জিপিএ-৫-এর বাহুল্য ও শিক্ষার মানাবনয়ন

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

প্রশ্ন আসবে লেখাপড়ার মান সম্পর্কেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নেয় ছয় হাজার শিক্ষার্থীর, ভর্তির জন্য বাছাই করতে। এখানে ৪০ হাজার পাস করলেও মেধা অনুসারেই ভর্তির সুযোগ মিলবে। তবে ন্যূনতম পাস নম্বর পাবেন না কেন শতকরা ৮০-৯০ ভাগ পরীক্ষার্থী, এ প্রশ্ন অনেকের। শুধু এবার নয়, এর আগের কয়েকটি বছরেও তা-ই ঘটেছে। ‘খ’ ইউনিটে শতকরা ৯০ ভাগ অনুত্তীর্ণ হওয়ায় হইচই বেশি বাধল। ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন সাকল্যে দুজন। অন্য ইউনিটগুলোর পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম। যেমন ‘ক’ আর ‘গ’ ইউনিটে যথাক্রমে ৭৯ ও ৮০ শতাংশ অনুত্তীর্ণ হয়েছে।

আলোচ্য গোলটেবিল বৈঠকটির পরদিন শিক্ষামন্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাপদ্ধতিকে ত্রুটিপূর্ণ বলে এর সমালোচনা করেছেন। কোনো পদ্ধতিই হয়তো শতভাগ ত্রুটিমুক্ত নয়। কিছু ত্রুটি আলোচ্য ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় থাকতে পারে। তবে গেল বছরগুলোতেও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের এ ধরনের নাকাল হওয়ার খবর এতটা প্রচার না হলেও মোটামুটি একই রূপ ছিল। তখন কিন্তু এ ভর্তিপদ্ধতি নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে জিপিএ-৫-এর ক্রমবর্ধমান হার সবার নজরে আসছে। এতে কারও ঈর্ষান্বিত হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু তাঁরা যখন পরবর্তী প্রতিযোগিতায় এভাবে কাবু হন, তখন সবাইকে সন্ধিহান করে। প্রশ্ন জাগে, কোনটি ত্রুটিপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা? নাকি বর্তমান মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা ও মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া?

জিপিএ-৫ প্রতি বিষয়ে শতকরা ন্যূনপক্ষে ৮০ নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীরা অর্জন করেন। গ্রেড পয়েন্ট চালু করার আগে প্রতি বিষয়ে লেটার মার্ক পাওয়ার মতো। বিরল হলেও তা কেউ কেউ পেতেন। এখনো এ ধরনের ছাত্রছাত্রী আছেন। এমনকি সংখ্যায় তাঁরা আগের চেয়ে বেশিই হবেন। বলা হয়, পরীক্ষাপদ্ধতির জন্য পাসের হার ও গ্রেড পয়েন্ট বাড়ছে। সনাতনী পদ্ধতি ভেঙে এখন ভিন্ন একটি পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে। টিকচিহ্ন ও বৃত্ত ভরাট করায় রয়েছে মোট নম্বরের প্রায় অর্ধেক। ব্যাপক আলোচনায় রয়েছে পরীক্ষকদের লিখিত অংশেও উদারভাবে নম্বর দিতে বলা হয়। এতেই আসছে চমকপ্রদ ফলাফল। সবাই অতি আনন্দিত হতেন যদি তাঁদের পড়াশোনার মানও হতো চমকপ্রদ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। জিপিএ-৫ পাওয়া একজন শিক্ষার্থীকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাঁদের মান প্রতি বিষয়ে লেটার নম্বর পাওয়া না হোক, আগেকার প্রথম বিভাগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মতো হলেও এত কথা হতো না।

