একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও তরুণ প্রজন্ম

এই তরুণেরাই বাংলাদেশকে বদলে দেবে
এই তরুণেরাই বাংলাদেশকে বদলে দেবে

একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ স্নাতক শ্রেণিতে পড়তাম। সেদিন আমি ছিলাম সিলেটে এবং সারা দিন রেডিওর সামনে বসে জানতে চেষ্টা করেছি ঢাকায় কী হচ্ছে। রমনা রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের খবর পেয়ে সবাই রাস্তায় বেরিয়ে এসে উল্লাস করেছে। সেই উল্লাসে আমার আনন্দ-আবেগ যোগ হয়েছে, কিন্তু সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে অত্যন্ত বিষণ্ন²ও বোধ করেছি। প্রতিটি পরিবারই আপনজন হারিয়েছে, আমার মা হারিয়েছেন তঁার অনুজকে, আমি হারিয়েছি আমার তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। তঁাদের স্মরণে এনেছি এবং ভেবেছি, এই যে আত্মদান তঁাদের, এটিই তো ভিত গড়ে দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতার। তঁাদের আত্মদান উদ্যাপন করেছি, তঁাদের অভাবটা অনুভব করতে করতেই। একসময় ভেজা চোখ শুকিয়েছে, একটা ভিন্ন অনুভূতি এসেছে মনে। যঁারা চলে গেলেন, তঁারা বীর, তঁাদের চলে যাওয়াটা মহাপ্রস্থান। এর অভিঘাতটা তো বিশাল! সে রাতে আমার মনে হয়েছিল এই জাতির আবেগে-অহংকার-ভালোবাসায় চিরদিনের মতো তঁারা আসন পেতে নিলেন।
একাত্তরের এই দিনটি আমাদের বিজয় দিবস। সে দিবস নিয়ে সেদিনের তরুণ আমার ভেতর যে গর্ব এবং অহংকার ছিল, যে প্রত্যয় এবং নিশ্চিতি ছিল, তা কোনো দিন আমি হারাতে দিইনি। আমার বন্ধুরাও একই আবেগ এবং আত্মবিশ্বাস লালন করেছে বিজয় দিবসকে নিয়ে। কিন্তু পঞ্চম বিজয় দিবসের আগেই দেশের ভেতর শুরু হলো নানা অদলবদল। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তঁার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ মেরে ফেলা হলো পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। সেনাবাহিনীর কিছু পেছনপন্থী লোক এবং একাত্তরের পরাজিত ব্যক্তিদের একটি দল মিলে ঘটনাটা ঘটাল, তাদের সঙ্গে জুটলেন বঙ্গবন্ধুর একসময়ের সহচর এক প্রতারক রাজনীতিবিদ এবং তঁার কিছু শাগরেদ। এরা সবাই মিলে দেশটাকে পাকিস্তানি অতীতে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। তারা মনে-প্রাণে পাকিস্তানের সেবক ছিল, পুরোনো মুনিবকে ছেড়ে শিরদঁাড়া উঁচু করে দঁাড়াতে তাদের মন সায় দিচ্ছিল না। এরপর আরও অদলবদল হলো। এরা টিকে থাকতে পারল না। দেশে এল সামরিক শাসন। ছদ্মবেশী সামরিক শাসন। দীর্ঘদিন একাত্তরকে বুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো। যে ইতিহাসের আমরা ছিলাম সাক্ষী, তা পাল্টে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হলো, তঁাকে ছাপিয়ে একাত্তরের গৌণ নানা চরিত্রকে মুখ্য করা হলো। সে এক হাস্যকর কিন্তু ভয়ানক প্রয়াস। এর প্রভাব পড়ল শিশুদের ওপর, স্কুলের শিক্ষার্থীদের ওপর। একসময় স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও দেখা গেল ভ্রান্ত এবং তৈরি করা ইতিহাসের কারচুপি।
বাঙালির সবচেয়ে গৌরবের জায়গাটায় এভাবেই খড়্গ ফেলল পেছনপন্থীরা, অন্ধকারের যাত্রীরা। কিন্তু তাদের অনেক উদ্যোগ, অনেক প্রস্তুতিও তাদের সফলতা দিতে পারেনি। তারা কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, ধর্ম ও উগ্রবাদকে সমর্থক করে।
