সংসদীয় সরকারের রীতিনীতিও বিসর্জন?

নির্বাচন না দিয়ে নয়, নির্বাচন দিয়েই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলনরত দেশগুলোর সংবিধানে সরকারের একটি মেয়াদ লেখা থাকে বটে। কিন্তু সংসদীয় সরকারের প্রধান বলতে পারেন না যে তিনি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এই লেখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ ঘোষণাকে আমরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আলোকেই বুঝতে চাই। বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের শতাব্দীপ্রাচীন রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে চলতে পারে না। এই রীতিনীতি কী?
প্রথম শর্ত হলো, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল থাকতে হবে। শুধু সংখ্যার বিচারে যে বিরোধী দল মাপা যায় না, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিরোধী দল নিয়ে প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। বিরোধী দল ছাড়া একটি আধুনিক সরকারব্যবস্থা কল্পনা করা যায় না। সে কারণে ভারতের লোকসভার স্পিকার যখন রুলিং দিলেন যে, ১০ শতাংশ ভোট না পেলে তাকে বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়া যাবে না। তাঁর রুলিং সংবিধান ও কার্যপ্রণালিসম্মত হয়নি, সেই দাবি কিন্তু কেউ তুলতে পারেননি। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও স্পিকারের রুলিংকে প্রশ্নবিদ্ধ করেননি। স্পিকার যুক্তি দিয়েছিলেন, লোকসভায় বিরোধী দল আছে। কিন্তু লিডার অব দি অপজিশন নেই। তাঁর অবস্থান আইনসম্মত। কিন্তু আধুনিক সরকার পরিচালনার দণ্ড যাঁর হাতে, সেই নরেন্দ্র মোদিকেই উত্তর দিতে বলেছেন যে বিরোধী দল থাকবে কি না। ভারত নিশ্চয়ই ১৯৬৯ সালের আগে যাবে না। তার প্রথম দুই দশক তারা বিরোধী দল ছাড়াই চলেছে।
আমাদের মন্ত্রীরা যখন বলেন, আমরা সংবিধান অনুযায়ী চলি, এর মানে হতে পারে, আমরা সংবিধানের অক্ষর ধরে চলি। একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন হলো সাংবিধানিকতাবাদ প্রতিষ্ঠা করা। যার মধ্যে সংবিধানের চেতনা ও চেতনাজাত সংস্কৃতি একসঙ্গে ধারণ করে। বিরোধী দলের নেতাকে কেবল সংখ্যার জোরে গণনা করে নরেন্দ্র মোদি আসলে বলছেন, ‘আমি সংবিধান অনুযায়ী চলি।’ সেখানে সাংবিধানিকতাবাদ মার খাচ্ছে। লোকসভার স্পিকার ভারতীয় জনগণকে সেই সত্য উচ্চারণ করাতে অপারগ থেকেছেন। বর্তমানে বিশ্বের অন্তত ২৮টি সংবিধানে লিডার অব দি অপজিশন শব্দটি রয়েছে। মোদি সরকার এবং আমাদের সরকার উভয়ে লিটল ভুটানের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। ২০০৮ সালের ভুটানি সংবিধানে পাঁচটি স্থানে ওই শব্দ ব্যবহার করেছে। সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগে সুপারিশে বিরোধী দলের নেতাকে রাখা হয়েছে। নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সংবিধানেও বিরোধী দলের নেতার স্বীকৃতি আছে। সর্বোপরি নেলসন ম্যান্ডেলা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেটা আদর্শস্থানীয়। দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদ বলেছে, কার্যপ্রণালি বিধিতে সংসদের বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতাকে বিরোধী দলের নেতা বলতে হবে। ভারতের চেয়ে ম্যান্ডেলা অগ্রসর। অবশ্য এ কথাও বলা দরকার যে কোনো কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক চাইলে সংবিধানের এই রক্ষাকবচ এবং সংসদীয় সুপ্রতিষ্ঠিত রীতিনীতিকেও অগ্রাহ্য করতে পারেন। আজকের বাংলাদেশ সম্ভবত তারই দুর্ভাগ্যজনক দৃষ্টান্ত। রওশন এরশাদের বিরোধী দলের নেতার পদ অলংকরণ এবং তাঁর স্বামী জেনারেল এরশাদের বিশেষ দূত থাকা এবং তাঁদের দলের আরও কয়েকজনের মন্ত্রিসভায় থেকে ‘বিরোধী দলের নেতার’ শূন্যস্থান পূরণ সংসদীয় রীতিনীতির জন্য এক বিরাট লজ্জা।
