বিরাজনীতিকরণ ও জাতীয় পার্টির হালচাল

অলংকরণ : তুলি।
অলংকরণ : তুলি।

বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে কোনো দিনই গণতন্ত্র ছিল না। প্রায় সব সময়ই স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চলেছে। সার্বিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চাও হয়নি। আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো সরকারই স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। গণতন্ত্রের কথা মুখে বললেও কার্যত কোনো সরকারই তা চর্চা করেনি। পাশাপাশি গণতন্ত্রের চর্চার জন্য আবশ্যক সহযোগী যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তা প্রতিটি সরকার নিজেদের দলীয় স্বার্থে দুর্বল করে বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। গণতন্ত্র মুখে আছে, কাজে নেই। দেশে স্বৈরতন্ত্র বিরাজমান এবং প্রতিদিন তা কলেবরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে বলা যায়। তবু কিছুটা হলেও দেশে রাজনীতি ছিল। বাক্স্বাধীনতা ছিল, সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যকর বিচারিক পদ্ধতি ছিল, সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ ছিল। বর্তমানে রাজনীতি নেই, চলছে ক্রমান্বয়ে বিরাজনীতিকরণ।

আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এখন দেশে যে অবস্থা চলছে, তাতে রাজনৈতিক দলগুলো বিলীন হওয়ার পথে। অর্থাৎ বিরাজনীতির পথে অগ্রসর হচ্ছে দেশ। তাঁবেদার বিরোধী দল ছাড়া দেশে সরকারবিরোধী কোনো রাজনীতি থাকবে না, দৃশ্যত এ পথে দেশ পরিচালিত হচ্ছে।
যেমন সরকার সম্প্রচার নীতিমালা করেছে। সেখানে বর্ণিত নীতিসমূহ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। কিছু গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, পাশাপাশি কিছু মানবাধিকার সংগঠনের আশঙ্কা, এ নীতিমালা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করবে। দেশের উন্নয়নসহ সার্বিকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে এ নীতিমালা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তা ছাড়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ÿক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। এ বিধান অনেক দেশে আছে। তবে আমাদের দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ পরিবর্তনটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। কারণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সাংসদেরা এ বিষয়ে নিজস্ব মতামত দিতে পারবেন না। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মত দিতে হবে। দলের সিদ্ধান্ত দেওয়ার একক ক্ষমতা দলীয় নেতার ওপর। আর দলীয় নেতা ও সরকারপ্রধান এক ব্যক্তি হলে পুরো ক্ষমতা এক ব্যক্তির ওপর বর্তায়। বর্তমান সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য আওয়ামী লীগের দলভুক্ত। সেই দলেরই প্রধান, সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী, একই সঙ্গে তিনি সংসদীয় দলের নেতাও। একক সিদ্ধান্তে যেকোনো সময় সরকারপ্রধান হাইকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারবেন। এ ঝুঁকির মধ্যে বিচারকেরা সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে সরকারকে বা সার্বিকভাবে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগ। সে প্রতিষ্ঠানকে যদি নির্বাহী বিভাগের প্রধান নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন, তাহলে এ প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
উপরিউক্ত ওই সংশোধনীর কারণে নির্বাচন কমিশনাররাসহ সব সাংবিধানিক পদে কর্মরত ব্যক্তিদের ভাগ্য একইভাবে সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত হবে। ফলে নির্বাচনব্যবস্থায় নিরপেক্ষ পরিবেশ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। মানবাধিকার, তথ্য জানার অধিকার ইত্যাদির ওপর বাড়তি সরকারি নিয়ন্ত্রণের চাপ আসবে।
এক কথায় বলা যায়, ক্রমান্বয়ে সংবাদমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন–প্রক্রিয়া ইত্যাদি গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ সরকারপ্রধানের ও সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। একই সঙ্গে যেকোনো ধরনের সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের ওপর প্রশাসনের নিষ্পেষণ চলমান রাখা হয়েছে। তাদের মতামত প্রকাশ কঠিন করা হচ্ছে এবং মতামতসমূহকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে না। ফলে সরকারবিরোধী দলসমূহ অকার্যকর হয়ে বিলীন হবে, এটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

তবে অতীতেও বাংলাদেশে একই ধরনের প্রচেষ্টা দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো জনবহুল সীমিত সম্পদের সমস্যাসংকুল দেশে জোর করে সরকারবিরোধী মনোভাব বন্ধ করা যায় না। ফলে সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক সংগঠন থাকবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। সরকারবিরোধী প্ল্যাটফর্ম যাতে কার্যকর হয়, তা জনগণও উপলব্ধি করছে। মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, সরকারের জবাবদিহিকরণ ও সরকার পরিবর্তনের সুযোগ জনগণের কাম্য। এ ইচ্ছার সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হবে এ ধরনের রাজনৈতিক শক্তি জনগণের আকাঙ্ক্ষা। সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা যেকোনোভাবেই পূরণ হবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দলগুলো যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দাঁড়াতে পারে, তবে তা দেশের জন্য মঙ্গল। আর তা না হলে এ শূন্যতা পূরণ হবে চরমপন্থী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর মাধ্যমে; এ দেশে আল-কায়েদার শাখা খোলার কথায় যার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। এ ধরনের গোষ্ঠীর সফলতা অনেকাংশেই জনসমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। জনগণের কাছে অন্য কোনো নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ পন্থা দৃশ্যমান না হলে এ ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠীকে জনগণ সমর্থন দেবে না, তা বলা যায় না।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ইতিমধ্যে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গেছে। দেশের অনেক বিনিয়োগকারী তাঁদের অর্থ বিদেশে পাচার করছেন এমন খবরও শোনা যাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি বেশি দিন থাকলে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবে দেশে। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। কর্মসংস্থান না থাকলে বেকার সমস্যা ও আনুষঙ্গিক নানা সামাজিক সমস্যা দেখা দেবে, যা রাজনৈতিক সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করবে।

