বয়সজনিত রাজনৈতিক খুনসুটি!

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

সরকারের এসব পদস্থ আমলা এই জালিয়াতি করতে গেলেন কেন? এর উত্তর সম্ভবত একটাই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্রের ঘোষিত বিশেষ সুযোগ-সুবিধাগুলো করায়ত্ত করা। তার ফলে সচিবের মতো পদে আরও একটি বছর চাকরি বজায় রাখা এবং অবসর–পরবর্তী জীবনে নিজের ও পরিবার-পোষ্যদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়াও অন্য নানা কারণে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও এ ধরনের চালাকির ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে এখন এটি এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। কারণ, তাঁরা চাকরিতে ঢোকার সময় যে জালিয়াতি করেননি, সেটা করেছেন চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে। আমাদের সচিবেরাও হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁদের বয়স নিয়েও কোনো ঝামেলা হবে না। কিন্তু তাঁদের এই জালিয়াতি এখন এক জাতীয় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

বয়স চুরি নিয়ে বাঙালি পরিবারগুলোয় বিয়েশাদির আলোচনায় বয়সকেন্দ্রিক খুনসুটির চল এখন আর ততটা প্রকট নয়। শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্তদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষার প্রসার ঘটায় ছেলেমেয়েদের বয়সের ফারাক নিয়ে তেমন একটা সমস্যা হয় না। বয়স কমানোর প্রবণতা মানুষের স্বভাবজাত কি না, সেটা অবশ্য ভালো বলতে পারবেন মনোবিজ্ঞানীরা। তবে বৈশ্বিক পরিসরে বেসামরিক আমলাদের মধ্যে বয়স কমানোর চেষ্টার কথা তেমন একটা শোনা না গেলেও ক্রীড়াঙ্গনে এই কৌশল অনুসরণের দৃষ্টান্ত অনেক।

ক্রীড়াঙ্গনে বয়স চুরির বিতর্কে সাম্প্রতিককালে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে চীন, বিশেষ করে জিমন্যাস্টিকসে। আর ফুটবলের জগতে নাইজেরিয়া। ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিক এবং ২০০৮-এর বেইজিং অলিম্পিকে মেয়েদের জিমন্যাস্টিকসে পদকজয়ী চীনা প্রতিযোগীদের কয়েকজনকে নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। সিডনিতে পদক পাওয়া ইয়াং ইউন কয়েক বছর পর এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন যে প্রতিযোগিতার জন্য ষোড়শী হওয়ার শর্ত থাকলেও তখন তিনি ছিলেন চতুর্দশী। বেইজিং অলিম্পিকে হি চেশিন ষোড়শী হিসেবে অংশ নিলেও অনলাইনে তাঁর বিভিন্ন নথি ফাঁস হওয়ায় দেখা যায়, তাঁর বয়স তখন ছিল ১৪। হি চেশিন ছাড়াও বেইজিং অলিম্পিকে আরও দুজন চীনা নারী জিমন্যাস্টের বয়স নিয়ে কানাঘুষা চলে।

আর নাইজেরিয়ান ফুটবলাররা তো এ বিষয়ে কিংবদন্তির খেতাব পেতে পারেন। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বে খেলেছিলেন জে জে ওকোচা। ফুটবলার হিসেবে তাঁর পুরো পেশাদার জীবনটা কেটেছে আসল বয়স ১০ বছর কমিয়ে। এ বিষয়ে প্রথম হাটে হাঁড়ি ভেঙেছিল লাগোস গার্ডিয়ান। ২০০৮ সালে আফ্রিকা কাপ জিততে না পারার পর ওই পত্রিকাকে একটি নাইজেরীয় ক্লাবের কোচ খেলোয়াড়দের বয়স চুরির তথ্য জানিয়ে বলেন যে ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে বুড়োদের মাঠে নামানোয় তারা জাম্বিয়া ও বেনিনের তরুণ খেলোয়াড়দের ক্ষিপ্রতা ও গতির সামনে টিকতে পারেনি। টিমের ডাক্তারও ওই একই কথা বলেন। তারও আগে, ১৯৮৮ সালের অলিম্পিকে কয়েকজন ফুটবলারের জন্মতারিখ নিয়ে জালিয়াতি ধরা পড়ার পর ফিফা দুই বছরের জন্য নাইজেরিয়াকে সব আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিষিদ্ধ করেছিল (সূত্র: গা‌র্ডিয়ান, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১০)। এসব সচিব মহোদয় অলিম্পিক না হলেও ক্ষমতার দৌড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবং চীনের মতোই তাঁরা সরকারের শীর্ষস্থানীয়ের আস্থাভাজন। সুতরাং সনদ বাতিলের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের কেউ কেউ যে জাতিসংঘে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করতে বিমানে চড়েছেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

