বিবেকবর্জিত আমলা ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিকেরা জোটবদ্ধ

আকবর আলি খান
আকবর আলি খান

আকবর আলি খান ১৯৭১ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এ কারণে পাকিস্তান সরকার তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সালের জুন পর্যন্ত সরকারের অর্থসচিব ছিলেন। ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষে গঠিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর ডিসেম্বর মাসে পদত্যাগ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিস্টোরি অব বাংলাদেশ, ডিসকভারি অব বাংলাদেশ, পরার্থপরতার অর্থনীতি, ফ্রেন্ডলি ফায়ার্স, হাম্পটিডাম্পটিডিজ অর্ডার অ্যান্ড আদার এসেজ। প্রথমা প্রকাশিত গবেষণাজাতগ্রন্থ চাবিকাঠির খোঁজে: নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন তাঁর শেষ প্রকাশিত গ্রন্থ।

প্রথম আলো lমুজিবনগর সরকারের অন্যতম কেন্দ্রীয় কর্মকর্তা ছিলেন আপনি; প্রশাসন ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেছেন। বিজয়ের ৪৩তম বার্ষিকীর ক্ষণে বাংলাদেশের সাফল্য-ব্যর্থতার যাত্রার মূল্যায়ন কীভাবে করবেন?
আকবর আলি খান l বাংলাদেশের অর্জন অনেক। ১৯৭১ সালে যা প্রত্যাশা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি আমরা করতে পেরেছি। কিন্তু এত সব পাওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে, এখনো অনেক অপূর্ণতা রয়েছে। আমরা মাথাপিছু আয় তিন গুণের মতো বাড়িয়েছি, খাদ্য উৎপাদন সাড়ে তিন গুণের মতো করেছি, গড় আয়ুর প্রত্যাশা অনেক বাড়িয়েছি, শিক্ষার হারেও সফলতা অর্জন করেছি, শিশুমৃত্যুর হারে সাফল্য এনেছি। এভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে আমাদের অর্জন রয়েছে। তবু মনে রাখতে হবে, এই অর্জন ভঙ্গুর। যেমন বলা হয়ে থাকে, জাতীয় দারিদ্র্যসূচকের আলোকে বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমা ছিল ৭০ শতাংশ। সেটা কমে ২৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। বক্তব্য সঠিক, কিন্তু বুঝতে হবে যে, এ হিসাব করা হয়েছে জাতীয় সূচকের ভিত্তিতে। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার হিসাব দেখলে, অর্থাৎ দৈনিক ২ ডলার পিপিপি মাথাপিছু আয়ের নিরিখে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার এখনো ৮০ শতাংশের বেশি।

আমরা যখন আনন্দ প্রকাশ করি যে জাতীয় দারিদ্র্যসীমা জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে কমেছে, তখন আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আন্তর্জাতিক সূচকে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। আমাদের জাতীয় আয়ের সূচকে বাড়িভাড়া ও স্বাস্থ্য খরচ ধরা হয়নি। বর্তমান দুনিয়ায় এই দুটি উপাদান দারিদ্র্য নিরূপণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বস্তিতে লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে, কিন্তু মানুষ না খেয়ে নেই। খেতে পাওয়া ছাড়া আরও যেসব জরুরি শর্ত আছে, সেগুলোর নিরিখে আমাদের আরও অনেক কিছু করার রয়েছে। সামগ্রিকভাবে আমরা একদিকে উৎফুল্ল হতে পারি, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তারও কারণ রয়েছে।

প্রথম আলো lবাংলাদেশ দুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে’—এমন কথা বলেছিলেন কদিন আগে। এ অর্জনগুলোর মধ্যে দুর্বৃত্তায়ন কীভাবে হলো?

আকবর আলি খান lদুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্য আমি যে অর্থে বলেছি, সেটা কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলছে। আমাদের দেশে বাইরের দিকে আইনের শাসন রয়েছে, কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষ আইনের শাসনের উপকার পায় না। তার একটা কারণ, আদালতে নালিশ করলে বিচার সহজে হয় না। এবং এটা করতে এত সময় লাগে, তখন বিচার প্রায় অর্থহীন হয়ে যায়। বিশেষ করে পুলিশের তথ্য দেখলে দেখা যায়, পুলিশ যেসব ক্ষেত্রে চার্জশিট দেয়, সেখানে বড়জোর শতকরা ২৫ ভাগ আসামি দণ্ডপ্রাপ্ত হয়। চার্জশিট তো সব মামলায় হয় না। সুতরাং এফআইআরের ভিত্তিতে দেখলে মাত্র ১০-১২ ভাগ আসামির বিচার হচ্ছে। এর অর্থ বাংলাদেশে অপরাধ করলে বিচার না হওয়ার আশঙ্কা ৮০-৯০ শতাংশ। পুলিশ ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন না হলে এটা আরও বিস্তৃত হবে। এ অর্থেই বলছি, বাংলাদেশে দুর্বৃত্তদের কোনো সাজা হয় না। সাজা না হলে তো দেশ দুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে। সে জন্যই বলছি, সুশাসন না থাকা হলো আমার প্রথম বেদনা। রাশ না টা​নলে অবস্থার আরও অবনতি ​হবে। 