তা ছাড়া সুশাসনের অভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। গুম, খুন, অপহরণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। কারণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯১ সালের পর থেকে দেশে রাজনীতিতে দলীয়করণের সংস্কৃতি চালু হয়েছে, যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনগণকে সরকারের তরফ থেকে দুভাবে ভাগ করা হয়েছে। যারা যখন ক্ষমতায় থাকে, অর্থাৎ সরকারি দল (বর্তমানে আওয়ামী লীগ) ও তাদের সঙ্গে যারা জড়িত দলীয় লোকজন প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য হন। আর তাঁদের বাইরে সাধারণ জনগণ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুযোগ-সুবিধা বণ্টন ছাড়াও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে শ্রেণিভেদ অনুযায়ী আলাদা করে দেখা হচ্ছে। আইন প্রয়োগে প্রথম শ্রেণির নাগরিকের জন্য করা হয় নমনীয় আচরণ। আরা যাঁরা ক্ষমতাসীনদের বাইরে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, তাঁদের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা হয়, হয়রানির অভিযোগও পাওয়া যায়। পার্টির লোকজন আইনের ঊর্ধ্বে ওঠায় অপরাধীরা যেকোনো প্রক্রিয়ায় সরকারি দলের খাতায় নাম লেখায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির এটি অন্যতম প্রধান কারণ। আইনের চোখে সবাই সমান, সরকারের তরফ থেকে সবার জন্য আইন সমানভাবে প্রয়োগ করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে আশা করি। বাস্তবে তা হতে দেখা যাচ্ছে না।

সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সরকারের পরিবর্তনের সুযোগ না থাকলে কোনো না কোনোভাবে আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে এবং তার মাধ্যমে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অবাঞ্ছিত সংগঠনের নেতৃত্বে সরকারের পতন হতে পারে। সারা দেশে রাজনৈতিক গুমোট ভাব চলছে। এটা ঝড়ের পূর্বাভাস কি না, তা নিয়ে জনমনে আশঙ্কা আছে। কেননা, এ ধরনের পরিস্থিতিতে কেবল সরকারই বিপাকে পড়বে তা নয়, চরম বিশৃঙ্খলা ও হানাহানির সৃষ্টি হয়ে সাধারণ জনগণের জানমালেরও ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে, যা কারও কাম্য হতে পারে না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির বর্তমান রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ করণীয় কী হতে পারে? জাতীয় পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে গেজেট-ঘোষিত বিরোধী দল। জনগণের পক্ষে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার গুরুদায়িত্ব বিরোধী দলের। সরকারের অংশ হিসেবে মন্ত্রিপরিষদে জাতীয় পার্টির সাংসদ থাকলে ওই পার্টির পক্ষে সরকারের জবাবদিহি কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য হয় না।

তা ছাড়া আইনগত জটিলতার আশঙ্কা থাকে। মন্ত্রিপরিষদের অংশ হিসেবে সাংবিধানিক কারণে সংসদে সরকারি প্রস্তাবে জাতীয় পার্টি ‘না’ ভোট দিতে পারবে না। দিলে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদেরও সরকারি প্রস্তাবে ‘না’ ভোট দিতে হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিধানের কারণে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের মন্ত্রিত্ব থাকে না। সংবিধানের ৫৫(৩) ধারায় বর্ণিত, ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন’ লঙ্ঘিত হবে। ফলে তাঁরা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে বহাল থাকার আইনগত অধিকার হারাবেন। আর সবর্দা ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে গণ্য করা যায় না।
জাতীয় পার্টির বর্তমান অবস্থা জনগণের চোখে নাজুক দৃশ্যমান হচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্ব নিয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা আজও বিদ্যমান। দেখা যাচ্ছে, যাঁরা দশম সংসদের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে পার্টির চেয়ারম্যানের নেতৃত্ব মানার কথা মুখে বললেও বাস্তবে তাঁর আদেশ-নির্দেশ অবহেলা করছেন। নিজেদের অনুকূলে হলে মানছেন, না হলে বর্জন করছেন।

অবশ্য এ বিষয়ে সম্প্রতি পার্টির চেয়ারম্যান শৃঙ্খলা রক্ষায় কিছু কিছু পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। এতে করে পার্টির কর্মকাণ্ডে
শৃঙ্খলা ফিরে আসবে আশা করা যায়। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টির জন্য নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দল হিসেবে অবস্থান গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি তাঁবেদার বিরোধী দল নয়, প্রকৃত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন, যা সরকারবিরোধী জনক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে, সরকারকে জনগণের পক্ষ থেকে জবাবদিহির সম্মুখীন করবে ও ভবিষ্যতে একটি বিকল্প সরকারের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হবে।

গোলাম মোহাম্মদ কাদের: জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী।