ভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র ও বিস্মৃত ১৯৭১

পাকিস্তানি বাহিনী ধর্ষণকে যুদ্ধকৌশলের অংশ করে নিয়েছিল
পাকিস্তানি বাহিনী ধর্ষণকে যুদ্ধকৌশলের অংশ করে নিয়েছিল

যৌন নির্যাতন, মূলত নারী ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের রেওয়াজ পুরোনো। মনোবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, ধর্ষণের সঙ্গে যৌন আনন্দের সম্পর্ক নেই, আছে ক্ষমতা প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দুর্বলের ওপর ক্ষমতা প্রদর্শনের উপায় হিসেবে ধর্ষণের ব্যবহার হয়ে এসেছে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে। বিশ্বযুদ্ধে তো বটেই, পরবর্তীকালে পৃথিবীর নানা আঞ্চলিক যুদ্ধ, স্থানীয় সশস্ত্র সংঘাতে ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিস্তর প্রমাণ আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা নারী ধর্ষণকে কীভাবে যুদ্ধকৌশলের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিল, তা বহুলভাবে আলোচিত। পররর্তীকালে বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, সুদান প্রভৃতি এলাকার সশস্ত্র সংঘাতের সময়ও ধর্ষণ হয়ে উঠেছিল এক মারাত্মক যুদ্ধাস্ত্র।
সম্প্রতি লন্ডনে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ধর্ষণ বন্ধের ডাক দিয়ে ব্রিটিশ সরকার একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ওই সম্মেলনে পৃথিবীর নানা দেশের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। অথচ যুদ্ধে ধর্ষণ বাংলাদেশে নেহাত কোনো অতীতের বিষয় নয়, এটা এই মুহূর্তেরও জীবন্ত এক প্রসঙ্গ। বাংলাদেশে যুদ্ধে ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া চলছে এই মুহূর্তে, অপরাধীদের সাজা হচ্ছে। কোনো কোনো সূত্রমতে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে যতসংখ্যক নারী ধর্ষিত হয়েছেন, তা ওপরে উল্লেখিত সব দেশের সংঘাতময় সময়ে ঘটিত ধর্ষণের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি। কিন্তু বাংলাদশের সেই অভিজ্ঞতা শোনার কথা সম্মেলনের আয়োজনকারীদের মনে পড়েনি। মাঝে পৃথিবীর গণহত্যাবিষয়ক কিছু একাডেমিক বই দেখছিলাম, যেগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের পাঠ্য। যেমন মার্টিন শয়ের লেখা ওয়ার অ্যান্ড জেনোসাইড: অর্গানাইজড কিলিং ইন মডার্ন সোসাইটি, ডোনাল্ড ব্লকসহ্যাম ও ডির্ক মোজেসের লেখা দি অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অব জেনোসাইড স্টাডিজ বা অ্যাডাম জোনসের জেনোসাইড: আ কমপ্রিহেনসিভ ইন্ট্রোডাকশন। এই বইগুলোয় নানা গণহত্যার কেস স্টাডি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোথাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার কোনো উল্লেখ নেই। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যতম গণহত্যাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঘটেছে বলেই দাবি রয়েছে।
ব্যাপার হচ্ছে, যুদ্ধবিষয়ক আন্তর্জাতিক একাডেমিক বা অ্যাকটিভিস্ট আলোচনার ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কোনো উপস্থিতি নেই। ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের কিছু না। কারণ, খোদ বাংলাদেশেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিকে বিতর্কিত করার যে উৎসব, তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গন এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহ যে হারিয়ে ফেলবে, তা বলাই বাহুল্য। তবে একটা জনপদের যৌথ স্মৃতিকে তো আর রাবার দিয়ে ঘষে মুছে ফেলা যায় না। তা নানাভাবে অঙ্কুরিত হতে থাকে। লন্ডনের সেই সম্মেলনেও স্বল্পসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশকে এই সম্মেলনে অন্তর্ভুক্ত না করার প্রতিবাদে মুখে কালো টেপ বেঁধে সম্মেলন চত্বরে প্রতিবাদ করেছেন। দ্য কনভারসেশন (২১ জুলাই, ২০১৪) পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছেন ব্রিটেনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নয়নিকা মুখার্জি, যিনি পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণা করেছেন বাংলাদেশের যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারী ও যুদ্ধশিশুদের ওপর।
নয়নিকা তাঁর লেখায় একটা বিশেষ ব্যাপারে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, যুদ্ধের পর পর ধর্ষিত নারীদের ব্যাপারে বাংলাদেশে যে ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছিল, তা পৃথিবীর আর কোনো দেশের যুদ্ধের ক্ষেত্রে ঘটেনি। যেমন প্রথমত, স্বাধীনতার পরপরই এই ধর্ষিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দেওয়া হয়েছিল। সেই নারীদের জীবনে এই খেতাবের প্রভাব কী হয়েছিল, সেটা নিয়ে পর্যালোচনা হতে পারে, কিন্তু এটা ছিল তাঁদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির একটা আনুষ্ঠানিক প্রকাশ। পৃথিবীর আর কোনো দেশে যুদ্ধে ধর্ষিত নারীদের এমন রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত, এই নারীদের জীবন ও স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গর্ভপাত’কে তখন আইনসিদ্ধ করা হয়েছিল বাংলাদেশে। ১৯৭২ সালের সেই সময়টায় সারা পৃথিবীতেই তখনো গর্ভপাত একটি বিতর্কিত বিষয়। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশের নারীরা তখন গর্ভপাতের অধিকারের জন্য আন্দোলন করছেন। জোরপূর্বক গর্ভধারণের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের পক্ষে আন্তর্জাতিক আইন হয়েছে সবেমাত্র ১৯৯০ সালে। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ একটি বিরল উদাহরণ স্থাপন করেছিল। তৃতীয়ত, যেসব যুদ্ধশিশু ইতিমধ্যে জন্ম নিয়েছিল, তাদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালক হিসেবে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
