সবার মুখ বন্ধ করলে সরকারের বিপদ হতে পারে

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের (২০০৬) খসড়া প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। সম্প্রতি এই আইনের আওতায় প্রথমবারের মতো এক ব্যক্তি দণ্ডিত হয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম আলোর সঙ্গে তাঁর এই আলাপচারিতা।

তানজিব উল আলম
তানজিব উল আলম

প্রথম আলো : তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায় সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রথমবারের মতো এক ব্যক্তি দণ্ডিত হলেন। খুলনার দাকোপের তন্ময় মল্লিক নামের ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গান রচনা করে পেনড্রাইভের মাধ্যমে প্রচার করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। এখন এই ঘটনায় আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

তানজিব উল আলম : খবরটি জানার পর তাৎক্ষণিকভাবে আমার যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা হলো এই ব্যক্তির লঘুপাপে গুরুদণ্ড হয়েছে। ভেবে দেখা যাক, এ ধরনের অপরাধের জন্য বাংলাদেশের অন্যান্য প্রচলিত আইনে কী শাস্তি হতে পারত। যদি কারও অবমাননা বা সম্মানহানি করা হয়ে থাকে, তাহলে এ ব্যাপারে ফৌজদারি কার্যবিধিতে যে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা আছে, সেটা হলো দুই বছরের কারাদণ্ড, তার বেশি নয়। যদি এমন হয় যে তিনি হয়তো অপরাধটি ইচ্ছাকৃতভাবে করেননি, বা করলেও এই মাত্রার ক্ষতি করার কথা ছিল না, যে মাত্রার ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে, তাহলে তাঁর অপরাধের মাত্রার বিবেচনায় শাস্তি কমও হতে পারত। কিন্তু যেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এটা করেছেন ইলেকট্রনিক বিন্যাসের মাধ্যমে, তাই তথ্যপ্রযুক্তি আইন অনুযায়ী তাঁর সর্বনিম্ন সাজা সাত বছরই দিতে হয়েছে।

প্রথম আলো : এখানে বিচারকের অন্য কোনো উপায় ছিল না?
তানজিব উল আলম : ছিল না, কারণ বিচারকের জন্য বিশেষ বিবেচনার কোনো ব্যবস্থা এই আইনে রাখা হয়নি।

প্রথম আলো : অর্থাৎ প্রথম দণ্ডেই প্রমাণিত হলো, তথ্যপ্রযুক্তি আইন কত বিপজ্জনক একটি আইন?

তানজিব উল আলম : এই আইনকে কালাকানুন বলা হচ্ছে এ কারণেই। অপরাধের মাত্রাভেদে শাস্তির যে তারতম্য হওয়া উচিত, সে রকম কোনো ব্যবস্থা এই আইনে রাখা হয়নি। এখানে লঘুপাপে গুরুদণ্ডের একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে দেশের সমগ্র জনগণের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সেটা এ রকম যে একজনের তো শাস্তি হয়ে গেল, এ ধরনের একটা ঘটনা নিদর্শন বা প্রমাণ হিসেবে থাকল যে রাষ্ট্রের মনোভাব নিপীড়নমূলক। কিন্তু রাষ্ট্রকে মানুষ নিপীড়নমূলক ভূমিকায় বিবেচনা করুক, সেটা কেউ চায় না। আমার ধারণা, বর্তমান সরকারও চায়নি এই আইনের মাধ্যমে জনগণ সরকারকে নিপীড়নমূলক ভূমিকায় বিবেচনা করুক।

