চাতুরীর ফল ভালো হয় না

হাভিয়ার সোলানা
হাভিয়ার সোলানা

হায়! কী বোকার স্বর্গেই না আমরা বাস করছিলাম। বছরের পর বছর ধরে আমরা বিশ্বাস করেছি, এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা থেকে বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় উত্তরণপর্বটি একরকম শান্তিপূর্ণ হবে। অর্থাৎ চীন, ব্রাজিল ও তুরস্কের মতো নতুন খেলোয়াড়েরা স্বাভাবিকভাবেই বহুপক্ষীয় কাঠামোর সঙ্গে মানিয়ে নেবে। কী ভুলই না আমরা ভেবেছিলাম!
বস্তুত, বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে যতই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, বিশ্বব্যবস্থা ততই অস্থির হয়ে উঠছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কারণে অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাস বেড়েছে, ফলে বিশ্বায়নের গতিও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর ব্যর্থতাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। তারা আসলে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো কোনো অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় উত্তরণের প্রক্রিয়া কণ্টকমুক্ত করতে পারেনি তারা।
এই ব্যর্থতার কারণ খুবই সোজাসাপ্টা: পশ্চিম স্বল্পমেয়াদি কৌশলগত বিবেচনার কারণে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত দূরদৃষ্টি গড়ে তুলতে পারেনি। কৌশল নিয়ে এ রকম বুঁদ হয়ে থাকার কারণে প্রতিটি পর্যায়েই সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তা সেটা যেমন স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আবার তেমনি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফলে মূল খেলুড়েরা একধরনের অসমন্বিত বাস্তবতায় নিপতিত হয়েছে, তাদের কোনো অভিন্ন লক্ষ্য নেই। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়াও তেমন একটা ফলপ্রসূ হয়নি।
সন্দেহ নেই, এ ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমও আছে। একটি গঠনমূলক কৌশলগত দূরদৃষ্টি নির্ধারণ করার প্রচেষ্টা থাকার কারণেই এটা হয়েছে। যেমন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিসংক্রান্ত একটি সমাধানে আসার ক্ষেত্রে পশ্চিমা নীতির কিছু সুফল ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে।
কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে কৌশলগত চিন্তা বাস্তবতার পেছনে পড়ে গেছে। যেমন, ইউক্রেনে চলমান দ্বন্দ্বের জেরে রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে দূরত্ব শুধু বেড়েছে। সোভিয়েত-উত্তর যুগে রাশিয়া আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় স্থান করে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে আবার আধুনিকায়নের ধার ধারেনি। ফলে রাশিয়া প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে নিজ কর্তৃত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করে এক সংশোধনবাদী জাতীয়তাবাদের খপ্পরে পড়েছে।
আর শুধু রাশিয়াই পশ্চিমা আধুনিকতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই অস্থিতিশীলতার উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে, এর পেছনে আবার ঐতিহাসিক উত্তেজনাও কাজ করেছে। আর এখন পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই আগুন জ্বলছে, আর সেটা ঘটছে মূলত পশ্চিমের স্বল্পমেয়াদি কৌশলগত বিবেচনার কারণে।
হ্যাঁ, পশ্চিমারা বুঝতে পারেনি, স্বৈরতন্ত্র সমর্থনের ফলাফল কী হবে। আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে আরবের জনগণ এই স্বৈরশাসকদের প্রতি তাদের মনোভাব বুঝিয়ে দিয়েছে। আবার ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায় পর পর সামরিক আগ্রাসন করার ফল কী হবে, পশ্চিম সেটাও বুঝতে পারেনি। ফলে গৌরবময় অতীতের নস্টালজিয়ায় আরব দুনিয়া আক্রান্ত হয়েছে, আইএসের খেলাফত পুনরুদ্ধারের অভিপ্রায়ে যার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
পশ্চিম ভাবেনি, যে বিশ্বশক্তি পেছন পানে হেঁটে অতীতের মধ্যে নিজের ভবিষ্যৎ খোঁজার চেষ্টা করবে। যেভাবেই হোক, মধ্যপ্রাচ্যের নিজের সমস্যা তার নিজেরই সমাধান করতে হবে। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো সমাধান কোনো দিন কাজে আসেনি। আর দুনিয়ার অন্যান্য দেশের কাজ হচ্ছে, এ সমাধানের জন্য একটি স্থিতিশীল পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করা। যে সমাধানের মধ্য দিয়ে সারা দুনিয়াই একটি অভিন্ন নীতিমালা ও মানদণ্ডে পরিচালিত হবে।
এই বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় উত্তরণের পথে পশ্চিমের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এশিয়া। এই অঞ্চলটি গতিশীল ও ভবিষ্যৎমুখী, আবার একই সঙ্গে ঐতিহাসিক বিবাদ ও বিভাজনে জেরবার। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় এশিয়া গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা ভেবেই ২০১২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই অঞ্চলটি কৌশলগত ‘কেন্দ্রবিন্দু’ আখ্যা দিয়ে নতুন নীতির ঘোষণা দিয়েছেন।
তদুপরি, পশ্চিম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে আঞ্চলিক সহযোগিতার কাঠামো গড়ে তোলা বা সেটা সংহত না করে উল্টো নিরাপত্তার মতো প্রয়োজনীয় বিষয়ের গুরুত্ব হ্রাস করেছে। এশিয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত এখনো শুকায়নি। ফলে আঞ্চলিক বিবাদ ও জাতীয়তাবাদী দাবি শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে।
কিন্তু পশ্চিমের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি দূরদৃষ্টির জন্য শুধু কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণই যথেষ্ট নয়, মেরুকরণে বিপর্যস্ত ও অকার্যকর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করাও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পররাষ্ট্রনীতিতে যে কৌশলগত দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে, তার অন্তত আংশিক কারণ হচ্ছে তাঁর দেশের ভুলে ভরা অভ্যন্তরীণব্যবস্থা।
অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে স্বল্পমেয়াদি নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু এর সামাজিক ও রাজনৈতিক ফল কী হবে, সেটা তারা চিন্তাও করেনি। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী মনোভাব জোরদার হচ্ছে, সেটাও তারা বুঝতে পারেনি। ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের সমস্যা মোকাবিলায় যে তরিকা নিয়েছে, তাতে সংস্থাটির কোনো নির্ভরযোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না বা কোনো সমন্বিত দূরদৃষ্টিও গড়ে উঠছে না। আরও কৌশলগত অ্যাপ্রোচ হবে এ রকম যে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব সদস্যদেশেরই প্রবৃদ্ধি বাড়ানোয় নজর দেবে। যেমন তারা গবেষণা, উন্নয়ন ও নবরীতি প্রণয়ন করার মাধ্যমে ইউরোপ ২০২০ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ও ট্রান্স আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ আরও জোরদার করতে পারে।
চাতুরীর ফল আসলে খুব একটা ভালো হয় না। এটা এমন পরিণাম বয়ে আনতে পারে, যা আমাদের চিন্তারও বাইরে। কৌশল আসলে ভিন্ন ব্যাপার, তাতে কাজের একটি রূপরেখা থাকে। দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত তার রূপরেখাও সেখানে থাকে। একটি পরিবর্তন কীভাবে সামগ্রিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, তারও রূপরেখা সেখানে থাকে। ফলে এই কৌশলের কাঠামোয় ঢুকলে বরং আমরা কাঙ্ক্ষিত বিশ্ব অর্জন করতে পারব, যে বিশ্ব হবে বাসযোগ্য, স্থিতিশীল, মুক্ত ও সমৃদ্ধ।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
হাভিয়ার সোলানা: ন্যাটোর সাবেক মহাসচিব।