মিসরের বিপ্লবীরা পরাজিত হয়েছে

কামাল গাবালা
কামাল গাবালা

প্রথম আলোর ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিদেশের বন্ধুরা এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। তাঁরা কথা বলেছেন বাংলাদেশ, গণমাধ্যম, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে। আজ প্রকাশিত হলো মিসরের সাংবাদিক ও আল–আহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কামাল গাবালার সাক্ষাৎকার।
মিসরের সাংবাদিক কামাল গাবালা সেখানকার সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম আল–আহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামাল আহমেদ
প্রথম আলো সম্প্রতি মিসরের গণমাধ্যমের সম্পাদকেরা সাবেক সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসির সরকারের প্রতি শর্তহীন সমর্থন ঘোষণা করেছেন। গত ২৬ অক্টোবর প্রকাশিত সেই ঘোষণায় সম্পাদকেরা সরকারের প্রতি তাঁদের সমর্থনের কথা ঘোষণা করে বলেছেন যে তাঁরা গণমাধ্যমে ‘সন্ত্রাসবাদ সমর্থনকারী উপাদানগুলোর অনুপ্রবেশ’ বন্ধ করবেন। একই সঙ্গে তাঁরা তাঁদের ভাষায় ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও নীতিগুলোর প্রতি সংশয় সৃষ্টি করে এবং সেনাবাহিনী, পুলিশ বা বিচার বিভাগের যেসব সমালোচনা তাদের ভূমিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, সেগুলো প্রত্যাখ্যান’-এর অঙ্গীকার করেছেন। ওই বিবৃতিকে সাংবাদিকদের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি এবং তাঁরা পাল্টা বিবৃতিতে বলেছেন যে সম্পাদকদের ঘোষণা বহুমতের ইতি ঘটাবে এবং তা সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের শাসনামলের পুনর্জীবনের শামিল। তাঁরা সম্পাদকদের উদ্দেশে বলেছেন, (মত প্রকাশের) স্বাধীনতা স্থগিত করে সন্ত্রাসবাদকে কখনোই পরাস্ত করা যাবে না।’ সম্পাদকদের ওই অবস্থান গ্রহণের কারণ কী?
কামাল গাবালা মিসরের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রধান সম্পাদকদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট সিসি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সবার সহযোগিতা চান। মিসরের স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো অধিকাংশই খুব বেশি দিনের পুরোনো নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সরকারি গণমাধ্যমগুলো সব সময়েই সরকারের কাজে সহযোগিতা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। তারা নাসেরকে যেভাবে সমর্থন করেছে, যেভাবে সাদাত ও হোসনি মোবারককে সমর্থন দিয়েছে। তারা মুরসির সময়েও সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তারা আসলে সরকারকে সমর্থন করেছে।
প্রথম আলো কিন্তু, বেসরকারি মালিকানাধীন স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোর পক্ষ থেকেও তাঁকে সমর্থনের কথা জানানো হয়েছে। সেটা কেন?
কামাল গাবালা  এটা কিছুটা বিস্ময়কর। এগুলোর মালিক প্রধানত সেসব ব্যবসায়ী, যাঁরা হোসনি মোবারকের ঘনিষ্ঠ। তাঁরা প্রেসিডেন্ট সিসির ভূমিকায় সন্তুষ্ট। তাঁরা জানেন যে মোবারক আর ক্ষমতায় ফিরতে না পারলেও তাঁর শাসনকালের সুবিধাভোগী এবং ক্ষমতাধরদের অনেকেই টিকে আছেন এবং টিকে থাকবেন। তাঁরাই এখন সিসিকে ঘিরে আছেন এবং তাঁর অবস্থানকে সংহত করায় সহায়তা করছেন। শুধু তাঁরা কেন, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো, নতুন গড়ে ওঠা দলগুলো সবাই প্রেসিডেন্ট সিসিকে সমর্থন দিচ্ছে। তিনি এই সমর্থন যে শুধু সংবাদপত্রগুলোর কাছ থেকে পাচ্ছেন তা নয়, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও তাঁকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আমার আশঙ্কা সেখানেই। সমর্থনটা শুধু সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকছে না, এটা সরকারের অন্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও ঘটছে। প্রেসিডেন্ট সিসি একজন সেনাপতি ছিলেন এবং সে কারণে তিনি ভিন্নমত বা বিরোধিতা সহ্য করতে অভ্যস্ত নন। ফলে মিসরে কোনো দিন বিরোধী দলকে মাথা তুলতে দেওয়া হবে না বলেই একটা আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
প্রথম আলো  প্রেসিডেন্ট সিসি তো বিচার বিভাগেরও সমর্থন পাচ্ছেন?
