আবাহনী-মোহামেডান, প্লিজ খেলা বদলান

একসময় ফুটবল ছিল আমাদের প্রাণের খেলা। ফুটবল ছাড়া দিন-রাত্রি কোনোটাই কাটত না। আমরা খিদে ভুলেছি ফুটবল নিয়ে তর্কে, ফুটবল ছাড়া একদা কোনো বেলা পেটের ভাত হজম হয়নি। সে সময়ের ফুটবল বন্ধুকে শত্রুজ্ঞান করিয়ে ছেড়েছে, আবার ফুটবলের চক্করে পড়ে শত্রু বনেছে বন্ধু। তার প্রবল প্রভাব ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যেও। ফুটবলের সম্পর্ক ভাগ্য গড়ে দিয়েছে অনেকের। চাকরিপ্রাপ্তি বা ব্যবসা অর্জনে কাজে লেগেছে ফুটবলের জোর। ধার দিতে বা নিতে, এমনকি বিয়ে-শাদিতেও ছিল ফুটবলের হ্যাঁ ও না। ফুটবলের জন্য হাতাহাতি, মারামারি, রক্তারক্তি—কোনোটাই বাকি থাকেনি। মনে হতো, ফুটবল ছাড়া এ জাতি এক দিনও বাঁচতে পারবে না। ফুটবলপাগল মানুষের অসংখ্য পাগলামো দেখে গালে হাত দিয়ে ভাবতে হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ কী? কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

ঘুরে গেছে দৃশ্যপট। ফুটবলের গৌরব স্তিমিত, নেই সেই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। ফুটবলের হূতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য নানা প্রচেষ্টার কথা প্রায়ই শোনা যায়। সেদিন এফএম রেডিওতে ফুটবল খেলার ধারা বর্ণনা শুনে অবাক হতে হলো। গুরুত্বপূর্ণ খেলায় গ্যালারি দর্শকশূন্য বলে হতাশা ব্যক্ত করেন ধারাভাষ্যকার। কোন উপায়ে এই করুণ দশা থেকে মুক্তি মিলতে পারে, তা নিয়ে অন্যের সঙ্গে আলোচনায় অদ্ভুত প্রস্তাব কানে এসে ধাক্কা মারে। আলোচককে বলতে শোনা যায়, খেলার মাঠে নাচ-গানের আয়োজন করে দর্শক জমিয়ে তারপর খেলা শুরু করলে আকর্ষণহীন ফুটবলের আকর্ষণ বাড়বে। কী করুণ দুঃখজনক ভাবনা। ফুটবল দাপট হারিয়েছে কখন এবং কীভাবে তা সময়মতো খেয়াল করা হয়নি। তবে আশার কথা, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’, সে মতো বুদ্ধির ঝাঁপি খোলা হয়েছে। এটা মাথা ঘামানোর মতো বিষয়, সেই নামী ক্লাব, মাঠ, খেলা, টাকা সবই তো আছে। বিনোদনের জন্য মানুষের হাতে তেমন কিছু নেইও। আগে সিনেমার জোর ছিল, তাও গত। তাহলে? কোন বিনোদনে আটকা পড়ে জাটকা হলেন অসহায় দর্শক? কোন নতুনের পাল্লায় পড়ে এমন বিমুখতা?

সে সময় প্রতিযোগী ছিল অনেক, কয়েকটি দল ছিল মানুষের বেশ প্রিয়। প্রিয় সেসব দলের তালিকাশীর্ষে ছিল আবাহনী আর মোহামেডান। সমর্থকেরা এক দলকে ঐতিহ্যের ধারক-বাহক মেনে শির উন্নত রেখেছেন। প্রতিপক্ষ সমর্থকেরা তাঁদের প্রিয় দল দেশে আধুনিক ফুটবলের গৌরব বহন করে ভেবে এবং বলে গৌরব বোধ করেছেন। তার মানে, অতি প্রিয় হওয়ার জন্য বিশেষ হওয়া, বিশেষত্ব থাকা জরুরি ছিল। দল ভালোবাসলেও পরোক্ষে বিশেষের প্রতি প্রেম ও বিশ্বস্ততাই জাহির করেছে মানুষ, যা না থাকলে সাধারণ মনে মুগ্ধতা দানা বেঁধে থাকতে পারে না। তখন একদল ঐতিহ্য ও অন্য দলটি আধুনিকতার দাবিতে সমর্থকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। সে মুগ্ধতা এখন তেমন দৃশ্যমান নয়। বিশেষত্ব নিখোঁজ আর মূলমন্ত্র উধাও বলেই কি মুগ্ধতাও পাড়াছাড়া হয়েছে?

