এই মাটি, এই পতাকা

আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামান

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে আমরা বিজয়–লাভের আনন্দ উদ্যাপন করেছিলাম। সেই সঙ্গে দৃঢ় সংকল্প ছিল দেশটাকে নতুন করে গড়ে তুলবার। বিগত দিনের পর সংকীর্ণতা দূর করে আমরা গঠন করব গণতন্ত্রের জন্যে প্রয়োজনীয় সব প্রতিষ্ঠান। মানুষের মন থেকে ধর্মবিদ্বেষ দূর করে অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্র নিশ্চয়তা দেবে নাগরিকদের সকল ধর্মপালনের কিংবা কোনো ধর্ম পালন না করার, কিন্তু নিজে কোনো ধর্মের সংস্রব রাখবে না। মানুষে-মানুষে বৈষম্য দূর না হলেও অন্তত সহনশীল পর্যায়ে নেমে আসবে। বাংলা ভাষা সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, বাঙালি সংস্কৃতির যা কিছু ইতিবাচক, তা ছড়িয়ে যাবে সর্বত্র।
গত চার দশকের কিছু বেশি সময়ে, আমরা তার কতটুকু অর্জন করতে সমর্থ হলাম? গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি-দেশের অনেকখানি সময় কেটেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসনে; যখন গণতন্ত্র ফিরে এসেছে, তখনো জাতীয় সংসদ যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পায়নি, আবার আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ ঘটেছে। পরমতসহিষ্ণুতা কমে এসেছে।
ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা নিয়ে যত হইচই হচ্ছে, বাক্-স্বাধীনতা বা বিবেকের স্বাধীনতা নিয়ে ততখানি ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের সমালোচনা করলে পাকিস্তান আমলের মতোই সন্দেহ করা হয়, সে রাষ্ট্রের শত্রু কিংবা বিদেশি শক্তির মদদপুষ্ট। বিরোধী দলও যখন সরকারের সমালোচনা করে, তখন যে-ভাষা তারা ব্যবহার করে, সে-ভাষা গণতন্ত্রের নয়। সাম্প্রদায়িকতা মাথা তুলেছে প্রায় সর্বত্র। ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে, যখন-তখন যাকে-তাকে মুরতাদ ঘোষণা করা হচ্ছে। অপহরণ, খুন, লুণ্ঠন নিত্যকার ঘটনা, নারী-নির্যাতনও তাই।
আবার আমাদের অর্জনও সামান্য নয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমি নিয়েও সকলের মুখে অন্ন জোগাবার মতো ফসল আমরা উৎপাদন করছি। সাম্প্রতিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, তরিতরকারি এবং ফলের উৎপাদনও আমাদের চাহিদার অতিরিক্ত।
বিদেশে শ্রম বিক্রি করে মানুষ কেবল নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করছে না, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বাড়াচ্ছে। তৈরি পোশাকশিল্প দেশকে দিচ্ছে অনেক। তার চাকা সচল রেখেছে প্রধানত নারী-শ্রমিকেরা। শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে-ছাত্রী ভর্তির হার খুবই আশাপ্রদ। ফতোয়ার দাপট সত্ত্বেও মেয়েদের অগ্রগতি রোধ করা যায়নি-বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন সেটা। স্বদেশে-বিদেশে আমাদের সন্তানেরা সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবননৈপুণ্যের যে-পরিচয় দিচ্ছে, তা আত্মশ্লাঘার কারণ হতে পারে। জাতিসংঘ শান্তি বাহিনীতে বাংলাদেশের ভূমিকা এতই উজ্জ্বল যে কোথাও বাংলাকে সে দেশের সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, কোথাও সড়কের নাম হয়েছে বাংলাদেশ বা বঙ্গবন্ধুর নামে।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে-বিচার চলছে, তা আমাদের আরেকটি অর্জন। অভিযুক্তেরা অনেকেই ভেবেছিলেন, তাঁরা আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সে-ধারণা তাদের চূর্ণ হয়েছে। হয়তো বিচারের প্রক্রিয়ার গতি ধীর, হয়তো বাদীপক্ষের প্রস্তুতি কিংবা কর্তব্যপালনে ত্রুটি ও গাফিলতির বিষয় ধরা পড়ছে, তবু এটা বড় সাফল্য যে, বিচার হয়েছে, সাজা হয়েছে, অন্তত একটি ক্ষেত্রে শাস্তি কার্যকর হয়েছে। আর কয়েকটিমাত্র রায় চূড়ান্ত হলে বলা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের যেসব বিরোধী অমানুষিক নির্মমতার পরিচয় দিয়েছিল একদিন, আরেকদিন তার জবাব তাদের দিতে হয়েছে।
তার পরও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন তার মধ্যে একটি। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করা আরেকটি। নারীর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আরেকটি। মুক্তিযুদ্ধ স্বাভাবিকভাবেই পরিচালিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পরে অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও অধিকার সম্পর্কে আমরা সচেতন হয়েছি। বাংলাদেশে বাঙালির অধিকার এবং আদিবাসীর অধিকার সমান। আদিবাসীর ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন থাকতে হবে রাষ্ট্রের লক্ষ্যের মধ্যে।
মুক্তিযুদ্ধের কালে বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনায় আমরা আস্থা রেখেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দুটি দশকে পারস্পরিক হানাহানি ও সহিংসতা এবং অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আমাদের এবং বাংলাদেশপ্রেমী বহু বিদেশির তেমন আস্থা বিচলিত করেছিল। সে-আস্থা আমরা, আশা করি, ফিরে পেয়েছি। না পেলে তা ফিরিয়ে আনতে হবে। পরমুখাপেক্ষী হওয়া আমাদের নিয়তি নয়। দেশের মাটিতে দু পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে দেশের পতাকা আমরা ঊর্ধ্ব আকাশে তুলে ধরব-ওতে বাংলাদেশের শ্যামলিমা আছে, ওতে শহীদের রক্ত লেগে আছে। ওর অমর্যাদা আমরা হতে দিতে পারি না।
যারা বহু ত্যাগের বিনিময়ে দেশের বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল, তাদের বিজয় দিবসের সকৃতজ্ঞ অভিনন্দন।