কামাল গাবালা মাঝেমধ্যেই তিনি বুঝিয়ে দেন যে তিনি একজন সেনা কর্মকর্তা। তিনি চান সেনাপতির আদেশে পুরো সেনাবাহিনী যেমন সাড়া দেয়, সেভাবে তাঁর কথায় পুরো দেশ সাড়া দেবে। তিনি এখন গণমাধ্যম থেকে সমর্থন পাচ্ছেন। প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ—সবার কাছে থেকে তিনি সমর্থন পাচ্ছেন। কিন্তু এ ধরনের নিরঙ্কুশ সমর্থনের পরিণতিতে মোবারক আমলের মতো শাসনব্যবস্থার পুনরাবির্ভাব ঘটতে পারে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে আমি সমর্থন করি, কিন্তু সেটা শর্তহীন হতে পারে না। তাহলে বিরোধী মত বলে কিছু থাকবে না। সেটা যাতে না হয়, সে জন্যই সাংবাদিকদের মধ্য থেকে সম্পাদকদের নিঃশর্ত সমর্থন ঘোষণার বিরোধিতা করা হচ্ছে। মোবারক আমলের শাসনব্যবস্থা আর প্রত্যাশিত নয়।
প্রথম আলো কিন্তু মিসর কি সে পথেই হাঁটছে না?
কামাল গাবালা আমি কিছুটা উদ্বিগ্ন। এখন পর্যন্ত আমরা যেভাবেই হোক ঠিক পথে আছি। কিছুটা বিচ্যুতি আছে, তবে ঠিক পথে চলার চেষ্টাটাও কম নয়। প্রেসিডেন্ট সিসি এখন ক্ষমতায় আছেন প্রায় পাঁচ মাস। তিনি যে একটি নতুন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন, তার কিছু আলামত দেখা যায়। তিনি রাজনীতিক নন, একজন সেনাপতি। সে জন্যই তিনি ভুল করলে আমরা সেটা ধরিয়ে দিতে চাই। কিন্তু সরকারের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁকে ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে চান না। তাঁরাই আসলে একটি নতুন স্বৈরাচারের ভিত রচনার পথে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছেন।
প্রথম আলো পার্লামেন্টের যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, সেটা কবে হবে? পার্লামেন্ট হলে বিরোধী দল গড়ে উঠবে? নাকি সেটাও একটা রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট হবে?
কামাল গাবালা এটা একটা বড় সুযোগ। এটা প্রমাণ করবে যে আমরা গণতান্ত্রিক বেসামরিক শাসনব্যবস্থার পথে যেতে পারব কি না। পার্লামেন্ট নির্বাচনেও দুটো রাজনৈতিক শক্তিই প্রধান হয়ে উঠবে বলে মনে হয়—ইসলামপন্থী ও মোবারক অনুসারীরা। মোবারক অনুসারীরা খুবই ধনী এবং তাঁদের নির্বাচনে খরচ করার মতো টাকা প্রচুর। সুতরাং, তাঁরা হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন। মোবারকের শাসনামলে যে রকমটি হতো, এখনো তাঁরা সেভাবেই টাকার জোরে প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচনী সাফল্য পেতে পারেন। ইসলামি দলগুলো বুঝতে পারছে যে তারা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে, ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার আশা হয়তো তারা করে না, তবে তারা দ্বিতীয় অবস্থানটি ধরে রাখতে সক্ষম হতে পারে। নির্বাচনে আসলে হারবে তরুণসমাজ, যাঁরা বিপ্লব করেছিলেন।
প্রথম আলো বাম-প্রগতিশীল শক্তিগুলো তাহলে মূলধারা থেকে পুরোপুরি ছিটকে পড়বে?
