জাতিসংঘের নেতৃত্ব নির্বাচনের রাজনীতি

শশী থারুর
শশী থারুর

নির্বাচনের চক্কর দুনিয়াজুড়েই দীর্ঘ হচ্ছে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চাভিলাষী রাজনীতিকেরা প্রধান প্রধান রাজ্যগুলোয় ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। ওদিকে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও শুরু হয়ে গেছে। এটার পরিবর্তন হওয়া উচিত।
জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এত সতর্ক ঢঙে হয় যে তা একরকম গোপনীয় ব্যাপারই মনে হয়। এর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হল্লার কোনো তুলনাই হয় না। কারণ, মহাসচিব নির্বাচনের ভার শেষমেশ নিরাপত্তা কাউন্সিলের ১৫ সদস্যের হাতেই ন্যস্ত হয়, তাঁরা প্রার্থী ঠিক করে দেন আর সাধারণ পরিষদ সেখানে সিলমোহর মেরে দেয় (প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এরূপ ঘটেছে)। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে। ফলে অধিকাংশ সদস্য ভোট দিলেও তাঁদের এক রাষ্ট্রের ভেটোতেই সব শেষ হয়ে যেতে পারে।
এই বাছাই-প্রক্রিয়া আবার একটি অনানুষ্ঠানিক ঐকমত্যের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। সেটা হচ্ছে, প্রতি দুই মেয়াদ পর পর এই মহাসচিবের পদ বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বাঁটোয়ারা হবে। আজ ৪৩ বছর পর তা একরকম অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছেন কফি আনান, তাঁর আগে একজন আফ্রিকান মহাসচিব থাকলেও তিনি পর পর দুবার মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি খুবই জনপ্রিয় মহাসচিব ছিলেন। এই চক্র প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেই ১৯৭১ সাল থেকে। এ সময়ে পশ্চিম ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া প্রভৃতি মহাদেশ থেকে মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমান মহাসচিব বান কি মুন এখন দ্বিতীয় মেয়াদে কাজ করছেন, তিনি একজন দক্ষিণ কোরীয়। তবে এখন পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপ থেকে কেউ মহাসচিব হননি।
বস্তুত, পূর্ব ইউরোপ থেকে বেশ কয়েকজন শক্তিশালী প্রার্থী ইতিমধ্যে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যে সমর্থনলাভের প্রচেষ্টা শুরু করেছেন। সাবেক স্লোভেনীয় প্রেসিডেন্ট ড্যানিলো তার্ক এ দৌড়ে প্রাথমিকভাবে এগিয়ে আছেন, তিনি কফি আনানের সময় সহকারী মহাসচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমান ইউনেসকোর মহাপরিচালক ও জাতিতে বুলগেরীয় ইরিনা বোকোভা এবং দুজন স্লোভাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিরোস্লাভ লাজাক ও তাঁর পূর্বসূরি জাঁ কুবিসও এ দৌড়ে আছেন। আর রোমানিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিরসিয়া জিওআনাও এ দৌড়ে নাম লিখিয়েছেন। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ দেশের কাছে তাঁর বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে।
কথা হচ্ছে, এই পাঁচজন প্রার্থীর সবাই কূটনৈতিক মহলে পরিচিত, তাঁদের চারজনের আবার সরাসরি জাতিসংঘে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। ফলে পূর্ব ইউরোপে কোনো যোগ্য প্রার্থী নেই—এই পুরোনো রটনা এবার আর রটানো যাবে না। এবার পুরো সত্য কথা বলি, এই পাঁচজন প্রার্থীর সবাইকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি। আমি তাঁদের খুবই যোগ্য বলে মনে করি, এ পদ অলংকৃত করার সক্ষমতা তাঁদের আছে।
কিন্তু একটি ঝামেলা আছে, পূর্ব ইউরোপকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে রাশিয়া কোনোভাবেই ভেটো না দেয়। সাবেক পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদেক সিক্রোসকির মহাসচিব হওয়ার পথেই এটাই একমাত্র বাধা হতে পারে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ক্রেমলিন পূর্ব ইউরোপের যেকোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধেই ভেটো দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিম ইউরোপের প্রার্থী বা অন্যান্য গ্রুপের প্রার্থী যেমন নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘের বর্তমান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হেলেন ক্লার্কের আরেকটা সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে মহাসচিব পদে নারী প্রার্থীর যে আবেদন আছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।
