যাঁদের কথা ভুলে গেছে বাংলাদেশ

‘আমাদের অনেক দুঃখ আছে। কতবার কতজনকে জানালুম, আর কত বলব বাবু? আমরা যে রুজি পাই, তাতে পরিবারের খরচ কুলায় না। কাপড়চোপড় দিতে পারি না। ছেলেপিলেদের যত্ন নিতে পারি না, শিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে পারি না। আমরা যে রেশন পাই, তাতে খোরাক চলে না। সপ্তাহে দুই দিন উপবাস দিতে হয়। শীতের কাপড় কিনতে পারি না, ছেঁড়া বস্তা দিয়ে শীত কাটাই।’
কথাগুলো একজন চা-শ্রমিক ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর, তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে শুনিয়েছিলেন। তারপর পাকিস্তান গেল, হলো বাংলাদেশ। গণসংগীতশিল্পী আবসার আহম্মেদের গানের ভাষায়, ‘উঠল সুরুজ-আঁধার গেল না’র মতো দুটি পাতা একটি কুঁড়ির নিচে ঘন অন্ধকার একটুও কমল না। মাথাপিছু আয় বাড়ল, দিকে দিকে কত শান-শওকত, কিন্তু চা-বাগানের ভেতর যদি কুছ পরোয়া নেহি বলে ঢুকে পড়তে পারেন, তাহলে বুঝবেন, সাদা চামড়া আর কালো চামড়ার শাসনদণ্ডের ভেদ এখানে লুপ্ত হয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘দুয়ারে এঁকেছি রক্ত রেখায় পদ্ম আসন’-এর মতো বরাক উপত্যকার চা-বাগানের ইতিহাসও রক্তরেখায় ভেজানো। যখন বরাক উপত্যকায় চা-বাগান করা হলো, তখন ক্রীতদাস প্রথার অভিনব সংস্করণ হাজির করা হলো এখানে। হাজার হাজার মানুষ দাসত্বের শিকলে আটকা পড়ে গেল ভিনদেশের চা-বাগানের জেলখানায়। কোথাও কেউ নেই, আত্মীয়স্বজন নেই, বন্ধু-সখা কেউ নেই। বুটের লাথি আর চাবুকের প্রহারে যখন চা-বাগানের কন্দরে-কন্দরে, গুহায় ও ছড়ায় তাঁরা ডুকরে উঠেছেন, তখন কেউ শোনেনি। যখন
মারা গেছেন, খবর রাখেনি কেউ। অসহ্য যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করেছেন তাঁরা।
১৯২১ সালে যখন ভারতজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, তাঁরাও এই ফাঁকে বিদ্রোহে ফেটে পড়েন। উদ্যোগ নেন নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার, কিন্তু বরাক উপত্যকা থেকে বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ ও উত্তর প্রদেশে ফিরে যাওয়া সহজ ছিল না। গোলামির শিকল ছেঁড়া যে কতটা কঠিন, তাঁরা টের পেলেন কুমিল্লার চাঁদপুর ঘাটে এসে। পুলিশ ঠেকিয়ে দিল, চলল গুলি। মরলেন শত শত আর আহত হলেন হাজারে হাজার। বাকিদের জোর করে শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানো হলো। রচিত হলো মূলক রাজ আনন্দ-এর বিখ্যাত উপন্যাস দুটি পাতা একটি কুঁড়ি। গঠিত হলো তিনটি কমিশন—১৯২১ সালে রয়েল কমিশন, ১৯৩৪ সালে দেশ কমিশন এবং জোন্স মিশন নামে মেডিকেল কমিশন। ভারত ভাগের আগে ১৯৪৬ সালে একটি সরকারি তদন্ত কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছিল, ‘চা-বাগানের মজুরদের কোনো রকমের স্বাধীনতা নেই। বাগানের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নের কাজকর্ম চালানো সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশে চা-শিল্পে নিয়োজিত মূলধনের মোট পরিমাণ জানা না গেলেও ব্রিটিশ মূলধনের ওপর নির্ভর করেই এ দেশে চা-শিল্প গড়ে উঠেছে। পাকিস্তান আমলের এক হিসাব থেকে জানা যায়, চা-শিল্পের মুনাফা বছরে ২৮ থেকে ৩২ কোটি টাকা লন্ডনে পাঠানো হতো। চা-শিল্পের জায়গাজমির মালিকানাও ছিল ব্রিটিশ চা কোম্পানিগুলোর। ১৯৮৩ সালের এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৫২টি চা-বাগানগুলোর অধীনে দুই লাখ ৮০ হাজার একর জমি রয়েছে।
