সিপি গ্যাং, গং এবং 'নিষিদ্ধ শহীদ মিনার'

নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা। শহীদ মিনারে এ কেমন মানববন্ধন? l ছবি: প্রথম আলো
নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা। শহীদ মিনারে এ কেমন মানববন্ধন? l ছবি: প্রথম আলো

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কেবল ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মারক নয়, জাতীয় ঐক্য ও চেতনারও প্রতীক। যেমনটি হয়েছে একাত্তরের শহীদদের স্মরণে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এই দুটি প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠীর নয়; সমগ্র জাতির।
সম্প্রতি অধ্যাপক পিয়াস করিমের মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে যে কাণ্ড ঘটেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও শিষ্টাচারবর্জিত। পিয়াস করিম যে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করতেন, তার সঙ্গে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে; অনেকে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের বিরোধিতা ও সমালোচনাও করতে পারেন। কিন্তু তাই বলে মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যেতে বাধা দেওয়া হবে কেন? যাঁরা তাঁর মরদেহ সেখানে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, তাঁদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হবে আর আমরা নিজেদের গণতান্ত্রিক ও সভ্য রাষ্ট্র দাবি করব—এটি কীভাবে হয়?
পিয়াস করিমের প্রতি যদি কেউ শ্রদ্ধা জানাতে না চান, সে অধিকার তাঁর আছে। একজনের মৃত্যুতে বাংলাদেশের সব মানুষ শোক প্রকাশ নাও করতে পারেন। যেখানে রাষ্ট্রের স্থপতির মৃত্যুদিবসে ঘটা করে কেক কাটা হয়, সেখানে এটি আশাও করা যায় না। কিন্তু তাই বলে অন্যের শোক প্রকাশে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই।
পিয়াস করিমের স্ত্রী, বন্ধু, স্বজন ও সুহৃদেরা শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহ নিয়ে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেটি করতে দেওয়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠুনকো অজুহাতে পিয়াস করিমের মরদেহ সেখানে নিতে দেয়নি। বলেছে, যেহেতু কোনো কোনো সংগঠন পিয়াস করিমের মরদেহ নেওয়ার বিরোধিতা করেছে, তাই সেখানে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া গেল না। তাহলে তারা বিরোধিতাকারীদের কেন সেখানে সমাবেশ ও মানববন্ধন করার অনুমতি দিল? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবেন?
শহীদ মিনারে মানববন্ধন ও সমাবেশ পালনকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে ছিল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, গণজাগরণ মঞ্চের একাংশ, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক প্লাটুন, সিপি গ্যাং প্রভৃতি। তারা কেবল প্রয়াত অধ্যাপক পিয়াস করিম ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তির ছবিতে কাটা চিহ্নযুক্ত ব্যানার টানিয়ে তাঁদের শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হলেন সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী, মাহফুজউল্লাহ, নূরুল কবীর, গোলাম মোর্তোজা, কবি ফরহাদ মজহার, দিলারা চৌধুরী, আসিফ নজরুল, আমেনা মহসিন ও তুহিন মালিক। সিপি গ্যাংয়ের ব্যানারে লেখা ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সুশীল নামধারী এসব মিথ্যাবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী বুদ্ধি... (শালীনতার কারণে শব্দটি পুরো লিখলাম না) প্রতিহত করুন।’ আর ব্যানারে ‘গং’ কথাটি লিখে এই তালিকা দীর্ঘ করারই ইঙ্গিত দিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
অনলাইনভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের ডাকে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। আর আজ সিপি গ্যাং ও তাদের সহযোগীরা ভিন্নমতের মানুষের টুঁটি চেপে ধরতে চাইছে। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি মেহেদী বলেছেন, শুধু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নয়, দেশের সব শহীদ মিনারে তাঁদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হলো। তাঁর দাবি, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ মিনারের চেতনা লালন ও ধারণ করে না, সেসব গণশত্রুর শহীদ মিনারে আসার কোনো অধিকার নেই।
প্রথমেই বলতে হয়, যাঁরা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে টানানো ব্যানারে উচ্চারণ-অযোগ্য শব্দ লিখেছেন, তাঁরা কেবল শহীদ মিনারকে অপমান করেননি, অপমান করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও। অপমান করেছেন দেশের নারীসমাজকেও। এই সাহস তাঁরা কোথায় পেলেন? তাঁরা নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন, তাঁরা কেউ রাষ্ট্রের আইন ভঙ্গ করেননি, সংবিধান লঙ্ঘন করেননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। এই নয় বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চের প্রবল সমর্থক এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হওয়া মানুষও আছেন।
বলা হতে পারে, তাঁরা লেখালেখি, টক শো ও সভা-সমাবেশে সরকারের কড়া সমালোচনা করেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের সমালোচনা করা কি অপরাধ? সরকারের সমালোচনা করলেই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয়?