এই উপমহাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ বাড়ছে বড় তিনটি দেশেই। এর প্রভাব পড়ছে তরুণদের ওপর। বাংলাদেশে এর একটি প্রকাশ একাত্তরের চেতনার বিরোধিতা। কিন্তু মানুষ সত্য-মিথ্যার প্রভেদ বোঝে ধর্ম-অধর্মের ফারাকটা বোঝে। সে জন্যই একাত্তরের ফিরে আসা।
একসময় আমার ধারণা হতো, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বোধ হয় আর দশটা ইতিহাসের মতো শুধু পাঠ্যবইয়ে জায়গা করে নেবে, কেউ এসে যদি মাঝখানের ভুলগুলো, চালাকিগুলো শুধরে দেয়, তার পরও। আমি ৪০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিদিন যাদের সঙ্গে আমার ওঠাবসা, যাদের নিয়ে আমার নিত্যদিনের সংসার, তাদের বয়স ১৮ থেকে ২৪। তাদের ঘনিষ্ঠভাবে জানি বলে এই ৪০ বছর ধরে তরুণদের চিন্তাভাবনাগুলো আমি অনুসরণ করতে পেরেছি। একটা সময় টের পেয়েছি, তৈরি করা ইতিহাসের প্রভাবেই হোক, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির নিষ্ক্রিয়তার কারণেই হোক, একাত্তরের অভিঘাতটা এসব তরুণের ওপর আর তেমন পড়তে পারেনি। কেমন যেন পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল অনেক তরুণ। নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই যেন সংকটে পড়েছিল তারা।
কিন্তু সেই অমানিশা দীর্ঘ হয়নি। আশির দশকের শেষ বছরটি যেন ঘোষণা দিল দেশ জাগছে। দেশ জাগল। একটা অমানিশার কাল শেষ হলো। অপশাসন থেকে বেরিয়ে গণতন্ত্রের পথে ফিরল দেশটি। কিন্তু যে সরকার ক্ষমতায় এল, একাত্তর নিয়ে তার হিসাবটা থাকল গোলমেলে। বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে তারা রাজি ছিল না, দেড় দশকের তৈরি ইতিহাসটা জারি রাখতেই ছিল তাদের উৎসাহ। কিন্তু গণতন্ত্রের সুবিধা এই, মানুষ কথা বলতে পারে, প্রতিবাদ জানাতে পারে। ইতিহাস নিয়ে, জাতির গর্বের ঘটনাগুলো নিয়ে, জাতির প্রকৃত নায়কদের নিয়ে তামাশা করাটা তাই একসময় কঠিন হয়ে পড়ল।
ঠিক যখন আমি হতাশ হয়ে ভাবতে বসেছিলাম, বিজয় দিবসটা বোধ হয় নতুন উৎপাদিত ইতিহাসের একটা চাপিয়ে দেওয়া সরকারি মহড়া হয়েই থেকে যাবে, আমার মতো একে নিয়ে আবেগ-অহংকার দেখানোর মতো তরুণদের কোনো সমাবেশ এদিন আমি দেখতে পাব না, তখনই যেন সময়ের ম্রিয়মাণ নদীতে একটি স্রোত জেগে উঠল। একাত্তরের নদীটা প্রাণ ফিরে পেল।
এখন তরুণদের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি নেই। একাত্তর দেখা দিয়েছে আপন মহিমায়, তার প্রকৃত ইতিহাসের শক্তিতে। এর পেছনে আছে ওই তরুণদেরই সমর্থন। গত ৪০ বছর যে কাজটি হয়েছে, তা হচ্ছে লেখালেখির মধ্য দিয়ে, সংস্কৃতির নানা মাধ্যমে, খবরের কাগজে একাত্তরকে নিয়ে নিরন্তর চর্চা হয়েছে এবং চর্চা যাঁরা করেছেন, একাত্তর নিয়ে তাঁদের আবেগ-অহংকার-ভালোবাসাটা প্রবল। মুক্তিযোদ্ধারা লিখেছেন, অমুক্তিযোদ্ধারাও। সাহিত্যে-মঞ্চনাটকে, নৃত্যে, চলচ্চিত্রে, চিত্রকলা-ভাস্কর্যে, গানে এবং যাত্রাপালায় মুক্তিযুদ্ধ একটা বিশাল আসন করে নিয়েছে। সরকারি এবং পেছনপন্থী অপপ্রচারের বিপরীতে এই সুস্থ চর্চা মুক্তিযুদ্ধকে মানুষের চেতনার গভীরে নিয়ে গেছে, যে গভীরে সংস্কৃতির খোলা হাওয়াই শুধু ঢুকতে পারে। তারপর যখন নতুন প্রযুক্তি এল, মুঠোফোন আর ইন্টারনেট সহজলভ্য হলো, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তরুণদের