বর্তমানে শ্রমিকদের ঘর-দরজার দুরবস্থা, পানি-শিক্ষা-চিকিৎসার কোনো সুবিধা নেই। ওভার টাইমের দ্বিগুণ মজুরির কোনো সুবিধা শ্রমিকেরা পান না। ফ্যাক্টরিগুলোর ভেতরে কী চলছে কেউ জানি না। এখানে বয়স নির্ধারণ করা হয় মালিকদের মর্জিমতো। কম মজুরি দেওয়ার উদ্দেশ্যে ২৫ বছরের যুবকদের বয়স লিখে রাখা ১৫, ১৬ অথবা ১৭ বছর। আবার কখনো ২৫ বছরের যুবকের বয়স হয়ে যায় ৪৩ বছর। এতে প্রয়োজনে অবসর দেওয়ার সুবিধা হয়। অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিক ও স্থায়ী শ্রমিকদের একযোগে কাজে মোতায়েন করে দ্বিগুণ-তিনগুণ শ্রমশক্তি ও শ্রম দিবস মালিকেরা কাজে লাগান। বাগানে অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের কোনো পেনশন নেই, বৃদ্ধ বয়সে ভিক্ষা করে চলতে হয়।
জনৈক শ্রমিক তাঁর জবানিতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ তো বানাইলাম বাবু, কিন্তু আমাদের কী হইল? হামরা বাঙালি নাই, তবু তো জয় বাংলা বললাম। “জয় বাংলা”য় বাঙালি বাবু ম্যানেজার সাহেব আইল, কিন্তু হামাদের পেটে ভাত নাইক্যা, পরনে কাপড় নাইক্যা, দিনকে দিন হামরা মরতে বসেছি। হামাদের জোয়ান মাইয়া গিলা বস্তি, গেরামে যাইকে মাটি কাটে, শরম ঢাকতে পারে না। হামাদের দিকে কেউ চায় না বাবু। কষ্ট তো খালি বাড়তেই আছে। ইউনিয়ন বাবুরা হামাদের জন্য কিচ্ছু করে না। বিল্ডিংয়ে থাকে, গাড়ি হাঁকায় আর চান্দা কাটাই করে নিয়ে যায়। কোনো দিন বাগানেও আসে না।’
শ্রমিকেরা আজকের বাজারে ৬৯ টাকা মজুরি পান, এটা ভাবা যায়? ৩০০ টাকা মজুরি, পূর্ণাঙ্গ রেশন, সাপ্তাহিক ছুটির দিনের মজুরি, এমবিবিএস ডাক্তার, মহিলা শ্রমিকদের জন্য মহিলা ডাক্তার, মন্দির-মসজিদ সংস্কারের দাবিতে এই কর্মবিরতি চলছে। আমরা তাঁদের কোন কোন দাবিকে অস্বীকার করব? এর মধ্যে ভাড়াটে শ্রমিক দিয়ে বাগান চালানোর চেষ্টা হয়েছে, পুলিশের সামনে শ্রমিকদের পিটিয়েছে মালিকপক্ষ। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা কি এখানে প্রযোজ্য নয়? তাঁরা কি সাংবিধানিক অধিকার পাবেন না? হাইকোর্ট কী বলেন? চা-বাগানের গহিন অন্ধকারে তাঁরা কি সত্যিই হারিয়ে যাবেন?
সোনারগাঁও হোটেলের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ব্রেকফাস্ট টি ১২০ টাকা, দার্জিলিং টি ১২০ টাকা, গ্রিন টি ১২০ টাকা, অলিম্পিক টি ১৮০ টাকা, আইস টি ১৪০ টাকা ছিল কয়েক দিন আগে। এখন সবগুলোর দাম বেড়ে ১৯৪ টাকা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা এই চায়ের উৎপাদক, তাঁরা কি দুই কাপ চায়ের দামও পাবেন না? তাঁরা পাতা শুকিয়ে বড়ি বানিয়ে চিনির বদলে লবণ দিয়ে চা খান। টেলিভিশনের ক্যামেরায় সাজানো বাগানে হাস্যরত মালির অভিনয় দেখি, সংসদে ইতিহাস দখলের লড়াই দেখি, কিন্তু চোখের সামনে জীবন্ত মানুষ মরে মরে যে ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে; আমরা তা দেখব না?

নাহিদ হাসান: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।
[email protected]