আসলে শিক্ষার পরিমণ্ডলে বর্তমানে এত কিছু ঘটছে, যা এসব আলোচনায়ও আসে না। সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিরাট একটি অংশ তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করছে। মাদ্রাসাশিক্ষাও চালু রয়েছে সমান্তরালভাবে। ইংরেজি মাধ্যম আর এসব মাদ্রাসায় শিক্ষারত রয়েছেন কয়েক লাখ ছেলেমেয়ে। মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক খুব শিথিল। যেসব মাদ্রাসা সরকারি সিলেবাস ও নিয়মকানুন অনুসরণ করে, তাদের সংখ্যাও অনেক। তাদের মূলধারার শিক্ষার সমপর্যায়ে ভুক্ত করা হয়েছে বটে। তবে প্রতিযোগিতায় অনেক পেছনেই থাকে। এমনকি বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে মাদ্রাসাগুলোর ছাত্র এমনকি অনেক শিক্ষক আরবিতে কথা বলতে পারেন না। অথচ তাঁরা সবাই আমাদের সমাজেরই অংশ। অন্যদের মতো তাঁদেরও শিক্ষার মানের সমভাবে উন্নতি না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জাতি। ইংরেজি মাধ্যমে যাঁরা পড়াশোনা করছেন, তাঁরা সম্ভব হলে বিদেশে পাড়ি দেন। অন্যদের গুটিকয় ব্যতীত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়নির্ভরই থাকতে হয়। সেখান থেকে অবশ্য মেলে একটি ভালো গ্রেড পয়েন্টের সনদ।

এবার যাঁরা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে জিপিএ-৫ পেলেন, তাঁরা ছাড়াও জিপিএ-২.৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাও স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনার দাবি রাখেন। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি উঁচু মানের কলেজেও তাঁদের অনেকের স্থান হবে না। তখন কাউকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা নিম্নমানের কলেজকে বেছে নিতে হবে। অবশ্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারও তাঁদের জন্য অনেকটা উন্মুক্ত। তবে প্রবেশ ফি অনেক বেশি। ভর্তি হলে সনদ অনেকটা নিশ্চিত। কিন্তু কর্মজীবনের জন্য তাঁরা কতটুকু তৈরি হলেন বা হবেন, এটা ভাবার সময় এসেছে।

আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেকের অজান্তেই গোড়ায় গলদ ঢুকে গেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এর সূচনা। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এসে পড়ছে এর প্রভাব। তা-ও মাধ্যমিক স্তরে ভালো গ্রেড পয়েন্ট অনেকে পান। ঠিক তেমনি উচ্চমাধ্যমিকে। মহানগর আর জেলা সদরগুলোর নামকরা কিছু স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মান বিবেচনায় নিয়ে গোটা দেশের
মান হিসাবে ধরলে বড় ধরনের ভুল করা হবে। প্রতারিত করব নিজেদের। এরই মাঝে আমরা অনেক ঠকেও স্বীকার করতে চাইছি না। মানবসম্পদ উন্নয়ন একটি জাতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনায় নিতে হয়। আমরা অবকাঠামো তৈরিসহ অনেক বিষয়ে এ লক্ষ্যে কিছু কাজ করেছি। কিন্তু মূলত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ, তাঁদের প্রশিক্ষণ ও তদারকিব্যবস্থার প্রতি এতটা জোর দেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের সিলেবাস ও মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ বললে অত্যুক্তি হবে না। দৃঢ়তার সঙ্গে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন না হওয়ার কথা নয়। ভাঙা ইমারতের ভিটায় নতুন নির্মাণের মনোবল এ জাতির আছে।

বর্তমান অবস্থায় একে অন্যকে দোষ দিতে থাকলে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে না। স্কুল-কলেজগুলোয় প্রকৃত জ্ঞানের অনুশীলন বর্জন করে পূর্ণ গ্রেড পয়েন্ট অর্জনের রাস্তা প্রসারিত থাকলে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বিষয়টির দিকে নজর আকর্ষণ করলে শিক্ষার্থীরা হতাশ না হয়ে নিজেদের দুর্বলতা দূর করতে সচেষ্টও হতে পারেন। এ ধরনের সমালোচনা তাঁদের এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার জন্যও হতে পারে কল্যাণকর। সাহসী শিক্ষামন্ত্রী বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তৈরি হবেন নতুন সংগ্রামের জন্য, এ প্রত্যাশা রইল।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।