তাহলে বিচার হবে কার?

২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১২ সাল। বৌদ্ধবিহার, পুরাকীর্তি, সভ্যতা এবং ঐতিহ্যের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছে বৌদ্ধপল্লি। কীভাবে শুরু হলো, কেন শুরু হলো এবং কীভাবে শেষ হলো, তা গণমাধ্যমের বদৌলতে সবাই জেনেছেন। এর পুনরাবৃত্তি চাই না। অন্য সবার মতো সেই দিনের ঘটনার আমিও একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী। ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। রামুবাসী ঘটনার দুই বছর পূর্তি পালন করছে। তবে পূর্তি আনন্দের নয়, এই পূর্তি বেদনার।
এই দুই বছরে হামলার পর পর আক্রান্তদের জন্য নিরাপত্তা জোরদার, ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলোর পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার, আক্রান্ত এলাকাগুলোতে প্রশাসনিক যোগাযোগ ও তৎপরতা বৃদ্ধিসহ ইতিবাচক এবং মানবিক অনেক কিছু করা হয়েছে। সরকার এ ক্ষেত্রে পূর্ণ উদারতা দেখিয়েছে। সরকারের সহযোগিতা এখনো থেমে নেই। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সরকারের মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যে সংখ্যক রামু পরিদর্শনে এসেছেন, তাঁদের নাম এখানে উল্লেখ করতে গেলে আর কিছুই লেখার সুযোগ থাকবে না।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ও উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা, পুলিশের আইজিপি ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, র্যাবের মহাপরিচালক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাসহ গোয়েন্দা বিভাগসমূহের বড় কর্মকর্তাদের কেউ বাদ পড়েননি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একে একে দুবার রামু এসেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তাঁর দলের সিনিয়র নেতৃত্ব সবাই রামু পরিদর্শন করেছেন, আক্রান্তদের অভয় দিয়েছেন, সমবেদনা জানিয়েছেন। দেশবাসী, সুধী সমাজ, লেখক, বুদ্ধিজীবী তথা জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দলমত-নির্বিশেষে আক্রান্তদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। গণমাধ্যমের ভূমিকা এক অতুলনীয় ব্যাপার। কার কথা রেখে কার কথা বলব জানি না। আমাকে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করেন, আক্রান্তদের পাশে কে কে দাঁড়িয়েছেন? আমার পাল্টা প্রশ্ন, দাঁড়াননি কে? সবার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা রইল। শ্রদ্ধা জানাই দেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতি।
বিচার–প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি, অভিযোগপত্র নিয়ে প্রশ্ন

দুই.
হামলার বিপরীতে মামলা, গ্রেপ্তার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল অনেক কিছুই হয়েছে। দাখিলকৃত প্রতিবেদনের ওপর শুনানি এবং তৎপরবর্তী বিচার এবং রায় প্রদান এখনো হয়নি। শাস্তির কথা আরও অনেক পরে আসছে।
ঘটনার পরবর্তী মোট ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় ১৫ হাজারের চেয়েও বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। বিভিন্নভাবে ছাড়া পেয়েছে অধিকাংশ। আটককৃতদের মধ্যে তালিকাভুক্ত বা এজাহারভুক্ত আসামির চেয়ে সন্দেহভাজন আসামির সংখ্যাই বেশি। বিচার এবং রায় ঘোষণা এখনো হয়নি। ঘটনার পর পর যখন ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হলো, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক এবং ক্ষুব্ধ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন। নইলে অত সহজে দমে যেতেন বলে মনে হয় না। তবে বিচারের নামে দীর্ঘ ভোগান্তি এবং হয়রানিও কাম্য নয়। নির্দোষ কেউ ভোগান্তি এবং হয়রানির শিকার হলে তা সম্প্রীতির জন্য মারাত্মক ÿক্ষতিকর হবে।

তিন.
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এই চার দশক সময়ের মধ্যে অনেক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। দুঃখের বিষয় হলো, এমন ঘটনা যাতে না ঘটে তার বিপরীতে রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা বা আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যত বড় এবং যতবার ঘটনা ঘটেছে, ততবার রাজনৈতিক দলগুলো ব্লেম গেম খেলেছে। তাদের এই খেলার কারণে ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় না। রামু সহিংসতার ক্ষেত্রে যা হলো, ঘটনার পরের দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ঘটনাস্থলে এলেন, দেখলেন এবং আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বললেন। কিন্তু ঢাকায় অবতরণ করে গণমাধ্যমকে বললেন, ‘ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় বিএনপির সাংসদ লুৎফুর রহমান কাজলের ইন্ধন এবং সম্পৃক্ততা আছে।’ তাহলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র একজন সাংসদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারল না কেন? তিনি টিভি চ্যানেলের এক টক শোতে বললেন রামু সহিংসতা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। একাত্তরের মুক্তির সংগ্রামকে কেউ কেউ বলেন গন্ডগোল, এতে কি মুক্তিযুদ্ধকে উপহাস করা হয় না। তিনি আবার এও বললেন, রামুর ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ অক্টোবর, ২০১২ এলেন। রামুর ঘটনায় তিনি বিব্রত বোধ করেছেন, সেটা বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রায় একই কথা তিনি খিজারী হাইস্কুল মাঠে আয়োজিত সম্প্রীতি সমাবেশে বললেন। তাঁর এমন বক্তব্য অপরাধীদের দলীয় পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে সুযোগ নেওয়ার মতো একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেল। পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ব্লেম গেম পুরোদমে শুরু হয়ে গেল।
১০ নভেম্বর ২০১২ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রামু পরিদর্শনে এলেন। আয়োজিত সম্প্রীতি সমাবেশে তিনিও সাফ জানিয়ে দিলেন রামুর ঘটনায় বিএনপি জড়িত নয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাল রামু ঘটনায় জামায়াতের কেউ জড়িত নয়। একই কথা শিবিরও বলল। কেবল রোহিঙ্গারাই বিবৃতি দিতে পারেনি। কারণ, অবৈধ নাগরিক হিসেবে তারা প্রকাশ্যে আসতে পারে না। তাহলে রামু সহিংসতায় সম্পৃক্ত কারা? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পরিকল্পনার ছক কারা, কোথায়, কখন ও কীভাবে করেছিল, তা নির্ধারণ করা যায়নি। তাহলে বিচার হবে কার? এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা রোধ করা কি আদৌ সম্ভব? আমি মনে করি রামু সহিংসতা দলীয় মনোভাব থেকে হয়নি।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: সহকারী পরিচালক, সীমা বৌদ্ধ বিহার, রামু।