পান্থ তুমি পথিকজনের সখা

‘মানব জনম সার, এমন পাবে না আর
বাহ্য দৃশ্যে ভুলো নারে মন’
কবির এই উক্তির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত শৈশবে। নিজের জীবনের প্রতিফলন দেখানোর ক্ষমতা থাকে খুব কমসংখ্যক মানুষের মধ্যে। কমরেড আবদুর রশীদ ভূঁইয়া সেই কমসংখ্যক মানুষের মধ্যে একজন। ৭ নভেম্বর ছিল তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
জাহেদ আলী ভূঁইয়া ও জোবেদা খাতুন দম্পতির ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয় এবং প্রথম পুত্র। ব্রিটিশ শাসনামলে শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে রেলওয়ে শ্রমিক আন্দোলন ছিল শক্তিশালী। সেই শক্তিশালী আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন রেলওয়ের সরকারী কর্মচারী জাহেদ আলী ভূঁইয়া। শৈশবে আবদুর রশীদ ভূঁইয়া বাবার কাছ থেকে মানবমুক্তির যে পাঠ গ্রহণ করেছিলেন, আজন্ম সেই পাঠ অনুশীলন করেছেন, প্রয়োগ করেছেন কর্মজীবনে।
পাকিস্তানি পর্বের সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠীর আমলে এ দেশের বাম আন্দোলন সম্মুখীন হয় প্রতিকূল পরিস্থিতির। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মেহনতি মানুষের মুক্তির আন্দোলন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় বিকাশের আন্দোলনে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে বামপন্থীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্রতী ছিলেন। আত্মগোপন করে, হুলিয়া মাথায় নিয়ে পুলিশের তৎপরতার মধ্যেও কমিউনিস্ট পার্টির বিস্তারের লক্ষ্যে নিরলস সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন।
দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ কয়েকজন সন্তান, যাঁদের আত্মত্যাগ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সর্বোপরি মেহনতি মানুষের মুক্তির আন্দোলনে নিরলস ভূমিকা অনুপ্রাণিত করেছিল অনেক তরুণ ও যুবককে। এ রকম একজন ছিলেন ডা. সৈয়দ খলিল উল্যাহ। চিকিৎসা পেশায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে তিনি টঙ্গী শিল্প এলাকায় কারখানার চিকিৎসকের চাকরিতে যোগদান করেন। লক্ষ্য ছিল এলাকায় অবস্থিত পার্টি সদস্যদের সহায়তায় পার্টি বিস্তৃত ও সংহত করা। কমরেড আবদুর রশীদ ভূঁইয়ার নাম ডা. সৈয়দ খলিল উল্যাহর মাধ্যমে জানতে পারি। যদিও রশীদ ভূঁইয়ার সঙ্গে দেখা ও পরিচয় হয় অনেক পরে, স্বাধীন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা মহানগর কমিটিতে তাঁর সঙ্গে একত্রে কাজ করার সুযোগ হয়।
তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল শ্রমিক আন্দোলন ও টঙ্গী শিল্পাঞ্চলের পার্টি ও গণসংগঠনগুলোয়। যেকোনো গণসংগঠনের অথবা পার্টির কাজে যাঁরা ঢাকা থেকে টঙ্গী যেতেন, তাঁদের যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল রশীদ ভূঁইয়ার বাসা। তিনি অথবা তাঁর স্ত্রী প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা শামসুন নাহার ভূঁইয়া আগত কর্মীদের কাজের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এ কারণে তাঁর বাসায় যেতে হয়েছে বহুবার। প্রতিবারই আন্তরিক আপ্যায়নে আপ্যায়িত হয়েছি।
এ কথা বলার প্রয়োজন হয়তো নেই যে এ রকম অনেক পরিবারের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মীয়তার বন্ধন। কারণ, তিনি পরকে করেছেন আপন এবং ঘরকে করেছেন বাহির। আবদুর রশীদ ভূঁইয়া কৈশোরকালে, দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে যুক্ত হন ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ১৯৬৫ সালে শামিল হন মূলধারার রাজনীতিতে। এর পর থেকে আজীবন সম্পৃক্ত থেকেছেন সমাজবদলের লড়াইয়ে। কখনো বা আমরা তাঁকে পাই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল সংগঠক হিসেবে। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, টঙ্গী-গাজীপুরে এমন কোনো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন নেই, যেখানে রশীদ ভূঁইয়া অনুপস্থিত।
আন্দোলন, সংগ্রাম ও সংগঠন যাঁর জীবনের প্রতিচ্ছায়া, তিনি পারিবারিক জীবনে যথেষ্ট দায়িত্বশীল। বাবার মৃত্যুর পর পড়াশোনার পাট শেষ না করে সংসারের হাল ধরেন। ছোট ভাইবোনদের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রগতিশীল মননের পরিচয় মেলে শামসুন নাহার ও তাঁর দাম্পত্য জীবনে।
শামসুন নাহার অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ও সুদক্ষ শ্রমিকনেতা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক আবহে কোনো নারীর সামগ্রিক শক্তি কখনোই সম্পূর্ণ বিকশিত হতে পারে না জীবনসাথির অকৃপণ সমর্থন ছাড়া। এখানে রশীদ ভাইয়ের উদার প্রগতিশীল মননের পরিচয় পাওয়া যায়। পরিবারের নানা অসুবিধা অগ্রাহ্য করে সার্বক্ষণিক নারীনেত্রী ও রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে অবদান রাখার ক্ষেত্রে তিনি কখনো স্ত্রীর পথরোধ করে দাঁড়াননি; বরং পাশে থেকেছেন, সহযোগিতা করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন যেকোনো রাজনৈতিক কর্মীর জন্য অনুসরণীয়।
শিক্ষা আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিপ্লবী একজন সংগঠক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখবেন, সে বিষয়ে কোনো দ্বিধা নেই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে, যুদ্ধ পরিচালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আবার এলাকায় ফিরে আসেন। দেশে ফিরে আসার পর সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন, রণাঙ্গনের বিভিন্ন অপারেশনসহ রাজনৈতিক কর্মসূচি সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও এলাকার কলকারখানা পুনর্গঠনের জন্য শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন নতুন ধারার শ্রমিক আন্দোলন। সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষক আন্দোলনে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন সংগঠিত করার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে নিজে অংশগ্রহণ করেছেন।
সুদূর প্রাচ্যের আইরিশ সংগীতজ্ঞ ও অধিকারকর্মী বোনা পল ডেভিড দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা সম্পর্কে বলেছেন, ‘অকটপতা ছাড়াই আশীর্বাদী। আপস না করেও ছিলেন সমঝোতাকারী।’ আবদুর রশীদ ভূঁইয়া জনগণের নেতা ও বন্ধু হিসেবে এ ধরনের আদর্শ ও কর্মধারার চর্চা করেছেন বাস্তব ক্ষেত্রে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে যেদিন শেষ দেখা, দেখেছি উপস্থিত সবার কথাই তিনি ভাবছেন, নিজের শরীরের কষ্ট ও অসুবিধার কথা বিবেচনা না করে।
বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেশ ও মাটির খাঁটি সন্তান রশীদ ভূঁইয়ার অভাব পরিলক্ষিত হবে সব ক্ষেত্রে। নির্লোভ, নিরহংকার, সুন্দর ও সুস্থ সমাজ নির্মাণে বিশ্বাসী কারিগর কমরেড আবদুর রশীদ ভূঁইয়া চিরজাগরূক থাকবেন মেহনতি, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের বহমান আন্দোলন-সংগ্রামে।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম: চিকিৎসক ও সহসভানেত্রী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।