বিখ্যাত ও জনপ্রিয় উভয় দলে ছিল আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার অনেক অনেক খেলোয়াড়। তাঁরা একেকজন ছিলেন গুণগত মানে  মহাতারকা। কেউ কারও মতো নন, নিজ নিজ গুণে ছিলেন বিশিষ্ট। খেলাপাগল দর্শক সে সময়ে সব সেরাকে কি স্বীকার করেছেন? দর্শক মাত্রই ফুটবলের প্রাণ, তবু তাঁরা সমর্থকের স্বভাব অনুযায়ী দুই চোখ থাকতেও এক চোখ দিয়ে দেখে সন্তুষ্ট থেকেছেন। দুঃখজনক, ফুটবলের কলা ও সৌকর্য মুগ্ধ করতে পারত মাত্র একটি চোখকেই। নিজ দল ছাড়া অন্য দল বা অন্য দলের খেলোয়াড়কে সামান্য স্বীকার করতে দেখা যায়নি। এমন স্বভাব সুস্থ নয়, অস্বাভাবিক, অযৌক্তিক এবং পীড়াদায়কও কিন্তু কেউ কখনো তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। আনুগত্য আর অন্ধত্ব এক নয়, তখন একাকার হয়ে ছিল। রেফারি, উত্তেজনাপূর্ণ খেলায় যাঁর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত দিলেও সব সময় উভয় দলের সমর্থকেরা তা মাথা পেতে নিয়েছেন, তা বলা যাবে না। নিজের প্রিয় দলের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তপ্রাপ্ত হলে খেলা নিয়ন্ত্রককে পরম শত্রু বিবেচনা করা হয়েছে। অসম্মান করা হয়েছে। যুক্তির জায়গা মেলেনি, একচ্ছত্র রাজত্ব করেছে আবেগ ও ভালোবাসার অন্ধত্ব।

ফুটবল, দলের প্রতি এই উন্মাদনা আর আগের মতো নেই। খেলার মাঠ থেকে সে অন্ধপ্রেম জায়গা বদল করে হাজির হয়েছে গ্যালারিবিহীন নতুন ময়দানে। খেলার মাঠের প্রবল দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছেড়ে পাগলামো এখন ভিন্ন ময়দানের আবাহনী-মোহামেডানকে ঘিরে। তফাত শুধু এই, দ্বিতীয় বা নতুন ময়দানে দুই দলের খেলা উপভোগের জন্য টিকিট কাটতে হয় না। এ ময়দানে নেই কোনো রেফারি। হলুদ বা লাল কার্ড নেই। এই ময়দানের খেলা সময় বাঁধা নয়। সকাল, দুপুর ও রাত্রি—সব সময়ের। সমর্থকদের অন্ধত্ব নতুন ময়দানে দ্বিগুণ। এখানে খেলতে হয় না, ঠেলতে হয়, ধাক্কাতে হয়। এখানে শোনার কারবার নেই, আছে শুধু বলা। এ ময়দানে সামলে চলতে হয় না, হামলে পড়া জানতে হয়। এখানে লুঙ্গি ঝেড়ে গোল খাওয়ানোর চেয়ে গলার রগ ফোলানো, অসতর্ক অনুচিত আচরণ আর যুক্তির বদলে গায়ের জোর দেখাতে পারা বিশেষ যোগ্যতা।  হালুম-হুলুম আর মেরে-কেটে খেলায় জেতার প্রবণতা বেশ চোখে পড়ে। মেধা এখানে প্রয়োজনহীন, তাই কুশলীর দাম নেই, দাম অসুর খেলোয়াড়দের। এ ময়দানের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। শরম থাকলে গরম হয় না ময়দান। প্রতিপক্ষকে সর্বদা সকল দোষে দোষী সাব্যস্ত করে নিজেদের ভাবতে হয় ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির। উভয়ে অভিন্ন হয়েও গৌরব প্রকাশ করে তারা ভিন্ন। জানে, দেশ বত্রিশ কোটির নয়, তবু নিঃসংকোচে উভয় পক্ষই দাবি করে, ষোলো কোটি রয়েছে তাদের সঙ্গে।

সত্যি সত্যি যে অঙ্কের মানুষ সঙ্গে থাকুক, বৈশিষ্ট্যহীন খেলা ছাড়া গ্যালারিতে মানুষ থাকবে কত দিন, কিসের আশায়? ভেবে দেখা হয় না। বিশেষত্ব যদি না থাকে, ফুটবলের যা হয়েছে, একদিন এ ময়দানের হাল হবে তেমনই। অসুরত্ব মানুষকে মানতে হয়, বাধ্য করে। গায়ের জোরে মানুষ মুগ্ধ হয় না, মুগ্ধ হয় বুদ্ধির জোরে, কুশলতায়। সাধারণ বিস্মিত হয় অসাধারণত্বে, মেধায়, সৃজনশীলতায়। বিস্ময়-জাগানিয়া যোগ্যতা না থাকলে কত দিন টিকে থাকবে আনুগত্য, মানুষের প্রেম? দল থাকবে, মাঠ থাকবে, গ্যালারিও থাকবে, তবে আসলের অভাবে সে গ্যালারি থাকবে দর্শকশূন্য। বদলে যাওয়ার সময় এসেছে। নতুন প্রাণের আশা-আকাঙ্ক্ষা শুনতে না পেলে পুরোনো খেলার ধরনে নতুনদের মনে টিকে থাকা মুশকিল। দয়া করে খেলা বদলান, এখনো আশায় আছে মানুষ। ভরসা হারালে, একবার বিস্মৃত হলে নাচ-গানের আয়োজন করে গ্যালারি ভরার ভাবনা ভাবতে হবে। সবার জন্য তা হবে সত্যিই করুণ।

 খেলার মাঠের আবাহনী আর মোহামেডান, আপনারা ফুটবলের অহংকার। কটা অপ্রিয় সত্য বলতে আপনাদের কাঁধে বন্দুকের নলটা রাখতে হলো। মাফ করবেন।

আফজাল হোসেনলেখক, অভিনেতা, নির্দেশক।