প্রথম আলো lসম্প্রতি প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে যে বিতর্ক উঠেছে, সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, রাষ্ট্র প্রশাসনের দলীয় ভাগে বিভাজিত হয়ে যাওয়াটা কিসের ইঙ্গিত?

আকবর আলি খান lবাংলাদেশের প্রশাসনের অবস্থা বুঝতে হলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ল্যান্ট প্রিচেটের সুন্দর একটি তত্ত্ব খুবই প্রযোজ্য। তিনি বলছেন, বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুকরণ করা হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাণশক্তি এখানে নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি বলছেন আইসোমরফিক মিমিক্রি, অর্থাৎ সমরূপ কিন্তু কার্যক্ষমতাহীন—এমন একটি অবস্থা। ধারণাটা নেওয়া হয়েছে বিবর্তনবাদী জীববিদ্যা থেকে। সেখানে দেখা যায়, অনেক সময়ে অনেক প্রাণী ভান করার চেষ্টা করে। যেমন একধরনের সাপ আছে, যাদের বিষ নেই। এই সাপগুলোকে মানুষ মেরে ফেলবে সে জন্য দেখা গেল, তারা নীল হয়ে গেছে। দেখলে মনে হয় এগুলো অসম্ভব বিষাক্ত। কিন্তু আসলে মোটেই তা নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে যে ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো ওই সাপগুলোর মতো। দেখে মনে হয় সবই ঠিক আছে, আসলে মোটেই ঠিক নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশরা এ দেশে প্রতিষ্ঠা করে গেছে। ব্রিটিশ শাসনের মূল ভিত্তি ছিল আইসিএস অফিসাররা। এক হাজার আইসিএস অফিসার দিয়ে তারা সারা ভারতবর্ষ শাসন করত। এই শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল: উন্নতি হোক বা না হোক, দেশবাসীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেই নিয়ন্ত্রণে তারা রেখেছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলেনি। এ অবস্থায় আইসোমরফিক মিমিক্রির ধরনের সমাধান করতে হলে দেশীয় আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

প্রথম আলো lএটা তো গেল অবিকশিত প্রশাসনের সমস্যা, কিন্তু আমরা যা দেখছি তা হলো, প্রশাসনের সম্পূর্ণ দলীয়করণ?

আকবর আলি খান l বাংলাদেশে বর্তমানে যে আমলাতন্ত্র আছে, সেটাও আইসোমরফিক মিমিক্রি। বাইরে থেকে দেখতে মনে হয়, এটা সঠিক আমলাতন্ত্র। এখানে নিয়োগ হয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে, এখানে সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতি হয় আইন মেনে, আইন মেনে তাঁরা কাজ করে যান। কিন্তু আসলে এগুলো কোনোটাই সত্য না। কারণ হলো দুটি: প্রথমত, রাজনীতিবিদেরা আমলাতন্ত্রের সুশৃঙ্খল কাঠামো পছন্দ করেন না, এর সঙ্গে তাঁদের কাজ করতে অসুবিধা হয়। এর কারণে তাঁরা তাঁদের আধিপত্য খাটাতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে আগে একটা শৃঙ্খলা ছিল। এখন আমলাদের মধ্যেও ভাব চলে এসেছে যে, আমরা যদি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করে এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে অসুবিধা কোথায়! সুতরাং এখানে বিবেকবর্জিত সরকারি কর্মচারী এবং ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের মধ্যে একধরনের কোয়ালিশন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি যেহেতু দুই দলে বিভক্ত, সেহেতু দুই সারি কোয়ালিশন হয়েছে। আমরা দেখি, এক সরকার এলে পরে আগের সরকারের প্রিয়ভাজনদের চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়। আবার আগের সেই সরকার ক্ষমতায় ফিরে এলে তাদের সব সুযোগ–সুবিধা ও পুরোনো পদোন্নতি দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের রাজনৈতিকীকরণ সম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে ভালো লোকের পদোন্নতির উপায় নেই। এতে করে খারাপ লোকেরা সবকিছুর অগ্রভাগে চলে আসছে।

প্রথম আলো l সম্প্রতি সরকারের বিভিন্ন নেতার কণ্ঠে মার্কিন সরকারের বিষোদ্‌গার শোনা যাচ্ছে। আবার এই আমলেই টিকফা চুক্তি হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও বিভিন্ন সভায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ‘গভীর, শক্তিশালী ও সুবিস্তৃত’ বলে দাবি করছেন। কী থাকতে পারে এর পটভূমিতে?