সবশেষে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ধর্ষিত নারীদের নার্সিং, কুটির শিল্প ইত্যাদি নানা পেশায় পুনর্বাসন করা হয়েছিল। যুদ্ধে লাঞ্ছিত নারীদের নিয়ে এমন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের উদাহরণ আর কোথাও নেই। অবশ্য মধ্য সত্তরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য প্রসঙ্গের মতো বীরাঙ্গনা বিষয়টিও আড়ালে চলে যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বীরঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নয়নিকা মুখার্জি তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, যুদ্ধে ধর্ষিত নারীদের নিয়ে বাংলাদেশের এই অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা পৃথিবীর সংঘাতপূর্ণ সব দেশ, যেখানে ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারত। অথচ বাংলাদেশের এসব অর্জনকে আন্তর্জাতিক জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় যুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেই।
নয়নিকার অন্যান্য লেখা থেকে এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানতে পারি, আমেরিকা নিবাসী জগদ্বিখ্যাত বাঙালি সমাজতাত্ত্বিক গায়ত্রী স্পিভাক, ১৯৭২ সালে তাঁর মাকেসহ বাংলাদেশে এসেছিলেন যুদ্ধে ধর্ষিত নারীদের পুনর্বাসনকেন্দ্রে কাজ করতে এবং গায়ত্রীর সংগ্রহে রয়েছে সেসব নারীর দুর্লভ ফটোগ্রাফ, যা হতে পারত গবেষণার দুর্লভ উপাত্ত। অথচ সেগুলো রয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। নয়নিকার গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্মটি ‘দ্য স্পেকট্রাল ওন্ড: সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স অ্যান্ড পাবলিক মেমোরি অ্যান্ড দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অব নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান’ নামে প্রকাশিত হবে অচিরেই।
অনুতাপের ব্যাপার হচ্ছে, জ্ঞানকাণ্ডের নিয়ম মেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর পদ্ধতিগতভাবে গভীর গবেষণাভিত্তিক চিন্তাশীল কাজের উদাহরণ এ দেশে দুর্লভ। ইদানীং আবার দেখা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও তার পূর্বাপর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের শখের ইতিহাসচর্চা। সেসব প্রত্যক্ষদর্শী বই লিখে এমন দাবি করছেন, যেন ইতিহাসের আসল সত্য এত দিন তাঁরা তাঁদের আস্তিনের নিচে গুটিয়ে রেখেছিলেন। বলা বহুল্য, স্মৃতিচারণা আর ইতিহাসচর্চা এক ব্যাপার নয়। প্রত্যক্ষদর্শীরাই সঠিক ইতিহাস জানেন, এই সূত্র মানলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সৈনিকেরাই হয়ে উঠতেন মহাযুদ্ধের প্রধান ইতিহাসবেত্তা। তথ্য নিজ থেকে ইতিহাস নয়। সঠিক পরম্পরা আর পরিপ্রেক্ষিতে সেই তথ্যকে স্থাপন করতে পারাই ইতিহাস।
স্মরণ রাখা দরকার যে স্মৃতি ব্যাপারটা অনেকটা সৈকতে ঘুরে বেড়ানো শিশুর মতো, সে বিশাল সৈকত থেকে সেই ঝিনুকটাই তুলে নেয়, যা তার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। যিনি স্মৃতিচারণা করছেন, আমাদের লক্ষ রাখতে হবে যে ইতিহাসের বিশাল সৈকত থেকে কোন তথ্য তিনি তুলে আনছেন। আমাদের এ–ও লক্ষ করতে হবে, কোন চিন্তা কাঠামোর কারণে ওই বিশেষ তথ্যগুলো তাঁর কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে ভিনদেশি যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বেলায়ও কথাটা প্রযোজ্য। নয়নিকা মুখার্জির মতো সবাই যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার জন্য বই লিখছেন, তা নয়। এই গৌরবকে ভুলুণ্ঠিত করতেও গ্রন্থ রচিত হচ্ছে। যেমন ডেড রেকনিং: মেমোরিজ অব দ্য নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান বাংলাদেশ ওয়ার নামে বই লিখে শর্মিলা বোস প্রমাণ করতে চেয়েছেন, বাংলাদেশে তেমন কোনো গণহত্যাই হয়নি। কিংবা এ দেশের যুদ্ধশিশু প্রসঙ্গকে পুঁজি করে অন্য এক দেশের স্বার্থ আর বাজারকে মাথায় রেখে মৃত্যুঞ্জয় দেবরাত বানিয়েছেন চিলড্রেন অব দ্য ওয়ার নামে মুক্তিযুদ্ধের এক উদ্ভট চলচ্চিত্র।
উত্তর ঔপনিবেশিক পৃথিবীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটা ঘটনা, এই ঘটনা নিয়ে যদি দেশের ভেতর শুধু আবেগ আর স্বার্থতাড়িত হয়ে অপেশাদার, আনাড়ি ইতিহাসচর্চা চলে, তাহলে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক উভয় অঙ্গনেই তা ক্রমেই একটা বিস্মৃত ঘটনাতেই পর্যবসিত হবে। তখন ফাটা ডিমে তা দিয়ে আর কাজ হবে না।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
[email protected]