প্রাথমিক শিক্ষার প্রশ্ন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বক্তৃতায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ওপর বেশি বইয়ের চাপ কমানোর কথা বলেছিলেন। পড়াটা যেন বোঝা না হয়। তারা যেন সহজ ও আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারে। কথাটা শুনে খুব ভালো লেগেছিল। হয়তো এ কারণেই ২০১৩ সালে কিছু পরিবর্তিত, পরিমার্জিত ও কিছু কম পাঠ্যসূচিসমৃদ্ধ প্রাথমিক শিক্ষার নতুন বই দেখলাম। কিন্তু আশামতো কিছু পেলাম না। তবু কিছু তো হয়েছে—এই ভেবে যখন আশ্বস্ত, ঠিক তখনই দেখলাম পরীক্ষাপদ্ধতির এক মহা আয়োজন। বিশেষ করে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নকাঠামো দেখে আঁতকে উঠি। এটা প্রধানমন্ত্রীর কথার বিপরীত কাজ।
পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষায় ১৬টি ক্রমিক প্রশ্নে ২০টিরও বেশি ছোট-বড় উত্তর লিখতে হয়। রচনা লিখতে হয় ২০০ শব্দের ভেতর। এ ছাড়া পাঠ্যবই-বহির্ভূত অনুচ্ছেদ রয়েছে বাংলা বিষয়ে। ইংরেজি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র দেখলে মনে হবে, ইংরেজির সব বিদ্যা ঢেলে দেওয়া হয়েছে এবং এখানেও আছে পাঠ্যবহির্ভূত অনুচ্ছেদ। প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং ধর্ম (সব) পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে নৈর্ব্যক্তিক ৪০টি, শূন্যস্থান ১০টি, সংক্ষিপ্ত ১০টি ও কাঠামোবদ্ধ আটটি প্রশ্নের উত্তর লেখা আবশ্যিক। আর প্রতিটি বিষয়ে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন হচ্ছে ২৫ নম্বরের এবং ট্র্যাডিশনাল প্রশ্ন ৭৫ নম্বরের। আগে প্রশ্নপত্রে মোট ১০টি ক্রমিক প্রশ্ন থাকত। তার চেয়ে এখন যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্রের খুব একটা পার্থক্য চোখে পড়ে না। যেমন আগে ছিল ব্যাখ্যার সারমর্ম। এখন বলা হয় বুঝে লেখো, অথবা মূল ভাব লেখো।
সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে সমাপনী পরীক্ষার খাতা দেখার নিয়ম। বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে প্রতি ছয়টা ভুল বানানের জন্য কাটা যাবে ১ নম্বর। অর্থাৎ যে শিক্ষার্থী নয়টা বানান ভুল লিখবে, তার কাটা যাবে ১ নম্বর। আবার যার সব বানান শুদ্ধ হবে, তার যেমন কোনো নম্বর কাটা যাবে না; তেমনি যে পাঁচটি বানান ভুল লিখল, তারও কোনো নম্বর কাটা যাবে না। এতে বানানের প্রতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গুরুত্ব দেওয়া কমে যাবে।
অধিক প্রশ্নের কারণে উত্তর লিখতে সময় বেশি লাগছে। এ জন্য সময় বাড়ানো হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণীর একটি শিশুর জন্য আড়াই ঘণ্টা সময় কতটা যৌক্তিক ও মানবিক। শিশু মনস্তত্ত্বের জায়গাটি এখানে গুরুত্ব পাচ্ছে না। প্রথম শ্রেণীতে ৫০ নম্বরের মৌখিক ও লিখিত ৫০ নম্বর। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর পরীক্ষাতেই তাকে মুখোমুখি হতে হয় ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায়। এক ধাপে দ্বিগুণ, এটাও একটি শিশুর ওপর মানসিক নির্যাতন ছাড়া কিছু নয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞান যেমন ভালো করে পড়তে, লিখতে ও বলতে পারা। এই জ্ঞান শেখার পরের ধাপটি হচ্ছে যোগ্যতা। কিন্তু শুদ্ধ করে শেখার আগেই যদি তার যোগ্যতা যাচাই করা হয়, তাহলে সে ভালো করে কিছুই শিখতে পারবে না। পরীক্ষা দেওয়ার এই মহাযজ্ঞে পড়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পরীক্ষাকে আনন্দ না ভেবে মহা আতঙ্কে আছে। যার প্রভাব পড়ছে তাদের শরীর ও মনে।
পরীক্ষায় ভালো করার জন্য তাদের ওপর অভিভাবকের চাপ বাড়ছে। ওজনদার গাইড, টেস্ট পেপার ও কোচিং—এসব দেখে খুব কষ্ট লাগে। এ রকম না করে কি শিক্ষিত ও মানুষের মতো মানুষ হওয়া যায় না। এটা আসলে বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোর মতো। অনেক শিশুকে দেখেছি প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষার হলে কাঁদতে। কারণ, সে সব পারে। কিন্তু বেশি প্রশ্ন দেখে ভয় পেয়েছে। বেশি প্রশ্নের কারণে প্রশ্নপত্র বড় এবং ফন্ট ছোট হচ্ছে। সাধারণত প্রাথমিকের পাঠ্যবইগুলোর ফন্ট থাকে বড়। আর বাজারে যে নোট গাইড ও টেস্ট পেপার আছে, তার অক্ষরও ছোট, যা শিক্ষার্থীদের চোখে চাপ ফেলছে।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, যতই বলা হোক কোচিং, গাইড ইত্যাদি বন্ধ করার কথা, সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন করেও প্রকৃতপক্ষে তা রোধ করা যায়নি। বরং গাইড-ব্যবসায়ীরা যখন যে পদ্ধতি চালু হয়, সেভাবেই এসব গাইড নোট প্রকাশ করেন। অবাক লাগল, ২০১৩ সালে নতুন পাঠ্যসূচির বই শিক্ষার্থীদের হাতে আসার এক মাস আগেই বাজারে নতুন গাইড বেরিয়েছে। এটা তো সর্ষের মধ্যে ভূত!
যেটা প্রয়োজন তা হচ্ছে বাস্তবসম্মত বৈজ্ঞানিক ও শিশু মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় রেখে পাঠ্যক্রম নির্বাচন ও প্রশ্নপত্র তৈরি। সম্ভব হলে পরীক্ষার বেড়াজাল থেকে শিশুদের বের করে নিয়ে আসা, যাতে পরীক্ষা নয়, শেখার দিকটিই বেশি গুরুত্ব পাবে। প্রতিযোগিতা প্রতিযোগিতা করে এরই মধ্যে নতুন প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরকে শেষ করে ফেলা হয়েছে। সকাল থেকে রাত অবধি স্কুল ও কোচিং ছাড়া তাদের জীবনে আর কিছু নেই।
সামনে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা। এর আগেই প্রশ্নকাঠামো ও নম্বর বণ্টনে যথাযথ পরিবর্তন জরুরি। নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ৪০টার পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৩০টি, সংক্ষিপ্ত পাঁচটি ও কাঠামোবদ্ধ পাঁচটির বেশি প্রশ্ন রাখা সঠিক হবে না। সেই সঙ্গে পাঠ্যবহির্ভূত অনুচ্ছেদও বাদ দিতে হবে। শিশুদের পরীক্ষাভীতি কাটাতে হবে।
তাসনীম চৌধুরী
সহকারী শিক্ষক, লামা কাগাবলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মৌলভীবাজার।