দুর্মুখেরা রটাইল, 'পাখি মরিয়াছে'

আজ কারও দিকে আঙুল তোলার সময় নয়। সমালোচনা করতে চাইছি না কাউকে। জাতি হিসেবে দীর্ঘদিনে আমরা আমাদের শিক্ষা নিয়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ মেনে নিয়েছি, আপস করেছি, উপেক্ষা করেছি এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশীদার হয়েছি—সেই সমূহ প্রক্রিয়ার তীব্র ফলাফলের মুখোমুখি আজ। কোনো সরকার, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাপদ্ধতি, পরীক্ষাব্যবস্থা—একক অনুঘটকের দিকে আঙুল তোলার কোনো ইচ্ছা থেকে এই লেখা নয়। বরং গভীর বিষাদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছি এমন এক সত্যের, যে সত্যের দায় আমরা অনেকেই এড়াতে পারি না। জাতিকে এই বিষাদময় সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এ বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল।
৯ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয় ‘গ’ ইউনিটের ফলাফল। পাসের হার ২০ দশমিক ৬১ শতাংশ। ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হলো। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল। পাসের হার ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। এবারেও এত কম পাসের হারে প্রতিক্রিয়া তীব্রতর হয়ে ওঠে। তবে সবাইকে হতবাক করে প্রকাশিত হয় ‘খ’ ইউনিটের ফলাফল ২৩ সেপ্টেম্বর। পাসের হার মাত্র ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার শব্দ শোনার মতোই জানতে হলো যে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন মাত্র দুজন।


দুই.

‘গ’ ইউনিটের ফলাফল থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, এত সব জিপিএ-৫ এবং গোল্ডেন জিপিএ-ধারীরা কোথায়? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যার বেগে জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ যারা পাচ্ছে, তাদের মান নিয়ে উদ্বেগ শোনা যাচ্ছিল। দুর্মুখেরা বলছিলেন, এই জিপিএ ফাইভের বেশির ভাগই শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য প্রদর্শনের রাজনৈতিক অভিলাষপ্রসূত। বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁস, ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উদ্বেগ-অনশনের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রীর লেখা আমরা পড়েছি। শিক্ষামন্ত্রীর আরও ভালো করার অঙ্গীকারের প্রতি আস্থা রাখতে চেয়েছি।
কিন্তু এসব উত্তপ্ত বিতর্কের মুখে ঠান্ডা বরফ ঘষে দিয়েছে এই ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল। ইস্টিশন ব্লগে প্রকাশিত ‘জিপিএ ফাইভ, ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা এবং একজন ঈমান আলীর দীর্ঘশ্বাস’ শীর্ষক এক অসাধারণ পোস্টে ব্লগার শঙ্খচিলের ডানা প্রাসঙ্গিক উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন গত ছয় বছরে জিপিএ-৫ যত বেড়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ততই কমেছে। ২০০৯ সালে এসএসসি পাসের হার ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ, জিপিএ-৫: ৪৫ হাজার ৯৩৪ জন, ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হার ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১০ সালে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, জিপিএ-৫: ৬২ হাজার ১৩৪ জন, ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হার ৪৫ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ; ২০১১ সালে পাসের হার ৮২ দশমিক ১৬ শতাংশ, জিপিএ-৫: ৬২ হাজার ৭৮৮ জন, ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ৪১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ; ২০১২ সালে পাসের হার ৮৬ দশমিক ৩২ শতাংশ, জিপিএ-৫: ৬৫ হাজার ২৫২ জন, ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ৩৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ; ২০১৩ সালে পাসের হার ৮৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, জিপিএ-৫: ৯১ হাজার ২২৬ জন, ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ৩১ দশমিক ৮৮ শতাংশ; ২০১৪ সালে পাসের হার ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, জিপিএ-৫: এক লাখ ২২ হাজার ৩১৩ জন, ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। নিরীহ পরিসংখ্যান এ কী দেখাল?


তিন.