প্রথম আলো : একদম সাদা চোখে, এ ধরনের কোনো আইন কি নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ?
তানজিব উল আলম : বাংলাদেশের সংবিধানে যেসব মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে যদি মিলিয়ে দেখা হয়, তাহলে যে কেউ বলবে যে এ ধরনের আইন মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে যে বাক্স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, সেই অধিকার কিন্তু নিরঙ্কুশ নয়, সেটা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে বলে সংবিধানে বলা হয়েছে। কোন আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, যে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে সে আইন কী ধরনের হওয়া উচিত—এ ব্যাপারে অনেক আইনি মত ও ব্যাখ্যা আছে। বিভিন্ন দেশে এ ব্যাপারে আদালতের অনেক রায় রয়েছে। এ ব্যাপারে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রধান মত বা দৃষ্টিভঙ্গি এ রকম যে বাক্স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত যেসব বিধান আছে এবং মৌলিক অধিকারকে কোনোভাবে খণ্ডিত করে—এ ধরনের আইন-বিধান যখন ব্যাখ্যা করা হয়, তখন ব্যাখ্যাটা এমনভাবে করা হয়, যাতে মানুষের মৌলিক অধিকার যতটা সম্ভব ফিরিয়ে দেওয়া যায়, যেন তা খর্ব বা খণ্ডিত না হয়। চেষ্টা থাকে এমনভাবে আইন প্রয়োগ করা, যাতে মানুষ তার বাক্স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করতে পারে।
প্রথম আলো : আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি আইন তো তার উল্টো ব্যবস্থা করেছে...
তানজিব উল আলম : আসলে আমরা যদি এমন আইন প্রণয়ন করি, যার ফলে মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হচ্ছে, তাহলে কিন্তু বলা যাবে না যে এই আইনটা আদৌ মানুষের জন্য করা হয়েছে। দেখুন, আমরা বলি যে ইলেকট্রনিক যুগে আমাদের অগ্রগতি হচ্ছে, জাতি হিসেবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। যেখানে মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে মানহানির সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড, সেখানে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে একই অপরাধের ন্যূনতম বা সর্বনিম্ন শাস্তির আইন আমরা কীভাবে করি? এটা তো অগ্রগতির লক্ষণ নয়, এটা বরং পিছিয়ে যাওয়ার লক্ষণ। আমরা একটা অত্যন্ত কঠোর আইন করে মানুষকে অবদমনের পথে নিয়ে যাচ্ছি। কোনো মুক্ত সমাজে এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না।
প্রথম আলো : তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সর্বজনীন বিরূপ প্রভাবের পাশাপাশি পেশাদারি সংবাদমাধ্যম ও ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর প্রভাবও কি ক্ষতিকর হতে পারে?
তানজিব উল আলম : নিশ্চয়ই। প্রথম দণ্ডের মধ্য দিয়ে যে উদাহরণ সৃষ্টি হলো, সেটা সংবাদমাধ্যমের জন্য আরও বেশি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এই অপরাধের জন্য এত বড় শাস্তি হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। আপনি একজন ব্যক্তির জীবন থেকে সাতটি বছর কেড়ে নিচ্ছেন। কিসের জন্য? তাঁর অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী এত বড় শাস্তি কি তাঁর প্রাপ্য হওয়া উচিত? অবশ্যই না। এর ফলে সমাজে যাঁরা বাক্স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করেন, তাঁদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হচ্ছে। বাক্ ও মতপ্রকাশের সঙ্গে যাঁরা খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত, তাঁদের মধ্যে সবার আগে আসবে সংবাদমাধ্যমের কথা। সাংবাদিকদের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গেই এটা সম্পৃক্ত। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ফলে তাঁদের জন্য খুবই ভীতিকর একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং এর ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে সেলফ-সেন্সরশিপের প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। সংবাদমাধ্যমের জন্য এ রকম ভীতিকর পরিবেশ কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য কাম্য হতে পারে না।
প্রথম আলো : মুদ্রণভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের যে সুরক্ষা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন আইনের কারণে আছে, সেটাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