তাহলে দুনিয়ার মানুষ কি একটি জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে পাবে? ২০০৬ সালের নির্বাচন ব্যাপক প্রচারণা পেয়েছিল, আমি সেখানে সাতজন প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলাম, প্রথমের সঙ্গে আমার ব্যবধান খুব বেশি ছিল না। সেবার প্রার্থীরা জাতিসংঘের আঞ্চলিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে বসেছেন, বার্ষিক আফ্রিকান সামিটে বক্তৃতা দিয়েছেন, এমনকি বিবিসিতে বিতর্কও করেছেন। শুধু এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিশ্লেষণের জন্য ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে।
এসব কিছু থেকেই বোঝা যায়, একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের লক্ষ্যের গুরুত্বের বিবেচনায় প্রার্থীদের জনসমক্ষে কথা বলতে দেওয়া উচিত। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা—এসব মানুষের জানা উচিত। এ বিষয়ে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম।
তবে শেষ পর্যন্ত এই গণবিতর্ক ফলাফলে তেমন একটা ভূমিকা রাখে না। যেমন, বান কি মুনের ক্ষেত্রেই তা দেখা গেছে, তিনি নির্বাচনের আগে বিবিসির বিতর্কে অংশ নেননি। প্রার্থীরা নিজেদের লক্ষ্য ও চিন্তার প্রচারণা করতে পারলে মানুষ যেমন তা জানতে পারে, তেমনি তাঁরাও জনসমর্থন পেতে পারেন। আর জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচনে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা যত খুশি তত প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।
তবে এটা বলছি না যে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফলাফল নির্ধারণে কোনো প্রভাব ফেলে না। ২০০৬ সালের দক্ষিণ কোরিয়া বছরব্যাপী একটি প্রচারণা কর্মসূচি হাতে নেয়, এতে বিনিয়োগের পরিমাণও ছিল যথেষ্ট। তারা নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি দেশকে লক্ষ্য করেই এ কর্মসূচি প্রণয়ন করে। প্রতিটি দেশের রাজধানী সফরে যান তাঁরা, যেখানে অনেক সময় দ্বিপক্ষীয় লাভালাভের মুলা ঝোলানো হয়েছে। অন্য প্রার্থীদের সে সময় বা অর্থ কোনোটাই ছিল না। বস্তুত, নিরাপত্তা পরিষদের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়াই এরূপ কর্মসূচি নিয়েছিল।
তবে দৃশ্যত যে উপসংহার টানা যায় সেটা হলো, এই নির্বাচনে প্রার্থীর লক্ষ্য, যোগ্যতা, ভাষাজ্ঞান, প্রশাসনিক দক্ষতা বা ব্যক্তিগত ক্যারিশমা—কোনো কিছুই প্রভাব ফেলে না। এটা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যরাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
এটা সাধারণত হয় না যে কোনো প্রার্থী স্থায়ী পাঁচ সদস্যের সমর্থন পেলে নিরাপত্তা পরিষদের বেশির ভাগ ভোট পাননি। কারণ, তাদের যত খুশি তত ভোট দেওয়ার ক্ষমতা আছে।
ফলাফল হচ্ছে, সবচেয়ে ‘কম গ্রহণযোগ্য প্রার্থী’ চাকরিটা পেয়ে যান। আর অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সামাজিক মিডিয়ার উত্থান, স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রসার ও প্রেসের আরও পরাধিকার চর্চা এ পরিস্থিতির মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারবে।
২০১৬ সালে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা পূর্ব ইউরোপীয় প্রার্থীদের জন্যই বাজি ধরবেন, যিনি স্থায়ী পাঁচ সদস্য, বিশেষ করে রাশিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন। প্রার্থীর ব্যাপারে কীভাবে ঐকমত্য হবে, তা কেউ জানে না। তবে এটা পরিষ্কার যে প্রার্থী এই খাপে পড়বেন না, তিনি নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবেন, যদিও চরিত্রগত দিকে থেকে সেটা হয়তো কোনো অনতিক্রম্য ব্যাপার নয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী।