মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির পূর্বাপর

.
.

মুক্তিযুদ্ধ একটি জাতির জীবনে চরম গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ঠিক তেমনি অতি মর্যাদার অধিকারী সে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক নেতৃত্বে। অংশ নিয়েছিলেন বাঙালি সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। পাশাপাশি অংশ নেন এ দেশের অকুতোভয় কয়েক লাখ বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনীসহ ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকলেও একই উদ্দেশ্যে দেশমাতৃকাকে হানাদারমুক্ত করতে তাঁরা অস্ত্র ধরেছিলেন। বাজি রেখেছিলেন নিজেদের জীবন। বিস্মৃত হয়েছিলেন ভবিষ্যতের কোনো ধরনের অনিশ্চয়তার আশঙ্কায়। যে নামেই থাকুন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। স্বাধীনতার পর সেই মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সরকার একটি সনদ দেয়। তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। সে তালিকায় আজ অবধি বেশ কবার রদবদল হয়েছে। ৪৪ বছরেও বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি। এখনো কেউ যুক্ত হচ্ছেন, আবার বাতিল হচ্ছে কারও নাম।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি ব্যাপক কার্যক্রম। এটা প্রথাসিদ্ধ যুদ্ধের মতো ব্রিগেড বা ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা নয়। এ যুদ্ধকে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা ছিল ব্যাপক। ঠিক তেমনি স্থানীয় পর্যায়ে সেক্টর, সাব-সেক্টরের প্রচেষ্টাও ছিল একই রকমের গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে ক্ষীণ যোগাযোগের মাধ্যমে যুদ্ধ করেছে কাদেরিয়া বাহিনী। তেমনি আরও ছোটখাটো প্রচেষ্টা অন্যদেরও ছিল। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল ও পরিপূর্ণ তালিকা করা দুরূহ বটে। তবে এটা অসম্ভব নয়। আর ৪৪ বছরেও সম্পন্ন না করার মতো কোনো কাজও নয়; বরং দিন দিন নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিলে বিতর্কের পালে হাওয়া লাগার ব্যবস্থা হবে। আর প্রকৃতপক্ষে আমরা তা-ই করে চলেছি। নচেৎ মুক্তিযোদ্ধা সনদ কারা পাবেন, তাঁদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা অনেক আগেই সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল। কোনো ভুলভ্রান্তি যৌক্তিক কারণে সময়ান্তরে সংশোধনের সুযোগ সব সময় থাকে। তেমনি থাকবে এ তালিকাতেও। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা সে পর্যায়ে এখনো পৌঁছতেই পারিনি।
বিভিন্ন কারণে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহে এখন অনেকেই সক্রিয়। অবশ্য অভিযোগ রয়েছে, তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন বেশ কিছু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত করে অবশ্যই সনদ দেওয়া উচিত। আরও অভিযোগ রয়েছে, তালিকায় অন্তর্ভুক্ত সনদধারীরা কেউ কেউ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। খবরের কাগজে প্রায়ই এ ধরনের অভিযোগ আসে। সেদিনও দেখা গেল, একাত্তরে জন্ম নেওয়া এক ব্যক্তি এ সনদের কল্যাণে নিয়মিত ভাতা উত্তোলন করছেন। তাঁদেরও চিহ্নিত করে সনদ বাতিল করা দরকার। এসব কাজ নিয়ে অনেক দেরি করে ফেলা হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে জটিল সব সমস্যা। আরও দেরি সে সমস্যাকে ঘনীভূত করবে।
উল্লেখ্য, সনদধারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। রয়েছে কিছু ভাতা। চাকরি ও কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে রয়েছে তাঁদের জন্য নির্ধারিত প্রাধিকার কোটা। সময়ান্তরে সে প্রাধিকার ভোগ করছে মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্ম। মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকরিজীবীরা অন্যদের চেয়ে এক বছর বেশি চাকরি করতে পারেন। এসব সুবিধার কয়েকটির যৌক্তিকতা সম্পর্কে ভিন্নমত রয়েছে। সেগুলো এ নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। এখানে লক্ষণীয় ও আলোচনা করার বিষয়, এ প্রাধিকার কোটার অপব্যবহার হচ্ছে। সনদসংক্রান্ত বিষয়াদি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মুক্তিযোদ্ধার সর্বনিম্ন বয়স নিয়েও সম্প্রতি একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সেটা যেখানেই নির্ধারণ করা হোক, এখন তাঁদের কারও বয়স ৫৫-এর কম নয়। এর মধ্যে অনেকে মারাও গিয়েছেন। প্রকৃতির নিয়মে বছর পঁচিশেক পরে অবশিষ্ট কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। তখন এসব কাগজপত্র ছাড়া সত্যতা নির্ণয়ের ভিন্ন কোনো প্রক্রিয়া থাকবে না। তাই সরকারি দলিলপত্র যতটা সম্ভব নির্ভুলভাবে চূড়ান্ত করতে কালবিলম্ব করাও ক্ষতিকর হবে।
