রাজনীতিকেরা কি বুঝবেন?

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

রাজনীতিতে বেশ একটা বাগ্যুদ্ধ চলছে। কথার বল্লম ছোড়া হচ্ছে পরস্পরের প্রতি। জাতীয় নেতাদের নিয়ে কেউবা ছোট মুখে বড় কথা বলছেন, কেউবা কাউকে আখ্যা দিচ্ছেন অর্বাচীন বলে। একজন নেত্রী আবার বলেছেন ঢাল-তলোয়ার নিয়ে আন্দোলনে নামতে। তাঁর একজন অমাত্য বলেছেন, হুংকার দেবেন না। তাঁর নেত্রী যদি হুংকার দেন, তাহলে অপর নেত্রীর তখ্ত নড়বড়ে হয়ে যাবে।
এসব নিয়েও ক্ষমতাসীনেরা ব্যঙ্গ করেন, ওঁরা শুধু আওয়াজ দিতে জানেন, আন্দোলনের শক্তি নেই। তবে হয়তো একটা বাস্তব কথা বলেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জনগণ বিএনপিকে ভোট দিতে পারে, কিন্তু তার জন্য জীবন দিতে পারে না।
এই সব কথার ঝড়ের মধ্যে পড়ে ভাবি—তাই তো, বিএনপি এখন কী করবে? আর আওয়ামী লীগেরই বা এখন কী করা উচিত! পুরো কাহিনিটা আবার গোড়া থেকে ভাবতে বসি। সরকারের গত মেয়াদে আদালতের রায় এল তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতন্ত্রের মূল ধারণার পরিপন্থী। কাজেই এটা আর চলতে পারে না। তবে সংসদ চাইলে আরও দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে ফেলল। বিএনপি-জামায়াত জোট বলল, তারা এটা মানে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। তারা আন্দোলন শুরু করল। একবার একটা আলটিমেটাম দিয়ে খালেদা জিয়া বললেন, এর মধ্যে আলোচনা শুরু করা না হলে হরতাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে ফোন করলেন। তারপর ভাষণ দিয়ে বললেন, হরতাল প্রত্যাহার করুন। আলোচনা শুরু করি। খালেদা জিয়া হরতাল তুললেন না। সেদিনই বিএনপির হাত থেকে শেষ ট্রাম্পকার্ডটা ফসকে গেছে। ওই সময়ের সব জনমত জরিপেই বিএনপি এগিয়ে ছিল জনপ্রিয়তায়। তারা নির্বাচনে গেলে হাওয়া তাদের দিকে বইতে শুরু করত, আর সুযোগসন্ধানী প্রশাসন ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে তাদের দিকেই ঝুঁকে যেত, এই রকম একটা ধারণা প্রচলিত আছে। বিএনপি নির্বাচনে গেল না, জামায়াতের সঙ্গে মিলে নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলন শুরু করল।
সেই আন্দোলন এমনই ভয়ংকর যে এখন এ দেশের মানুষ আন্দোলন শুনলেই আঁতকে ওঠে! আবারও কি ট্রেনলাইন উপড়ে ফেলে নিরপরাধ
মানুষ হত্যা করা হবে? আবারও কি রাস্তায় বাসে, গাড়িতে, রিকশায় আগুন দেওয়া হবে, পেট্রলবোমা মারা হবে? পরীক্ষা দিতে পথে বেরিয়ে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যাবে শিক্ষার্থিনীর মুখ? বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন দেওয়া হবে? আগুন দেওয়া হবে স্কুলে, কলেজে, মাদ্রাসায়? নাগরিকেরা ভাবেন, তার চেয়ে এই ভালো আছি। ব্যারিস্টার মওদুদের কথাটাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা যায়, ভোট এলে দেখা যাবে তোমাকে ভোট দেব কি না, তাই বলে ওই আগুন-রক্ত-লাশ আর বার্ন ইউনিটে আহত মানুষের আর্তনাদের দিন আমরা আর দেখতে চাই না। কাজেই খালেদা জিয়া যখন ঢাল-তলোয়ারের কথা বলেন, তখনো আতঙ্কে মুখ শুকিয়ে আসে।
অন্যদিকে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন এই সরকার এবং সংসদ বেশ কতগুলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা পেয়ে গেছে। সম্প্রতি নির্বাচন করে কমনওয়েলথ সংসদীয় অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপারসন পদে বিজয়ী হয়েছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং আন্তর্জাতিক সংসদীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সাবের হোসেন চৌধুরী। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ।
তাহলে বিএনপি কী করবে? গণতন্ত্রে শক্তিশালী বিরোধী দল খুবই প্রয়োজন। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বিরোধী দল দুর্বল হয়ে যাওয়া মানে গণতন্ত্রের জন্য তা ভয়াবহ দুঃসংবাদ, কারণ তা সরকারের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করবে, এবং কে না জানে, পাওয়ার করাপ্টস এবং অ্যাবসোল্যুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোল্যুটলি।
