আদিবাসীদের জমি ও শ্মশানভূমি দখল বন্ধ হোক

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার ক্রাইক্ষ্যং–হাংসামাপাড়া এলাকায় পূর্বঘোষণা ছাড়াই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আদিবাসীদের ব্যবহৃত জমি ও শ্মশানভূমিতে বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। অধিগ্রহণের আগেই এ রকম দখল বেআইনি—এ অভিযোগের ভিত্তিতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল গেল ২০ অক্টোবর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা দেখতে পান, স্থানীয় আদিবাসীদের সেখানে প্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আদিবাসীরা বলতে চাইছে, এই কাঁটাতারের সীমানার ভেতরেই আছে তাদের আত্মীয়দের স্মৃতি, শ্মশান ও যত্নে গড়ে তোলা জুম-জমি ও বাগান। বিজিবি সেখানে টহল বসিয়েছে, অস্ত্র হাতে জওয়ানেরা পাহারা দিচ্ছেন।
কয়েক দশক ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর আদিবাসী জনগণ ক্রমাগত ভূমি থেকে উৎখাত হয়ে এখন প্রায় নিঃস্ব। আর এখন বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য আদিবাসীদের জমি ও শ্মশানভূমি দখল এবং স্থাপনা নির্মাণের এ প্রক্রিয়া নতুন সংযোজনমাত্র। স্থানীয় নেতারা বা জনগণ কারও সঙ্গে আলোচনা ব্যতিরেকে এ ধরনের দখল কার্যক্রম তাই প্রশ্নবিদ্ধ।
এতে পাড়াবাসীর উচ্ছেদের ভয় তো আছেই, সঙ্গে এ অঞ্চলের জনমিতিক বিন্যাসও নষ্ট হবে, এমন আশঙ্কাও রয়েছে। বিজিবির দাবি, তারা লে. কর্নেল (অব.) উকান থিনের কাছ থেকে দখল করা জমি নিয়েছেন। এ বিষয়ে থিনের স্বাক্ষরবিহীন একটা লিফলেটও জনগণের মধ্যে প্রচার করা হয়েছে, যেখানে তিনি বিজিবিকে উক্ত জমি অধিগ্রহণের অনুমতি দিয়েছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। তাঁর নিজের ৬০ নম্বর হোল্ডিংয়ে ৪ দশমিক ৮০ একর, ৮০ নম্বর হোল্ডিংয়ে ৩ একরসহ হেডম্যানের সুপারিশসহ তাঁর পরিবারের মোট ২৭ দশমিক ৮০ একর জমি আছে, যেটা তিনি বিজিবিকে দিয়েছেন বলে সেখানে উল্লেখ আছে।
জেলা প্রশাসনের মতে, সেখানে মোট জমি ৩৪ একর বিজিবি অধিগ্রহণ করেছে, যার মধ্যে ১৩ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন। তাঁর মতে, উকান থিনের পারিবারিক জমি (১৩ একর) বাদে বাকিটা খাসজমির অন্তর্ভুক্ত। আনুষ্ঠানিক অধিগ্রহণের অনুমতি না পেয়েও কীভাবে বিজিবি এটা দখল করল, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা অধিগ্রহণ করা হবেই এবং সবচেয়ে কম লোককে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমন স্থানকেই এ অধিগ্রহণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। তিনি শ্মশান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়টিও দেখবেন বলে আমাদের আশ্বস্ত করেন। এলাকাবাসীর মতে, সেখানে জমির পরিমাণ ৫০ একর, যার মধ্যে বাগান রয়েছে ৩৭ একর; হেডম্যানের রিপোর্ট অনুযায়ী, দখল করা জমিতে চার পরিবারের মোট ১৩ একর জমি যেখানে সা মং প্রু, মেসং, সংশৈপ্রু ও সিংসানুর নাম রয়েছে; কাজেই উকান থিনের এখানে কোনো জায়গা নেই; কিন্তু তাঁর দাবি অনুযায়ী এখানকার অধিবাসী মং প্রু টমির সঙ্গে বিবাদ সৃষ্টি হলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত যায় এবং সেখানে কর্নেল থিন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়ে মামলা উঠিয়ে নেন।
১৯৯৩ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের মৌখিক নির্দেশে পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর আইন অনুযায়ী পাড়াবাসীর ২৫ পরিবারের বসতভিটার জন্য ৩০ শতক করে মোট ৭ দশমিক ৫০ একর জমি মৌজার হেডম্যান কর্তৃক দেওয়া বন্দোবস্ত দলিলও তাদের কাছে রয়েছে। প্রসঙ্গত, বান্দরবান সদর উপজেলার হ্লাপাই মৌজার মোট সাত হাজার একর জমি থেকে বন বিভাগের দখলে আছে চার হাজার ৫৫০ একর, অব্যবহৃত খাল ঝিরি প্রায় এক হাজার একর আর ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রায় এক হাজার একর। উক্ত মৌজায় আট শতাধিক পরিবার জুমের জমির অভাবে চরম দরিদ্রতার জীবন অতিবাহিত করছে। এ অবস্থায় বিজিবির পক্ষ থেকে বন বিভাগ থেকেও সেক্টর সদর দপ্তর নির্মাণের জমি নেওয়া যেত। কিন্তু তা না করে ওই এলাকায় জায়গা দখলের মানসিকতা বোধগম্য নয়। এটি হলে স্থানীয় আদিবাসীরা নিশ্চিতভাবে উচ্ছেদের সম্মুখীন হবেন।