এর মাঝেই এসব সনদ জালিয়াতির অভিযোগ আসছে। আর সেই অভিযোগ রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। শীর্ষস্তরের কয়েকজনও রয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। ধীরগতিতে হলেও তদন্ত এগিয়ে চলছে। মনে হয়, মুক্তিযোদ্ধা সনদধারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বর্ধিত মেয়াদের চাকরির সুযোগ এ ধরনের সনদ সংগ্রহে তাঁদের প্রলুব্ধ করছে। কেউ কেউ হয়তোবা ভবিষ্যৎ বংশধরকে চাকরিসহ অন্যান্য সুবিধার বিবেচনায়ও তা করতে পারেন। যে কারণেই হোক, যে বা যারা এগুলো করেছে কিংবা দিয়েছে সহায়তা, তাদের আইনসম্মত শাস্তির দাবি যৌক্তিক। তদন্ত এক দফা হয়ে গেছে। বাকিটুকু দ্রুত শেষ করে অন্যদের দেখানো উচিত, এমনটা করলে সাজা ভোগ করতে হবে। চাকরি থেকে বিদায় নিতে হবে গ্লানি নিয়ে।
এখানে একটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। বর্তমানে যাঁরা চাকরিরত, তাঁরা সবাই স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম। চাকরিতে প্রবেশকালেই সরকারি কর্মকমিশন বা অন্য কোনো সংস্থার ফরমে তাঁদের লিখতে হয়েছে, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি না? থাকলে দিতে হয়েছে তথ্যাদি। সেখানে ‘না’ লিখে এত বছর পরে হঠাৎ সনদ নিয়ে এলে এটা গ্রহণ করা হয় কোন যুক্তিতে? বিষয়টি কোনো করণিক ত্রুটি ছিল না। ছিল স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ঘোষণা। যাঁদের বিষয়টি আজ সবচেয়ে বেশি আলোচিত, তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন করা চলে। চাকরিতে প্রবেশের সময় অসত্য তথ্য পরিবেশন, চাকরির আবেদনটিই সরাসরি নাকচযোগ্য। সুতরাং তাঁদের চাকরিপ্রাপ্তি থেকে পরবর্তী সব কার্যক্রম অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। আর তা ভোগ করে এখন একটি সনদ এনে আরও সুবিধা পেতে চাইছেন। পরিশেষে প্রাথমিক প্রমাণ আসে, সে সনদটিও ভুয়া। গণমাধ্যম সোচ্চার। সোচ্চার সুশীল সমাজও। তাই বিতর্কিত বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত সবার দাবি।
প্রশ্ন থাকে, তাঁরা চাকরিতে প্রবেশকালে মুক্তিযোদ্ধা নন বলে লিখলেন কেন? কেউ কেউ বলেন, তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা লিখলে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় এমনটা করেছেন। এটা আদৌ গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বলে ধরে নেওয়া যায় না। এ ধরনের ঘোষণা দিয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি পিছুটান দিয়েছেন, এমনটা বলা অতিশয়োক্তি নয়। সে সময়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে সনদ নিয়ে অনেকেই চাকরিতে এসেছেন। চাকরি করেছেন ও করছেন। তাঁদের যুক্তিকে সামান্য আস্থায় নিলেও বলতে হয়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছরের মধ্যে তাঁরা এ বিষয়টি প্রতিকারের জন্য আবেদন করতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। তাহলে এখন শুধু অতিরিক্ত সুবিধার জন্য মরিয়া হয়ে এ সনদ সংগ্রহ ও ব্যবহারে তৎপর হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে গত কয়েক মাসে দুটি আদেশ হয়েছে। প্রথম আদেশে ছিল, চাকরিতে প্রবেশকালে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা না থাকলে পরে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অল্প কদিন পরে বলা হয়, যেকোনো সময়ে সেসব তথ্যাদি সরকারের কাছে জমা দিলেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত সুবিধাদি পাওয়া যাবে। বিষয়টাকে খোলা রাখলে আরও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ ধরনের সনদ সংগ্রহে উৎসাহী হয়ে পড়বেন। গ্রহণ করতে পারেন বেআইনি পথ। দায়িত্বশীল মহলের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ ছাড়া সবাই কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। শহীদ হয়েছেন ৩০ লাখ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন প্রায় দুই লাখ। আর যাঁরা সশস্ত্র যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা সুভাষ চন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘পরাধীন জাতির পক্ষে স্বাধীনতার সংগ্রামে সৈনিক হওয়ার চেয়ে সম্মান ও গৌরবের বিষয় অন্য কিছুই নেই।’ ঠিক তেমনি আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও সম্মান ও গৌরবের অধিকারী। তাঁদের পরিচয়টির অপব্যবহার বন্ধে আমাদের সব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। কিন্তু তা আমরা নিইনি। সময়ের দাবি, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দ্রুত চূড়ান্ত করে খুঁটিনাটি সংশোধন ছাড়া অন্য যেকোনো কারণের জন্য বন্ধ করা। আর চাকরিতে প্রবেশকালে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে ঘোষণা না দিলেও পরবর্তী সময়ে সে সুযোগ দেওয়ার বিধানটি দরকার রদ করা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]