আমরা জানি, এটা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জনগণ বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়নি। অর্ধেকের বেশি আসনে ভোটাভুটিই হয়নি। তাহলে এখন আমরা কী করব? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, এখন আমরা আরও বেশি গণতন্ত্রের চর্চা করব। কথাটা অনেকটা সোনার পাথরবাটি কিংবা চাঁদের অমাবস্যার মতো শোনাচ্ছে। বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল না, এমন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে আবার গণতন্ত্র কী! আমি বলি, এখনই আমাদের অধিকতর গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট না পেয়েও আদালতের রায়ে নির্বাচিত হয়ে গণতন্ত্র অক্ষুণ্ন রাখার অন্তত একটা উদাহরণ পৃথিবীতে আছে, তাহলো যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় বুশের প্রথমবারের নির্বাচন। চর্মচক্ষে দেখা গেল, তিনি কম ভোট পেয়েছেন, কিন্তু আদালত বললেন, তিনিই বিজয়ী। সেই দেশের মানুষ ও রাজনৈতিক দল তা মেনে নিল, কেউ আর টুঁ শব্দটি করল না।
এখন সরকারের কর্তব্য হবে গণতন্ত্রের সব আচার-আচরণ ব্যাপকভাবে চর্চা করা। বিরোধী দল ও মতকে দমন না করে কথা বলতে দেওয়া। গণমাধ্যমের কণ্ঠস্বরকে বাধাগ্রস্ত না করে মুক্তভাবে প্রকাশ হতে সাহায্য করা। সরকারি দল ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর কাজ হবে মারামারি, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, টেন্ডারবাজি, দখল থেকে দূরে থেকে দেশের মানুষের হৃদয় জয় করতে সচেষ্ট থাকা। নির্বাচন গণতন্ত্রের একটা স্তম্ভ, কিন্তু আরও অনেক শর্ত ও প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রের জন্য দরকার। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য অধিকার কমিশনকে কার্যকর করা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকর করা।
এই সব চাওয়া কি অরণ্যে রোদন মাত্র?
সারা পৃথিবীতেই একটা সাধারণ প্রবণতা হলো, দুটো রাজনৈতিক ধারা থাকে। একটা ডেমোক্র্যাট তো আরেকটা রিপাবলিকান। একটা কনজারভেটিভ পার্টি তো আরেকটা লেবার পার্টি। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আছে তো এখানে অবশ্যই আরেকটা ধারা থাকবে, এই ধারারই প্রধান প্রতিনিধি বিএনপি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কমিউনিস্ট ছিলেন না, তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নিজেই লিখেছেন, তিনি ছিলেন কাজের মানুষ, তাত্ত্বিক ছিলেন না। ১৯৭০-এর দশকে সমাজতন্ত্র খুবই জনপ্রিয় একটা ধারণা ছিল, এমনকি পাকিস্তানের পিপলস পার্টির ভুট্টোও তাঁর অর্থনৈতিক কর্মসূচি সমাজতান্ত্রিক হবে বলে ঘোষণা দিয়েই নির্বাচন করেছিলেন। বাংলাদেশের চীনাপন্থী সমাজতন্ত্রীরা বিশ্বাসই করতে পারেননি যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো গণতন্ত্রপন্থী নেতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারে। কারণ, তিনি বিপ্লবী ছিলেন না। এই চীনাপন্থীদের অনেকেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তাঁদের দলের নাম বদলাননি। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সমস্ত আওয়ামী লীগ-বিরোধীকে নিয়ে জিয়াউর রহমান যে বিএনপি গঠন করেন, তাতে যেমন রাজাকারদের ঠাঁই হলো, তেমনি তার একটা বড় অংশ জুড়ে রইলেন চীনপন্থী বামপন্থীরা। আওয়ামী লীগ ছিল প্রধানত কৃষকের দল। বিএনপি হলো সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের দল। চালচলনে জিয়াউর রহমান ছিলেন আধুনিকতর, তিনি ব্যান্ডসংগীতে পৃষ্ঠপোষকতা করলেন, শিশুপার্ক নির্মাণ করলেন এবং টেলিভিশনকে রঙিন করে দিলেন। দেশের তরুণ সমাজ সেই সময় বিএনপি ও জিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগল। স্ববিরোধিতায় আক্রান্ত জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দুয়ার খুলে দিলেন, আবার গোলাম আযমের বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধাদের উসকে দিলেন।
