি হাজার হাজার অভিবাসী বাংলাদেশির হত্যা-মৃত্যু তো দৈনন্দিন ঘটনা।
ইউরোপে অভিবাসীবিরোধী বর্ণবাদ যতই শক্তিশালী হচ্ছে, সরকারগুলোর অভিবাসন আইনও ততই কঠোর হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকার সম্প্রতি অভিবাসীবিরোধী হুমকিজনক বিজ্ঞাপন দিয়ে সাজানো ট্রাক লন্ডন শহর ঘোরানোর ব্যবস্থা করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে অমানবিক বর্ণনা করে হইচই করলে ট্রাকগুলো গ্যারেজস্থ হয়। কিন্তু আইন তো আর বাতিল হয়নি। এই আইন এমনই আইন, যেখানে অভিবাসীরা যেন অপরাধী। অপরাধীদের মতোই তাঁদের হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে আটকে রাখা হয়। বিনা বিচারে বছরের বছর আটকে রাখার নজিরও বিস্তর। এ রকম অবস্থায় অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, বছরে এই সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। আটকদের ৮৫ ভাগই হয় মানসিক রোগের শিকার। গেল বছর কেবল যুক্তরাজ্যেই আটক অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার!
অভিবাসনের মূল কারণ বৈশ্বিক বৈষম্য। একসময়কার সমৃদ্ধ দেশগুলো যখন ইউরোপীয়দের উপনিবেশ হয়ে পড়ল, তখন থেকেই উপনিবেশিত দেশের সম্পদ যে পথে পাচার হয়েছে, সেই সব দেশের সম্পদবঞ্চিত মানুষও সে পথেই অভিবাসী হয়েছেন। অভিবাসনকে তাই বলা যায় উপনিবেশবাদের উল্টানো রূপ। যেমন উপনিবেশিত এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকার সম্পদ ছাড়া ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলো চলতে পারত না, এখন তেমনি অভিবাসীদের শ্রম ছাড়া এসব দেশের অর্থনীতি অচল। এদের সঙ্গে জুটেছে মধ্যপ্রাচ্যের তৈলশাহীগুলো। সম্প্রতি ইতালির এক মন্ত্রী এর সত্যতা স্বীকারও করেছেন। নিম্নমানের কম মজুরির কাজগুলো কে করবে? তৃতীয় দুনিয়ার যুবক-যুবতীরা কম মজুরিতে তাদের কাজগুলো করে না দিলে যুব-জনসংখ্যা কমতে থাকা ইউরোপের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। তার পরও, বর্ণবাদী মনোভাব থেকে অভিবাসীদের ঠেকানোর তোড়জোড় চলে। আইনের ভয় দেখিয়ে মজুরি কমানো হয়, অধিকার কাটা পড়ে।
মাল্টার প্রেসিডেন্ট এই অবস্থার প্রতিবাদে যা বলেছেন তা আমাদের কথা: কত মানুষের মৃত্যু হলে এই অবস্থার বদল ঘটবে? আইন বদলাতে হবে। কঠিনই করুন বা সহজই করুন, বিদ্যমান আইনে ফাটল আছে; সেটা সারান। নইলে সীমান্তগুলো কবরস্থানে ভরে যাবে।
রুবেলের লাশ দেশে আসছে। যেভাবে পাঁচ বছরে এসেছিল প্রায় ১৫ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের লাশ। নিয়ম অনুযায়ী ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র দপ্তর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু এর আরেকজন রুবেল কি এতে নিরাপদ হবে? সমস্যার গোড়া তো রয়েছে অভিবাসনবিরোধী ব্যবস্থার মধ্যে। সেটা সারানোয় বাংলাদেশের মতো অভিবাসনের উৎস দেশগুলোকে অভিবাসনের গন্তব্যের দেশগুলোর সঙ্গে জোরদার সংলাপে দর–কষাকষিতে নামতে হবে। আমাদের মানুষ আর তোমাদের কাজ; লাভ তো দুই পক্ষেরই। তাহলে কেন ভাই হাঁকডাক? ভিসাবঞ্চিত অভিবাসীদের অপরাধী হিসেবে দেখার চোখটা তাই ধুয়ে নিতেই হবে।
বাংলাদেশের সরকার, পৃথিবীর সব বাংলাদেশি নাগরিকের সরকার। নিজের নাগরিকের মর্মান্তিক মৃত্যুতে যে সরকার নির্বিকার থাকে, সে কি ভালো সরকার? রুবেলের জন্য যারা কেঁদেছিল, যারা প্রতিবাদ করেছিল তারা বাংলাদেশি ছিল না। ভিনদেশিরা যদি পারে, স্বদেশিরা পারে না কেন? মৃত্যুর আগে মানুষের মনে প্রিয় মুখ ভাসে। বিদেশ–বিভুঁইয়ে বিপদে পড়লে এমনকি মরে যাবার সময় মুখে দেশের কথাও কি মনে আসে? গরাদের শিক ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হয়তো রুবেল ভেবেছিল, আমার দেশ কি আমাকে বাঁচাবে না? এক রুবেল গেছে, অন্য রুবেলরা কিন্তু দেশকে চাইছে। প্রবাসেই দেশকে বেশি দরকার হয় প্রবাসীর।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]