তানজিব উল আলম : প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রেরই অনলাইন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সুতরাং এখন আর তাদের সুরক্ষার ব্যাপারটা সেভাবে থাকছে না, কারণ মুদ্রিত সংস্করণে প্রকাশের কারণে গুরুদণ্ড না হলেও একই বিষয় অলনাইন সংস্করণে প্রকাশের কারণে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায় পড়ে যাবে এবং লঘুপাপে গুরুদণ্ড হয়ে যেতে পারে। এভাবে ভীতিকর পরিবেশটা সৃষ্টি হচ্ছে পুরো সংবাদমাধ্যমের জন্যই। আর ইন্টারনেটের কারণে নাগরিক পর্যায়ে মতামত প্রকাশের যে অবাধ সুযোগ হয়েছে, সেটাও এ আইনের কারণে খর্বিত হবে। ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারও জন্য মানহানিকর কিছু প্রকাশ করার দায়ে সর্বনিম্ন সাত বছর আর সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের আইন পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলাই বাহুল্য, পার্শ্ববর্তী ভারতেও অনলাইনভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপারে বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আর আমাদের দেশে উল্টা আইন করা হয়েছে। আমি মনে করি, তথ্যপ্রযুক্তি আইন অবশ্যই সংশোধন করা উচিত।
প্রথম আলো : প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাক্ট সংশোধন করে জেলা প্রশাসকদের সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করার ক্ষমতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে—এ রকম খবর বেরিয়েছিল। তারপর বেসরকারি বেতার-টিভির জন্য সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো, যেটা এই মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করবে বলে প্রবল আপত্তি উঠেছে। অতি সম্প্রতি প্রেস কাউন্সিল আইনও সংশোধন করে সাংবাদিকদের পরীক্ষার মাধ্যমে সনদ নিতে হবে—এ রকম বিধানসহ নিবর্তনমূলক বিধান করার উদ্যোগের খবর বেরোল। অবশ্য প্রতিবাদের মুখে সেটা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, মুদ্রণ, সম্প্রচার ও অনলাইন—তিনটি মাধ্যমকেই কালাকানুন দিয়ে দমন করার প্রবণতা সরকারের মধ্যে কাজ করছে। আপনার কী পর্যবেক্ষণ?
তানজিব উল আলম : সংবাদমাধ্যম-সম্পর্কিত যেসব আইন আগে থেকে প্রচলিত আছে, সেগুলো করা হয়েছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে। আইন-বিধান সংশোধন বা যুগোপযোগী করার প্রশ্ন বা প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তখনই, যখন মনে হয় যে বর্তমান আইন সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু বর্তমান সরকার যে মানসিকতা থেকে আইন-বিধানগুলো সংশোধন করার কথা বলছে, সেটা সংবাদমাধ্যমের জন্য সহায়ক বলে আমার মনে হয় না। বরং উল্টো মনে হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু গতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সংবাদমাধ্যম খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই আমার মনে হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে সরকার ভুল করছে। সংবাদমাধ্যমকে সহযোগী হিসেবে দেখাই সরকারের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
প্রথম আলো : সংবাদমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা বা তাকে দমন করার মানসিকতার সঙ্গে কি ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের একটা সম্পর্ক থেকে থাকতে পারে? সরকারের এই দমনমূলক প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে কি এই কারণে যে তার যথেষ্ট স্বীকৃত ম্যান্ডেট নেই?
তানজিব উল আলম : আমার মনে হচ্ছে, সরকার ভাবছে বিরোধী দলগুলো তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের কারণে তাদের ভুলত্রুটি, অনিয়ম-দুর্নীতি ইত্যাদি প্রকাশ পাচ্ছে। তাই তারা মনে করছে, এখন আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদমাধ্যম, তাকে যদি আমরা দমিয়ে রাখতে পারি, তাহলে আমাদের আর কোনো ভয় নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, সরকারের এটা ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। সরকার যদি সবার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করে, তাহলে শেষ পর্যন্ত তার নিজেরই বিপদ হতে পারে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
তানজিব উল আলম : ধন্যবাদ।