সংবিধান অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো ‘সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচারের নিশ্চয়তা।’ (দ্রষ্টব্য: সংবিধানের প্রস্তাবনা, পৃষ্ঠা ৯)। যাঁরা শহীদ মিনারে পিয়াস করিমের মরদেহ নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আইনের শাসনের পরিপন্থী কিছু করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় তাঁরা আইন লঙ্ঘন করে সেখানে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টাও করেননি।
বরং আমরা দেখতে পাই, সিপি গ্যাংসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে আইন লঙ্ঘন করেছেন, তঁারা মৃত ব্যক্তির লাশ শহীদ মিনারে নিতে বাধা দিয়ে এবং জীবিত ব্যক্তিদের জন্য দেশের সব শহীদ মিনার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পরিণতি যে কত ভয়াবহ হতে পারে, তা কি তঁারা ভেবে দেখেছেন?
সিপি গ্যাং ও তার সহযোগীরা যাঁদের স্বাধীনতাবিরোধী বলে প্রচারণা চালাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ অনেক পেশাজীবী সংগঠনে এখন তাঁরা নির্বাচিত প্রতিনিধি। যদি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ঘোষণা দেয় যে ভিন্নমতের কেউ বিচারালয়ে ঢুকতে পারবে না, তাহলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে? নিষিদ্ধ ঘোষণাকারীরা যাঁদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি মনে করেন না, দেশের ছয়টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়রও সেই দলের। তাঁরা যদি নিজ শহরে কারফিউ জারি করে বলে দেন, সেখানে তাঁদের মতের বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না, তাহলে অবস্থাটি কী দাঁড়াবে?
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের একটি কলামের নাম ছিল ‘আমার সমালোচক আমার বন্ধু’। আর শহীদ মিনারে মানববন্ধনকারীরা মনে করেন, সমালোচকেরাই তাঁদের শত্রু। এই বন্ধুতা ও শত্রুতাও সময়ের ব্যবধানে কীভাবে বদলে যায়, তার একটি উদাহরণ দিই।
বর্তমান সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া ও আলপনা আঁকাকে বিদায়াত বলে অভিহিত করেছিলেন। শহীদ মিনার তাঁর জন্য অবাঞ্ছিত হতে পারে, কেননা তিনি শহীদ মিনারের সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন না। জাতীয় পার্টির নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে ছাত্র-জনতার হাতে লাঞ্ছিতও হয়েছিলেন।
কিন্তু যাঁরা শহীদ মিনারের চেতনা ও সংস্কৃতি ধারণ করেন, যাঁরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের সেখানে যেতে বাধা দেওয়া হবে কেন? তাঁরা ভিন্নমত প্রকাশ করেন বলে?
সংবিধান মানলে, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ একই অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারায় আছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে ক. নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং খ. সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
যে নয়জন সাংবাদিক, অধ্যাপক ও লেখককে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁরা সংবিধানের উপরিউক্ত ধারা লঙ্ঘন করেছেন—এ রকম প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না। বরং যাঁরা তাঁদের শহীদ মিনারে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন, তাঁরাই সংবিধানের মানবাধিকারসংক্রান্ত ধারা লঙ্ঘন করেছেন।
আমরা স্মরণ করতে পারি, ২০০৩ সালে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনারে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছিল, তাহলে সেই হামলাকারীদের সঙ্গে আজকের অবাঞ্ছিত ঘোষণাকারীদের পার্থক্য কী?
বোতলের সিপি আঁটা দৈত্যরা যে কত ভয়ংকর, তা আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্যে যুবলীগসহ সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়াই স্পষ্ট। তিনি একাত্তরে পিয়াস করিমের ও তাঁর বাবার প্রকৃত ভূমিকা তুলে ধরায় প্রেসক্লাবের সামনে তারা আইনমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা পর্যন্ত দাহ করেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকারের একজন মন্ত্রীকে সম্মান দেয় না, তাদের কাছে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অপমানিত হবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
শহীদ মিনারে মানববন্ধন পালনকারীরা কেবল শালীনতা ও নৈতিকতা নয়, জনশৃঙ্খলার সীমাও লঙ্ঘন করেছেন। তাই সরকারের উচিত হবে এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। আর যদি সরকার সেটি নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে মানুষ ধরে নেবে যে এসবের পেছনে তাদেরও ইন্ধন আছে।
ফরাসি দার্শনিক ফ্রাঁসোয়া মারি আবুজে, যিনি ভলতেয়ার নামে অধিক পরিচিত, বলেছিলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি। কিন্তু তোমাকে তোমার কথা বলতে দেওয়ার জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।’ আর শহীদ মিনারে মানববন্ধন পালনকারীরা তার উল্টোটাই করেছেন, তঁারা ভিন্নমতের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চাইছেন। হয়তো একদিন রাষ্ট্রের টুঁটি চেপে ধরতেও দ্বিধা করবেন না। তবে তঁাদের মনে রাখা উচিত, শেষেরও শেষ আছে। বর্তমান সরকারই বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]