রাজনৈতিক স্বার্থে জনপ্রশাসনকে ব্যবহার

.
.

বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে, ন্যাড়া বারবার বেলতলায় যায় না। আর না যাওয়াটাই স্বাভাবিক। বেলের মতো ভারী ফল ন্যাড়া মাথায় পড়লে কী হতে পারে, তা সবাই বোঝেন। আর খুব ভালো করে বোঝার কথা ন্যাড়াদের। তবে বাংলাদেশের জনপ্রশাসন নামের প্রায় ন্যাড়া প্রতিষ্ঠানটি সম্ভবত এ সত্যটি অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছে না। তাদের মস্তক থেকে কেশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বেলতলায় গিয়ে তারা আহতও হয়েছে বারবার। তবু যাবে। এ যাওয়া থামানো যাচ্ছে না। অতীত করুণ পরিণতির নজিরও তাদের কাছে যথেষ্ট বিবেচিত হচ্ছে বলে মনে হয় না। কেননা, এ ধরনের অনেক ঘটনার পরও এই তো সেদিন প্রজাতন্ত্রের কিছুসংখ্যক কর্মচারী একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে গিয়ে দলের প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। অবশ্য তাঁদের সঙ্গে বেশ কিছু অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীও ছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যেতে পারেন। তবে যাঁরা চাকরিতে আছেন, তাঁরা তা করা আচরণবিধির লঙ্ঘন। ফলে তাঁরা সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিলবিধি অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন। দোষী প্রমাণিত হলে ভোগ করতে পারেন বিধিতে বর্ণিত সাজা।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য বাধ্যকরভাবে অনুসরণযোগ্য সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি ১৯৭৯ অনুসারে তাঁরা কোনো রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যেতে পারেন না। নিজেদের সুযোগ-সুবিধার জন্যও চাইতে পারেন না কোনো রাজনীতিকের সমর্থন। এমনকি কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে নিজদের মাঝে সভা-সমাবেশও করতে পারেন না। আর কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধানের অফিসে গিয়ে সাক্ষাৎ করে অভিযোগ জানানো, আশ্বাস দেওয়া কিংবা নির্দেশনা নেওয়ার সুযোগও তাঁদের নেই। তবু তাঁদের কেউ কেউ এ ধরনের কিছু করে চলছেন। আরও দুর্ভাগ্যজনক যে তাঁদের সে আচরণ যাদের পক্ষে যায়, সে রাজনৈতিক দল এটাকে সুযোগ হিসেবে নেয়। রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলাভঙ্গ বলে বিবেচনা করে না। স্মরণে রাখে না এ শৃঙ্খলাভঙ্গের প্রশাসনিক পরিণতি কী হতে পারে। কিন্তু নিজেদের বিপরীতে গেলে আবার সচেতন হয়ে ওঠে আইন ও বিধি প্রয়োগে।
রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের রাষ্ট্রটি একটি প্রজাতন্ত্র। এর শাসনকাজ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োজিত রয়েছেন কর্মচারী। আমাদের সংবিধান তাঁদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বলে আখ্যায়িত করেছে। মূলত সরকারের নীতি প্রণয়নে সহায়তা প্রদান ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাঁদের হাতে। এ শাসনব্যবস্থার কাঠামোটি উপমহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্র ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পেয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে এসব কর্মচারী অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ করলেও নিজেদের কার্যক্রমে ধরে রাখতে হয় নিরঙ্কুশ অরাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। তাঁদের নিয়োগ, পদোন্নতি থেকে শৃঙ্খলা সব বিধিবিধান এর আলোকেই তৈরি। এ ধরনের একটি অরাজনৈতিক জনপ্রশাসন দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেকোনো সরকারের নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত ও পরামর্শ দিতে পারে। আর বাস্তবায়নকালেও তারা পরিচয় দিতে পারে সাফল্য ও বিচক্ষণতার। উল্লেখ্য, পর পর বেশ কয়েকটি সরকারের ক্ষুদ্র স্বার্থের বলি হয়ে এর নিয়োগ, পদোন্নতি আর পদায়নে মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তদুপরি দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের জনপ্রশাসন কিছুসংখ্যক সদস্যের জন্য রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্যটিও হারাতে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
সূচনা বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম ঘটেনি। ঘটেছে অতীতেও। ১৯৯৬ সালের মার্চে সরকারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে তখনকার বিরোধী দল আয়োজিত মঞ্চে জনপ্রশাসন কর্মচারীদের কিছুসংখ্যকের অংশ নেওয়া অনেকটা অভিনব ঘটনা ছিল। এটা প্রশাসন ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এতে তখনকার মতো কেউ লাভবান হয়েছিলেন। তবে পাঁচ বছর পর সরকার পরিবর্তন হলে চরম মাশুল দেন অনেকে। সে আক্রোশের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে সে মঞ্চের ধারেকাছে যাননি এমন অনেকেও চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। এসব ব্যবস্থা নিতে তখনকার সরকার, প্রচলিত বিধিবিধানের ধার না