কামাল গাবালা এর মানে হলো আরেকটি বিপ্লবের সম্ভাবনা সূচিত হওয়া। মোবারক অনুসারীরা যদি আবারও সংগঠিত হয়, শাসনব্যবস্থায় যদি আবারও তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে বিপ্লবীদের সামনে আরেকটি বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া আর কি বিকল্প থাকতে পারে? এর মানে হচ্ছে মিসরে নিকট ভবিষ্যতে স্থিতিশীলতা ফিরবে না। সম্ভবত সে কারণেই প্রেসিডেন্ট সিসি বারবার নির্বাচন পেছাচ্ছেন। তবে আগামী বছরের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং দাতাদের শারম-আল-শেখে যে বৈঠক হওয়ার কথা আছে, তার আগেই তিনি এই নির্বাচন শেষ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রথম আলো মিসরের রাজনীতিতে ধনবান-সম্পদশালীদের যে ভূমিকার কথা আপনি বলছেন, তাঁদের মধ্যে একজন তো শতকোটি ডলারের টেলিকম সাম্রাজ্য—ওরাসকম টেলিকমের মালিক, নাগিব সোয়াইরিস—তিনি প্রেসিডেন্ট সিসির সবচেয়ে বড় সমর্থকদের একজন। এখন একটি রাজনৈতিক দলও প্রতিষ্ঠা করেছেন—ফ্রি ইজিপশিয়ান পার্টি। নির্বাচনে তাঁর ভূমিকা কী হতে পারে?
কামাল গাবালা তিনি জিততে পারেন, কেননা তিনি ধনী। তিনি খ্রিষ্টান, কপটিক খ্রিষ্টান। কপটিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায় তাঁকে সমর্থন করতে পারে। আর মিসরীয় জনগোষ্ঠীর ১৫ শতাংশ হচ্ছে কপটিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের। বিষয়টি কেউ না বললেও বাস্তবতা হচ্ছে এই সম্প্রদায়ের ভোটের কারণে নির্বাচনে তাঁর দলের কিছুটা সাফল্যের সম্ভাবনা আছে।
প্রথম আলো মিসরের বহুল আলোচিত বিপ্লবের সময় যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, সেটা তো পূরণ হয়নি। এমনটি ঘটল কেন?
কামাল গাবালা প্রথম ভুল হয়েছিল, গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য যে রোডম্যাপ ঠিক করা হয়েছিল, সেটিতে। যে তরুণ প্রগতিবাদীরা বিপ্লবের মূল শক্তি ছিলেন, তাঁরা অন্তর্বর্তী প্রশাসনেই কোণঠাসা হয়ে গেলেন। সেখানে মোবারক আমলের সুবিধাভোগী ও ইসলামপন্থীরা একধরনের সমঝোতায় পৌঁছাল। ইসলামপন্থীদের নির্বাচনী সাফল্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল। তবে দুই ধাপ পিছিয়ে গেলেও অন্তত এক ধাপ এগোনো গেছে। বেসামরিক গণতন্ত্রের জন্য প্রতিষ্ঠান গড়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হয়েছে। অবশ্য তা এখনো কার্যকর হয়নি। পার্লামেন্ট গঠনের পর তা পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার কথা। সেটা হলে মিসরের গণতন্ত্রের পথে প্রত্যাবর্তনের আসল প্রক্রিয়া শুরু হবে। সেটাই আমাদের আশা।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
কামাল গাবালা আপনাকেও ধন্যবাদ।