আকবর আলি খান lদেখুন, আমাদের মনে রাখতে হবে কূটনীতিতে কোনো চিরন্তন বন্ধু ও চিরন্তন শত্রু নেই। যদি চিরন্তন শত্রু-মিত্র থাকত, তাহলে আর কূটনীতির প্রয়োজন ছিল না। কূটনীতির দায়িত্বই হলো, যে শত্রু তাকে আপনি মিত্র করবেন, সবার সঙ্গে সখ্যের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করবেন। আপনি তখনই কোনো দেশকে শত্রু মনে করবেন, যেখানে কূটনীতি বন্ধ হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল চীন সরকারের ভূমিকা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় বেসরকারি পর্যায়ে অনেক সাহায্য-সমর্থন পাওয়া গেলেও চীনের বেলায় সেটাও মেলেনি। কিন্তু চীন বা যুক্তরাষ্ট্র কারও বিরুদ্ধেই আমরা অভিযোগ মনে পুষে রাখতে পারিনি। কারণ, পৃথিবীর বাস্তবতা হলো, এরা এখন বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থনীতি। এদের সঙ্গে আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে। সে জন্য দীর্ঘ ৪৩ বছরে কূটনীতির প্রধান সাফল্য হচ্ছে, যে দেশগুলো বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিল, তাদের সঙ্গে আমরা মিত্রতা স্থাপন করতে পেরেছি। সে জন্য আমাদের আশা, এদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের কারণ নেই। তবে অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কিছু কাজ করেছে, যেগুলো নিয়ে সরকার খুবই অসন্তুষ্ট। যেমন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র চায়নি এবং দ্বিতীয়ত, জিএসপি সুবিধা তারা প্রত্যাহার করেছে। তৃতীয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পদ্মাসেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের অনুমোদন না পাওয়ার পেছনেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। তেমনি এটাও সত্য যে, এ সময়ে টিকফা চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে এবং তারা বাংলাদেশকে বিভিন্ন সাহায্য দিচ্ছে বা আশ্বাস দিচ্ছে। চীনের সঙ্গে যদি বাংলাদেশের ভালো অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকতে পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণ নেই। সাম্প্রতিক অতীতে যা ঘটে গেছে, তা তো ঘটেই গেছে।

প্রথম আলো l কিন্তু যখন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত বিভিন্ন চুক্তি হচ্ছে, তখন সরকারের তরফে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এসব উষ্মা ও সমালোচনাকে কি জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির কৌশল মনে করেন, নাকি সত্যি সত্যি এর সারবত্তা আছে?

আকবর আলি খান l আসলে দেশের রাজনীতিতে বৈদেশিক বিষয় টেনে না আনাই ভালো। এই রীতি পৃথিবীর সব দেশই মেনে থাকে। তবু নির্বাচন খুব কাছে চলে এলে হয়তো কোনো কোনো দল এসব প্রসঙ্গ টেনে আনতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, তাই এই প্রশ্ন কেন উঠল তা আমি বুঝতে পারছি না। হয়তো এমনও হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো দাবি নিয়ে এসেছে, যেগুলো বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করতে অপারগ। সুতরাং সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যদি সরাসরি বেশি বক্তব্য দেওয়া হতে থাকে, তাহলে আমাদের চিন্তা করতে হবে যে সম্পর্ক অবনতির কী কারণ ঘটেছে। আমাদের সরকারও জানে, যুক্তরাষ্ট্রও জানে অতীতে তারা আমাদের সঙ্গে কী করেছে। এই সত্য স্বীকার করেই আবার নতুন করে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া হবে, এটাই আমাদের আশা ছিল। কিন্তু কেন সেটা থেকে বিচ্যুতি ঘটছে, তা সম্পর্কে আমাদের চিন্তা করার দরকার রয়েছে। ঝগড়া করে তো কূটনীতি হয় না। যদি ঝগড়ার কারণও থাকে, তার সমাধানও কূটনৈতিকভাবেই করতে হবে।

প্রথম আলো l আপনাকে ধন্যবাদ।

আকবর আলি খান l ধন্যবাদ।