জিপিএ ফাইভ-গোল্ডেন ফাইভের সঙ্গে ভালো পড়াশোনার যে কোনো সম্পর্ক নেই, সেই সত্যের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হই বছর তিনেক আগে। ভীষণ ভালো রেজাল্ট করা এক পরিচিত শিক্ষার্থী ঢাকায় আসেন মেডিকেলে ভর্তির কোচিং করার জন্য। মা-বাবার ধারণা, সন্তান তাঁদের ঢাকা মেডিকেলেই ভর্তি হতে পারবে। দীর্ঘদিন কোচিং করে পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেল তো দূরে থাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিষয়েই সে ভর্তি হতে পারেনি। পরের বছর, পুরোটা সময় ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থেকে, নিরবচ্ছিন্নভাবে কোচিং করেও একই ফলাফল। পাবলিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ঢুকতে পারেনি। একদিন শিক্ষকতাজনিত মুদ্রাদোষে এক-আধটু টোকা মেরে বুঝেছিলাম, মূলেই ভয়াবহ গলদ। কোনো বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। অথচ শুরুতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমার এত ভালো রেজাল্ট, তুমি কোচিং করছ কেন? কোচিং ক্লাসে কী এমন পড়ায়, যা তুমি এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার জন্য পড়নি?’ পরীক্ষার্থী এবং তার মা দুজনেই উত্তর দিয়েছিল, ‘সবাই কোচিং করে, না করলে পিছিয়ে পড়তে হবে।’ তাকে কখনো টেক্সট পড়তে দেখতাম না, কোচিং সেন্টারের কিছু নোট মুখস্থ করতে দেখতাম। বিস্মিত হয়েছিলাম কী পরিমাণ টাকাই না খরচ করা হয় এক একজন গুণধর ছেলেমেয়ের পেছনে!


চার.

বছর দুয়েক আগে প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে দলগত উপস্থাপনের বিষয় নির্ধারণ করি ‘কোচিং-বাণিজ্যের যোগাযোগ প্রবাহ’। সেই দলগত উপস্থাপনা শোনা এবং দেখা আমার জীবনের এক নতুন অভিজ্ঞতা। কেবল ঢাকা শহরের ফার্মগেট এলাকা নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও কীভাবে কোচিং-বাণিজ্য এবং প্রাইভেট পড়ানো মহামারি রূপ ধরেছে, সে বিষয়ের ভয়াবহ বর্ণনা উঠে আসে। অনেকটা অ্যাকশন রিসার্চের মতোই, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
জানা যায়, প্রাইভেট না পড়লে ক্লাসে ভালো রেজাল্টের কোনো সম্ভাবনা থাকে না, শিক্ষকদের বিরূপ ব্যবহারের মুখোমুখি হতে হয়, গ্রামের স্কুলগুলোতে এমনকি শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথাও জানালেন কেউ কেউ। প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই শিশুরা যায় প্রাইভেট, কিংবা প্রি-প্রাইমারি কোচিংয়ে। শিক্ষাজীবন শুরুর আগেই তাদের মাথায় ঢুকে যায়, নিজে কিছু করা সম্ভব না। স্কুলে ঢোকার আগেই যে নির্ভরতার শুরু, সেই নির্ভরতা চলতে থাকে আজীবন, বিসিএসের কোচিং পর্যন্ত। তাদের মাঠের কাজে উঠে আসে, প্রাইমারি স্কুলের শিশুরা স্কুলে থাকে দুই ঘণ্টা অথচ কোচিং ক্লাসে থাকে চার ঘণ্টা। ফলে স্কুলের নাম জিজ্ঞেস করলে কেউ কেউ কোচিং সেন্টারের নাম বলেছে। ঢাকার খুব অভিজাত স্কুলের কোচিং-বাণিজ্যের স্বরূপ শুনে হতবাক হয়েছি, ‘এসি রুমের কোচিং’ এবং ‘নন-এসি রুমের কোচিং’ পড়ানো হয় ব্যাচে ব্যাচে। বড় বড় কোচিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সংযোগের কথাও প্রায়ই শুনতে পাই। দু-একটি স্বনামধন্য মেডিকেল ভর্তি কোচিং প্রতিষ্ঠানে কোচিং করার চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে দু-একজন। পরীক্ষার আগের রাতে
পাঁচ লাখ বা তার চেয়েও বেশি টাকা নিয়ে মাত্র কয়েকজন ‘সৌভাগ্যবান’ পরীক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টারের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয়, মা-বাবার
সঙ্গেও ফোনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। সারা রাত ভাগ্যবান পরীক্ষার্থীরা ওই সব প্রশ্নপত্র সলভ করেন এবং পরদিন ওখান থেকেই সরাসরি তাদের পরীক্ষার হলে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব নানা বর্ণনা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে প্রশ্ন করি, তারা কি লাভবান হয়েছেন কোচিং সেন্টারে গিয়ে? মিশ্র উত্তর পাই। প্রায় সবাই স্বীকার করেছেন, নিজেরাই যে পড়াটি তৈরি করতে পারবেন সেই ভরসাটি চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে তাদের।
তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেও সিনিয়রদের নোট ফটোকপি করার ভরসা থেকে বের হতে পারে না। তবে কোচিং বা দলবদ্ধ প্রাইভেটে না গিয়েও পারে না, কারণ ক্লাস হয় ৪৫-৫০ মিনিটের। ক্লাসে ১০০ থেকে ১৫০ জন শিক্ষার্থীর নাম ডাকতে চলে যায় ১০-১৫ মিনিট। শিক্ষকের আসা-যাওয়ায় চলে যায় আরও ১০ মিনিট। বাকি রইল ২০ মিনিট, ক্লাস শুরু না হতেই ঘণ্টা বাজে। সিলেবাস শেষ হয় না। থাকে হরতাল, অন্যান্য ছুটি। অবধারিতভাবে স্কুল বন্ধ তখন কিন্তু কোচিং ক্লাস বন্ধ হয় না—স্কুলে না যাওয়া শিক্ষকেরাই কোচিং ক্লাসে উপস্থিত থাকেন। রয়েছে সাজেশনের প্রলোভন। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকেরা ক্লাসে সাজেশন দেন না, কোচিং ক্লাসে বা প্রাইভেট পড়ানোর মেয়াদ প্রায় শেষ হলে সাজেশন পায় তারা। ফলে তাদের উপায় কী? সৃজনশীল প্রশ্ন নামের জুজু রয়েছে। জিনিসটি ভালো, কিন্তু নিজেরা মাথা খাটিয়ে সলভ করবেন—নিজের প্রতি এমন আস্থা স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা অকপটে জানান, কেবল বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল-বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার সময়েই তাদের মুখস্থবিদ্যার বাইরে সত্যিকার পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। ফলে কোচিংনির্ভর, নিজের প্রতি আস্থাহীন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় জিপিএ-৫-এর ঘটনা যত বাড়ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার হারও ততই বাড়ছে।