আমাদের দেশেও স্কুল-কলেজের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় এ রকম বয়স চুরির অভিযোগ ওঠে এবং তাতে শিক্ষক বা স্কুল কর্তৃপক্ষের একধরনের সংশ্লিষ্টতার কথা শোনা যায়। আমাদের সমাজে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, এমনকি স্বেচ্ছাসেবার ক্ষেত্রেও অসাধুতার ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে অনেকে পাটিগণিত শিক্ষায় দুধে পানি মেশানোর উদাহরণ ব্যবহারকে দায়ী করে থাকেন। এসব সচিবের ক্ষেত্রে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়ায় বয়স চুরির অনুশীলনের সম্ভাবনা বোধ হয় উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

তবে ‘জালিয়াত সচিবেরা’ চাইলে সান্ত্বনাও খুঁজে পেতে পারেন প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ভারতের বর্তমান প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ভি কে সিং তাঁর চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য জন্মতারিখ নিয়ে আদালত পর্যন্ত দৌড়েছেন। সরকারি নথিতে তাঁর জন্মতারিখ ছিল দুটি—১৯৫০ ও ১৯৫১। সরকার প্রথমটি গ্রহণ করে তাঁকে অবসর দিতে চাইলে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। পরে তিনি কংগ্রেসবিরোধী হাওয়ায় তাল মিলিয়ে রাজনীতিতে যোগ দেন। জেনারেল সিংয়ের বয়স কমানোর চেষ্টাটি অবশ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন আরেক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাঠ। জেনারেল রাঠকে তাই এক দুর্নীতির মামলায় ফাঁসিয়ে দেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিং। ভারতীয় সেনাবাহিনীর আর্মড ফোর্সেস ট্রাইব্যুনাল ৬ সেপ্টেম্বর তাঁর রায়ে জেনারেল রাঠকে হয়রানির জন্য এক লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও আদেশ দিয়েছেন (আর্মি কোর্ট ইম্বারসমেন্ট ফর ফরমার আর্মি চিফ ভি কে সিং, এনডিটিভি, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৪)। বোঝাই যাচ্ছে, ক্ষমতা ও মর্যাদাপূর্ণ পদ ধরে রাখতে মানুষ কত দূর পর্যন্ত যেতে পারে। আবার রাজনীতির আশ্রয় যে কত নিরাপদ, এটি তারও এক চমকপ্রদ নজির।

এসব সচিবের বয়সজনিত বিতর্কে সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন খোলাখুলি উষ্মা বা ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজেরা খবর হয়েছেন। খবরের শিরোনামে জায়গা করে নেওয়ার বদলে তাঁরা নৈতিক অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রীকে একান্তে কোনো পরামর্শ দিয়েছেন কি না, তা অবশ্য খোলাসা করেননি। তাঁদের পরামর্শেও যে কোনো কাজ হতো, সে কথাও কেউ দিব্যি দিয়ে বলতে পারবেন না। জালিয়াতি ধরা পড়লেও ‘জালিয়াত’দের উদ্বিগ্ন না হওয়া অন্তত সেই ইঙ্গিতই দেয়। আর যদি সনদ বাতিলের পর চাকরিচ্যুতিও ঘটে, তাহলেও তাঁদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের পথ তো বন্ধ হবে না।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।