মন জয় করে নিল, মুক্তিযুদ্ধের কথা-গান-ছবি-ইতিহাস দ্রুত একজন থেকে এক লাখ জনের কাছে পৌঁছে যেতে লাগল। পেছনপন্থীরাও এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তাদের প্রয়োজনে, কিন্তু তাদের জন্য বড় প্রহসনটা এই—এসব প্রযুক্তি যারা তৈরি করেছে, তারা তা করেছে মানবের অগ্রযাত্রার জন্য, পেছন যাত্রার জন্য নয়। এই প্রযুক্তিই এদের সব চক্রান্তকে একসময় নস্যাৎ করার কাজে বড় ভূমিকা রেখেছে।
এখন কোনো তরুণকে বিজয় দিবস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলে মন প্রসন্ন করা উত্তর পাবেন। এই দিনটি তাদের জন্য ইতিহাসের আর দশটা দিনের মতো নয়। এটি নতুন বাংলাদেশের জেগে ওঠার দিন। এই দিন সারা দিন উৎসব হয়। আগে হতো ঢাকা, চট্টগ্রামে। এখন গণ্ডগ্রামেও। সারা দিন লাল-সবুজ পাজামা-পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে তরুণেরা ঘুরে বেড়ায়, জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রাঙ্গণ ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়, কয়েক ঘণ্টা লাইনে দঁাড়িয়ে মানুষ ফুল দিয়ে আসে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে। সারা দেশের তরুণেরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, গানের কনসার্ট হয়। বাংলাদেশে এখন ২০-২৫টার মতো টেলিভিশন চ্যানেল, প্রায় সবগুলোতে সরাসরি অনুষ্ঠান দেখানো হয় সারা দেশের অসংখ্য জায়গা থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো এলাকা এতটা লোকারণ্য হয়ে ওঠে যে ঘর থেকে বের হতে সাহস হয় না। কিন্তু কোথাও কোনো অরাজকতা নেই। উচ্ছৃঙ্খলতা নেই।
উৎসবটা ক্রমাগত বাড়ছে ব্যাপ্তি, আবেগ আর গভীরতায়। এখন বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা, মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কর্তৃত্ব করা—এসব তরুণের কাছে ঘৃণিত কাজ। তরুণেরা বলছে, অনেক হয়েছে, আর না।
তরুণেরা ষোলোই ডিসেম্বরের আবেগ আর অহংকারটা ধরতে পেরেছে। এর একটি কারণ অর্থনীতি-সংস্কৃতি-মানব উন্নয়ন-শিক্ষা-খেলাধুলা সবকিছুতেই বাংলাদেশের জেগে ওঠা। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশ্বমন্দার কালেও বেগবান ছিল, ৬-এর ওপর এর প্রবৃদ্ধির হার গত দেড় দশকজুড়ে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে, নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপন হচ্ছে, রপ্তানি বাড়ছে, প্রবাসীরা বিশাল অঙ্কের টাকা পাঠাচ্ছেন দেশে। বাঙালি দীর্ঘদিনের দুর্নাম ঘুচিয়ে অসম্ভব পরিশ্রমী আর উদ্যোগী বলে নিজেকে প্রমাণ করেছে। এবং যারা বাংলাদেশের অর্থনীতির পালে জোর হাওয়া দিচ্ছে, উদ্যোক্তা ও শ্রমদানকারী, উভয় শ্রেণিতে তারুণ্যের প্রাধান্য। শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, মেয়েদের প্রতি বৈষম্য কমছে। ঘরের চার দেয়ালের ভেতর বন্দী না থাকার প্রত্যয় জানিয়ে মেয়েরা কাজে নেমেছে, বিমানের চালক থেকে নিয়ে শিল্পোদ্যোক্তা—মেয়েরা সব ক্ষেত্রকে আপন করে নিচ্ছে।
বিজয় দিবস এখন তরুণদের। এখন চারদিকে তাকালেই দেখতে পাই, একাত্তরের মূল ভূমিতেই তারা ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। এখন এর মালিকানাও তাদের।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।