পাঁচ.

ভর্তি পরীক্ষার বিষয়েও এক-আধটি পর্যবেক্ষণ থাকতেই পারে। বছর দুয়েক আগে আমি এক শিক্ষার্থীর কথা জানতাম যে ‘ও’ লেভেল শেষে আমেরিকান পদ্ধতিতে পড়েছে, SAT স্কোর ছিল ২৩৫০ (২৪০০-র মধ্যে), ইংরেজি, অ্যাডভান্সড ইংরেজি এবং স্প্যানিশ ভাষায় ছিল ৭ (৭-এর মধ্যে), এবং ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজিতে ছিল উঁচু স্কোর। ইংরেজি সাহিত্যে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও সাধারণ জ্ঞানে ১ নম্বর কম থাকায় সে ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তির জন্য বিবেচিত হয়নি। আইবিএতে প্রথম দিকে চান্স পেয়ে সেখানেই পড়ছে সে। ইংরেজি সাহিত্যে পড়ার জন্য সাধারণ জ্ঞানে ১ নম্বর ঘাটতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা যেতেই পারে। তবে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাপদ্ধতিকে দায়ী করেছেন, সেটি দুঃখজনক। স্রেফ পাস-ফেলের এহেন বিপর্যয় যেসব কারণে ঘটেছে, সেসব কারণ রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় করা কাঙ্ক্ষিত নয়।


ছয়.

কিছু কিছু প্রমাণ ‘রটনা’কে প্রতিষ্ঠিত করে। শিক্ষা নিয়ে আন্তরিকভাবে ভাবেন এমন কিছু ‘দুর্মুখ’ যখন বলছিলেন শিক্ষা নামের ‘পাখিটি মরিয়া যাইতেছে’ তখন আমরা কর্ণপাত করিনি। আজ যখন সত্যিই ‘পাখিটি মরিয়াছে’ মর্মে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তখন কে দায়ী সেই রাজনৈতিক তর্কে যাওয়ার চেয়ে দলমত-প্রতিষ্ঠান-নির্বিশেষে কেন পাখিটি মারা যাচ্ছে এবং কীভাবে এই ক্রমাগত মৃত্যুকে রোধ করা যায়, জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করে সেই সমাধানেই নিয়োজিত হোক আমাদের সব চেষ্টা।

ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।