বিএনপি যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তার মূলে ছিল তা আওয়ামী লীগের চেয়েও আধুনিক ও প্রগতিশীল বলে নিজেকে পরিচিত করাতে পেরেছিল তরুণদের কাছে। এমনকি খালেদা জিয়া যে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হলেন, তাও তাঁর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আপসহীনতার ভাবমূর্তির কারণেই।
টেলিভিশনের আলোচনায় একজন বক্তা সেদিন বলছিলেন, আওয়ামী লীগ দুর্নীতিগ্রস্ত, কিন্তু তার বিকল্প কি বিএনপি? আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত, কিন্তু তার বিকল্প কি বিএনপি? তিনি বলছিলেন, আওয়ামী লীগের বিকল্প হতে পারে আরও প্রগতিশীল, আরও আধুনিক, আরও দক্ষ একটা রাজনৈতিক দল।
বিএনপির উচিত আরও আধুনিক আরও প্রগতিশীল হওয়ার চেষ্টা করা। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, পরাজিত শক্তির সঙ্গে কেন দেশের তরুণ সমাজ থাকতে চাইবে? বিএনপি এখন ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের আচরণ করছে। বিএনপির উচিত প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ যার প্রতিদ্বন্দ্বী, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য তার কিছু করার দরকার পড়ে না। এটা আমরা বলতে পারি, যে দল সর্বশেষ ক্ষমতায় আছে, তার বিরুদ্ধে নির্বাচন করলে জয়লাভ অবশ্যম্ভাবী, কারণ ক্ষমতাসীনেরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যে মানুষ দূর অতীত ভুলে বর্তমানের শাসকদের বিরুদ্ধে ভোট দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশে আবার কখন নির্বাচন আসবে, সেটা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। বিএনপির এখনকার বিবেচনা হওয়া উচিত, তার ভুলগুলোকে বিচার করা, ভুল নীতি ও কর্মপন্থা বর্জন করা। জামায়াতের সংস্রবে থেকে আন্দোলনের নামে যে ধ্বংসাত্মক কার্যাবলি পরিচালিত হয়েছে, তা থেকে দূরে থাকার অঙ্গীকার করা। যুদ্ধাপরাধী চক্রকে বর্জন করার প্রকাশ্য স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে নিজের পায়ে নিজের শক্তিতে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা।
সরকারের সামনে কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই। এটাই সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ। এই ধরনের ফাঁকা মাঠে খেলতে গেলে ভুল হবেই, এবং একটা ভুল আরেকটা ভুল ডেকে আনবে। আমরা যারা দেশের সাধারণ নাগরিক, তারা কিন্তু চাই গণতন্ত্র অব্যাহত থাকুক। সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্র সবচেয়ে ভালো স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে হাজার গুণ ভালো। আমরা চাই শিক্ষা-দীক্ষা, কাজের পরিবেশ। শান্তিতে ঘুমানোর সুযোগ। ঘরের বাইরে গিয়ে দিনের শেষে যেন প্রিয়জনের কাছে নিরাপদে ফিরে আসতে পারি। স্কুলে যেন সন্তানদের নিরাপদে দিতে পারি, নিরাপদে যেন তারা ঘরে ফেরে। যাতে দুটো খেতে পাই, পরতে পাই, আর নিজেদের পেশায়, ব্যবসায়, বাণিজ্যে, কৃষিক্ষেত্রে আয়-উন্নতি করতে পারি।
গণতন্ত্রের ২৪ বছরে দেশের মানুষের আয় বেড়েছে। বেকারের সংখ্যা কমেছে। ছাত্ররাও এখন অন্তত মোবাইল ফোনের বিল দিতে পারে। রাস্তায় নেমে জীবন যে তরুণেরা দিতে পারবে না, তা নয়। দেশের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়ার জন্য সব সময়েই তরুণ প্রজন্ম প্রস্তুত আছে। কিন্তু তারা এখন বোঝে যে, দেশের প্রয়োজন কোনটা! আপনি ক্ষমতায় যাবেন, কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করবেন, সে জন্য আমি কেন জীবন দিতে যাব?
রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের বাস্তবতার এই মৌলিক পরিবর্তনটা উপলব্ধি করতে হবে। তাদের নিজেদের বদলাতে হবে। নতুন দিনে নতুন রাজনৈতিক আহ্বান ও আবেদন নিয়ে নতুন প্রজন্মের সামনে হাজির হতে হবে। আজকের তরুণের সামনে আইডল হলেন সাকিব আল হাসান, ওয়াসফিয়া নাজরীন। আজকের দিনে তরুণদের সামনে আছেন বিল গেটস কিংবা জাকারবার্গ। স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করা যাবে না।
রাজনীতিকেরা কি তা কখনো বুঝবেন?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।