আওয়ামী লীগ আগামী পাঁচ বছর শাসনের জন্য ১৯৭৯ সালের সংসদ এবং ১৯৮৮ সালের মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ সংসদ নির্বাচনের দোহাই দিতে পারবে। কিন্তু তারা তলিয়ে দেখেন না, এই তুলনা করে তাঁরা নিজেদের ওই দুটি দলের সমগোত্রীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা হুঁশ ফিরলে দেখবেন, সংসদীয় রীতিনীতির যে সর্বনাশ তাঁরা করছেন, সেটা ঠিক এভাবে তাঁদের আগে কেউ পারেননি। ব্যক্তি বা কতিপয়ের শাসন একটি জাতি ধারণ করতে পারে। কিন্তু তার মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং তার মৌলিক রীতিনীতিসহ সব নষ্ট করে দিলে তারা দাঁড়াবে কোথায়? আগামী পাঁচ বছর নির্বাচন হবে না, এর মানে আগামী পাঁচ বছর আমাদের জাতির সাবেক ফার্স্ট লেডির অশোভন ভূমিকাও হজম করতে হবে।
অন্যদিকে বিএনপি ও তার মিত্ররা এখনই কি মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত? ৩০০ আসনে মনোনয়ন দিতে তাদের কালবিলম্ব ঘটবে না, তাদের প্রস্তুতি কি এতটাই নিরেট? বিএনপি নেত্রী তাঁর দলের মহাসচিবকেই ভারবাহীর অপবাদমুক্ত করতে পারলেন না। তিনি বলেছেন, হয় সংলাপ না হয় গদি ছাড়ুন। সংলাপে তাঁর কি প্রস্তুতি আছে? ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো আবছা রূপরেখাও তাঁর কাছে আছে, এমন কোনো খবর তো পাই না।
সরকারপদ্ধতি যা-ই হোক, আধুনিক শাসনব্যবস্থার পয়লা শর্ত হলো তাকে সর্বাবস্থায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং জবাবদিহির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত চট্টগ্রামে বলেছেন, ‘বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে ভুল করেছে। তাকে মাশুল দিতে হবে।’ কথাটি আংশিক সত্য। কারণ, প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে সংসদ গঠিত হওয়ার মাশুল আওয়ামী লীগকেও দিতে হবে।
তবে তারা যদি সেটা স্বীকার করতেও কুণ্ঠিত থাকে, তখন আবার এই অভিযোগ দলের ভেতরেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে যে তারা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকতে আগ্রহী। খালেদা জিয়া বলেছেন, ক্ষমতার প্রতি তাঁর আগ্রহ নেই। সুশাসন ও গণতন্ত্র দিতে চান তিনি। বিএনপির নেত্রীর এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তির অসারতা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না। আওয়ামী লীগ এখন বিরোধী দল এবং সংসদে বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা নিয়ে কোনো বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি করতেও কুণ্ঠিত। বাংলাদেশের পার্লামেন্ট কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কেউ যদি উৎকৃষ্ট উদ্ধৃতি সংগ্রহ করতে চান, তাহলে সেটা খুঁজে পেতে আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচন–পরবর্তী এক বছরের পঞ্চম সংসদের আলোচনার বিবরণী ও পত্রপত্রিকার ওপর দ্বারস্থ হতে পারেন। তাঁদের সেই কথা অনুযায়ী, এখন যদি আমরা জাতীয় পার্টিকে ভূমিকা পালন করতে বলি, তাহলে সেটা কেন ষড়যন্ত্র বলে প্রত্যাখ্যাত হবে? নির্বাচনী গলদ হজম করার চেয়ে এখন জাতীয় পার্টির সার্কাস হজম করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে সংকট আরও গভীরে যাচ্ছে। কারণ, কোনো লাজলজ্জা ছাড়াই রাষ্ট্রব্যবস্থার পদ্ধতিগত বিকৃতকরণ ঘটছে। সংবিধানে সংসদ সম্পর্কে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠক হতে সংসদ ৫ বছর থাকবে।’ এটা এভাবে লেখার কারণ হলো, এটা পাঁচ বছরের কোনো ইজারাদারি প্রথা নয়। একটি সংসদীয় সরকার ২৪ ঘণ্টা নতুন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকবে। একটি বিলের ওপরও সরকারের পরিবর্তন হতে পারে। অবাস্তব? কিন্তু এর যুক্তির জায়গাটা অন্তত মানতে হবে।
গণতন্ত্র আছে বলেই আজ ‘খুনি জিয়া দল’ ক্ষমতায় যেতে পারার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। কিন্তু তাই বলে গণতন্ত্র পরিহার কারও কাম্য হওয়ার নয়। সংসদ সরকারের সম্পূর্ণ দখলে। সংসদের বাইরে? কিছু দরজা তো খোলা রাখতে হবে, যেমনটা অনেক আধা গণতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে থাকে। বিএনপিকে সভা-সমাবেশ ও প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সব কটা দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলে ভেতরের মানুষেরই তো দমবন্ধ হওয়ার দশা হবে! সেই স্বার্থেও সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতির অলিন্দগুলো যতটা সম্ভব খোলা রাখা দরকার।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]