উল্লেখ্য, বিজিবি সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য প্রথমে তারাছা মৌজার ছাইঙ্গা ব্রিকফিল্ডকে নির্ধারণ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈচিং ও ব্রিকফিল্ডের মালিকের মামুলি আপত্তির কারণে তা বাতিল করা হয়। এরপর রামজাদী বিহার এলাকা দখলের চেষ্টাও প্রতিহত হওয়ায় বর্তমানে ক্রাইÿক্ষ্যং-হাংসামাপাড়া এলাকার জমি থেকে পাহাড়িদের ন্যায্যতা অস্বীকারের মধ্য দিয়ে জমি, শ্মশান, বাগান—সব দখল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তারাছা মৌজার ছাইঙ্গা ব্রিকফিল্ডের মালিক প্রভাবশালী বসতি স্থাপনকারী বলে তাদের দুই পরিবারের আপত্তি শুনলেও এখানকার ৩০০ পরিবারের আপত্তি কোনো প্রশাসনই গ্রাহ্য করছে না। এ প্রেক্ষাপটে আমরা কিছু পর্যবেক্ষণ ও দাবি রাখছি:
পর্যবেক্ষণ: এক. আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণের কোনো ক্ষেত্রেই সার্কেল চিফ বা রাজার কোনো অবস্থান নেই; রাজাকে অধিগ্রহণবিষয়ক কোনো কমিটিতে রাখা হয়নি। অথচ ১৯৯৭ সালের স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ভূমি ব্যবস্থাপনায় প্রথাগত আইন, রীতি ও পদ্ধতিকে গ্রাহ্য করা হয়েছে। সেহেতু ভূমি অধিগ্রহণ কিংবা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে রাজার ভূমিকা অগ্রাহ্য করা চুক্তির লঙ্ঘন। দুই. যেকোনো অধিগ্রহণে হেডম্যানের সুপারিশ প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য হেডম্যানের সুপারিশ ছাড়া জমি দখল কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিন. পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর আইন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে খাসজমি বলতে কিছু নেই। জমির মালিকানা স্বত্ব মৌজা হেডম্যানের কাছে কিংবা সরাসরি সার্কেল চিফের হাতে ন্যস্ত থাকে। কাজেই খাসজমির ধারণা থেকে দরিদ্র আদিবাসীদের জায়গাজমি অধিগ্রহণ খুবই প্রশ্নবিদ্ধ। চার. উপরন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী, ছয়টি স্থায়ী সেনানিবাস ও বিজিবি ক্যাম্প ব্যতীত সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর অন্যান্য অস্থায়ী ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়ার কথা থাকায় নতুন করে সেক্টর দপ্তর নির্মাণের বিষয়টি চুক্তির পরিপন্থী। এভাবে নানা প্রক্রিয়ায় পাহাড়িদের জমি দখলের কাজ এগোচ্ছে, যা জ্যামিতিক হারে পাহাড়ের সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করছে। পাঁচ. আগে বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে জমি দখল করার অভিযোগ উঠলেও এখন সরাসরি প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত বাহিনীকে এ রকম অধিগ্রহণে উৎসাহিত করা যারপরনাই দুঃখজনক। ছয়. রাষ্ট্রীয় আইনে কোনো নাগরিককে স্বীয় ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা অন্যায় এবং আন্তর্জাতিক আইনে কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টিকে তাদের মুক্ত, অবহিত ও পূর্ব সম্মতি ব্যতিরেকে ভূমি থেকে উচ্ছেদকরণ অবৈধ।
দাবি: আমরা তাই দরিদ্র আদিবাসীদের ভূমি রক্ষায় বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার ক্রাইক্ষ্যং-হাংসামাপাড়া এলাকায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য আদিবাসীদের জমি ও শ্মশানভূমি দখল এবং স্থাপনা নির্মাণকাজ বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি এবং এখানে কোনো অধিগ্রহণ যাতে না হয়, সে বিষয়টিও নজর রাখার জন্য সরকারকে অনুরোধ করছি। আমাদের দাবি: ক. বোমাং সার্কেল চিফ, সংশ্লি­ষ্ট মৌজা হেডম্যানের সুপারিশ ব্যতীত বিজিবি সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য জমি অধিগ্রহণ কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহ্যবাহী ভূমি ব্যবস্থাপনার নিয়মনীতির লঙ্ঘন। তাই সার্কেল চিফ ও মৌজা হেডম্যানের সঙ্গে আলোচনার পূর্বে ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে হবে। খ. এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, বোমাং সার্কেল চিফ, মৌজা হেডম্যান এবং মৌজাবাসীর সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে। গ. ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
লেখকগণ নাগরিক প্রতিনিধিদলের সদস্য