ধেরে, কোনো তদন্ত না করে, কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অবসরে পাঠায় বহু কর্মচারীকে। অবশ্য এর আগেও ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও এমনি কিছু কর্মচারী নির্বাচন প্রভাবিত করার লক্ষ্যে একটি রেস্তোরাঁয় মিলিত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তখনকার সরকার তাঁদের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বিরত রাখে। আবার ২০০৬ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের শাসনকালে উত্তরায় একজন রাজনৈতিক নেতার উদ্যোগে বেশ কিছু কর্মচারী একত্র হন। এখানেও অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের লক্ষ্য ছিল ২০০৭ সালের সূচনায় অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন প্রভাবিত করা। সচেতন গণমাধ্যমে এর সচিত্র প্রতিবেদন এসেছে। সে সময়কার মতো কিছু না হলেও এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের সবাইকে ওএসডি করা হয়। রুজু হয় বিভাগীয় মামলা। ধারণা করা হয়েছিল, এত কিছুর পর এসব আর ঘটবে না। কিন্তু সকলই গরল ভেল।
প্রশ্ন থাকে, সম্প্রতি তাঁরা কেন গেলেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের কাছে, তিনিই বা কেন তাঁদের সঙ্গে কথা বললেন। যদিও তাঁদের দল থেকে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ দেওয়া হয়েছে, বাস্তবতা কিন্তু চেপে রাখা যায়নি। তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল কেউ কেউ বলেন, দীর্ঘদিন ওএসডি থাকা ও বারবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে তাঁরা মরিয়া হয়ে কাজটি করেছেন। এতে কি তাঁদের বঞ্চনার প্রতিকার হবে? এটা সত্যি, কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা আজ প্রায় ছয় বছর ওএসডি হয়ে আছেন। একইভাবে অকারণ পদোন্নতিবঞ্চিতদের সংখ্যাও অনেক। কয়েকজনকে দেওয়া হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসর। এতে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে। এ-জাতীয় ক্ষোভ কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার সৃষ্টি করবে না, এমনটা বলা যায় না। কথিত অপরাধের শাস্তি বিধানের উদ্যোগ যারা নিচ্ছে, তাদের পাশাপাশি এ ধরনের ক্ষোভ নিরসনের ব্যবস্থাও নেওয়া যুক্তিসংগত হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইদানীং পুলিশসহ প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীর ওপর অধিক হারে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এটা করতে সরকারি দলের সুযোগই বেশি। বিরোধী দলও থেমে থাকে না। তারা তাঁদের সমর্থন টানতে চায়। আর প্রজাতন্ত্রের কিছু কর্মচারী চাপ, সাময়িক মোহ, ক্ষোভ আর যা-ই হোক সব মিলে কোনো না কোনো দিকে ছুটছেন। কাউকে দল ডাকছে। কেউ বা উমেদারি করে দলের লোকের সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গোপন পরিচিতি লাভের প্রচেষ্টায় রয়েছেন। তাঁরা ভাবেন, কোনো দল ক্ষমতায় থাকলে বা এলে তাঁদের লাভ কতটুকু। লাভবান হচ্ছেনও বটে কেউ কেউ। তবে ঝুঁকিতে থাকছেন সত্যিকার নিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। তাঁদের একটি অংশ মাঝেমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। অথচ তাঁদের সংখ্যাই আনুপাতিক হারে অনেক বেশি। অতীতেও এ প্রবণতা লক্ষণীয় হয়েছে। আর এখনো তা বহাল তবিয়তেই আছে। ফলে জনপ্রশাসনের কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে। জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা।
রাজনৈতিক দলগুলো হয়তোবা ভাবে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন বা টিকিয়ে রাখবেন। সত্যিকার অর্থে তাঁরা এর কোনোটাই করতে পারেন না। তবে জনগণ কাউকে বা কোনো দলকে ক্ষমতায় রাখতে না চাইলে কর্মচারীরা তা ঠেকিয়ে রাখতে পারেন না। তাঁরা একপর্যায়ে তা করেনও না। ১৯৯০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক তেমনি ক্ষমতায় যেতে হলেও জনসমর্থন নিয়ে যেতে হয়। এতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকেন না। সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে কর্মচারীদের ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়।
রাজনৈতিক দল গড়তে, ক্ষমতায় যেতে ও ক্ষমতায় টিকে থাকতে কর্মচারী–নির্ভরশীলতা আমাদের বরেণ্য নেতাদের কারও আবশ্যক হয়নি। আবশ্যক হয়নি বঙ্গবন্ধুর। তেমনি আবশ্যক হয়নি শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী বা মওলানা ভাসানীর। তাঁরা জনগণকে নিয়ে রাজনীতি করেছেন। কমর্চারীদের কখনো পক্ষ বা প্রতিপক্ষরূপে নেননি। মনে হচ্ছে, এখনকার রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমান্বয়ে জনগণের পাশাপাশি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা টিকে থাকার জন্য। এতে জনপ্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি দৃশ্যমান হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক দীনতা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]