সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন: দুঃসময়ের কান্ডারি

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন

২৫ মার্চ ১৯৭১-এর রাত। ক্রমাগত গুলির শব্দে প্রকম্পিত ৭৫১ সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডির দোতলা বাড়ি। শব্দ এগিয়ে আসছে এদিকেই। কোনো কিছু চিন্তার সুযোগ নেই।
শুধু স্বামী তাজউদ্দীন আহমদের শেষ কটি কথা গুলির শব্দের সঙ্গে তরঙ্গায়িত হচ্ছে, ‘মনে কর হাসপাতালের একটি অপারেশন টেবিলে রোগী শায়িত। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাকে চেতনানাশক দেওয়া হয়েছে। অপারেশন চলছে। ডাক্তারের হাতে একের পর এক নানা রকম অ্যাপারেটাস (যন্ত্র)। ডাক্তার আরও একটি চাইলেন। নার্স দিতে দেরি করল। রোগীর মৃত্যু হলো। দেশের এখন ঠিক এই অবস্থা। এক মুহূর্তের দেরিতে, ভুল সিদ্ধান্তে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।...’ সর্বশেষ কথা, ‘আমি চলে গেলাম, তুমি কী করবে করো।’
২৯ তারিখে স্বামীর লেখা চিরকুট—‘চলে যাওয়ার সময় কিছু বলে যেতে পারিনি। মাফ করে দিও। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও। কবে দেখা হবে জানি না, মুক্তির পর’—পেয়ে নতুন উদ্যমে পথচলা। তার পর থেকে কত ঘাত-প্রতিঘাত, জয়-সংকট, বিচ্ছেদ-বেদনা সমস্তকে নীরবে সামলে এগিয়ে গেছেন জোহরা তাজউদ্দীন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও জেলহত্যার পর যখন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এমনকি দেশ নিয়ে যেকোনো রূপে কোনো কথা উচ্চারণ নিষিদ্ধ প্রায়, সেই সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি। আওয়ামী লীগের আহ্বায়িকা নির্বাচিত হয়ে তিনি দেশব্যাপী দলকে নতুন প্রাণে সুসংগঠিত করতে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেন।
তাঁর সততা, প্রজ্ঞা, নির্লোভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, নিরহংকার জীবনযাপন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আজীবন তিনি একটি উদার গণতান্ত্রিক, ন্যায়পরায়ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করে গেছেন। বাংলাদেশ সুন্দর থাকবে—এই ছিল তাঁর প্রতিদিনের আশীর্বাদ।
আজ ২০ ডিসেম্বর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আজ তাঁকে অশেষ ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করতে চাই তাঁরই লেখা কিছু চিঠির অংশবিশেষ এবং তাঁর লেখা ডায়েরির একদিনের একটি প্রার্থনাগাথা দিয়ে।
তারিখবিহীন চিঠি ৭৭-এ লেখা:
শ্রদ্ধেয় আজিজ ভাই,
কতকাল পরে বহু আকাঙ্ক্ষিত আপনার সুদীর্ঘ চিঠিখানা আমি পড়লাম, যার সাথে আমার হৃদয়ের ছিঁড়ে যাওয়া গ্রন্থির তাজা থকথকে শুকনো রক্ত মিশে রয়েছে। তাই সে চিঠি কতবার যে পড়েছি! সে চিঠির প্রতি শব্দে যেনো জ্বল জ্বল করে ভেসে উঠছে ‘তাজের’ সেই তেজদীপ্ত মুখখানা। সেই মাস সেই দিন সেই ক্ষণ। ... স্মৃতির পাতায় এমনভাবে গেঁথে আছে, যা প্রতিদিন একবার করে ঝাড়া মোছা করে না রাখতে পারলে সম্মুখে চলার প্রেরণাই যেনো পাই না।
আজ আপনাকে লিখতে বসে জীবনের কোন মহাস্মরণীয় অধ্যায়, কোন সেই কাহিনী, কোনটা আগে আর কোনটা যে পরে বলবো সবকিছু যেনো আজ মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বারে বারে। উপলব্ধির গভীরে শুধুই হাতড়ে ফিরছি ‘তাজশূন্য’ এ কোন অচেনা জীবন! এ কোন অচেনা দিন মাস ধরে পাড়ি দিয়ে চলেছি আমি!
...ভাই, স্বাধীনতা পূর্বের রাজনৈতিক ঘটনাবহুল বছরগুলো স্রোতের মুখে এদেশের গণ-মানুষকে সম্মুখের দিকে ঠেলে নিয়েছিল এবং স্রোতের মুখে ধাবিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ দল এবং তার কর্মীবৃন্দ। রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে বড় সম্পদ আদর্শভিত্তিক কর্মী বাহিনী সৃষ্টি করা। দলের প্রতিটি নেতা ও কর্মী ভাইকেই আবেগহীন যুক্তিভিত্তিক মনোভাব নিয়ে সংগঠন করা। তথা গুণগত দিকটাই সর্বাগ্রে প্রতিষ্ঠিত করা। নেতৃবৃন্দের মধ্যে হাতে গোনা একজন-দুজন ছাড়া আর তো কেউ সেই বৈপ্লবিক চিন্তাধারার মন ও মানসিকতায় মোটিভেটেড ছিলেন না। তার সাবজেকটিভ ও অবজেকটিভ দুটো দিকের পরিণতিই দেখেছি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ঘটনাবলির মধ্যে। এবং তারই সূত্র ধরে ঘটনাবহুল কর্মকাণ্ডের মর্মান্তিক পরিণতি দেখলাম পরবর্তী ঘটে যাওয়া রক্ত ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে।
সর্বকালের নিকৃষ্ট মানের বিশ্বাসঘাতকতায় কলঙ্কিত হয়েছে বাংলাদেশে একালের ইতিহাস। এই সব নিয়ে অর্থাৎ আজ আমাকে ভেতরের সব চিহ্নিত শত্রু এবং বাহিরের চক্রান্তের সাথে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ ফেলতে হচ্ছে।
....আজিজ ভাই, তবু আজ সেই অচেনা মহাশূন্যের গর্ভ থেকে এক অমূল্য জগৎ আবিষ্কার করেছি আমি। সেই সূত্র ধরে গভীরে প্রবেশ করতে যেয়ে মনোজগতের একটি বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে সম্পূর্ণভাবে, আমার স্বর্গীয় উপলব্ধির আঘাতে। সেই ভাবনার জগতে আমি নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি নিজেকে। সেই একটি নিখাদ উপলব্ধির অনুভূতি প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয় মন। তা’হলো, ‘আমি আগেও ছিলাম না, আর পরেও থাকব না। মাঝখানের ছকে আঁকা নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্যই তো আমি। হয়তো কালই না-ও থাকতে পারি। আজ যে বেঁচে রয়েছি, এই তো যথেষ্ট! সুতরাং আজকের করণীয় কাজ আজ করে যাই। ...
চিঠি-২, মেজ মেয়ে রিমিকে ১৯৮১ সালে লন্ডন থেকে লেখা:
প্রিয় রিমি,
আজকে তোমার জন্মদিন, সকালে উঠে মনে হলো। আমার শুভ আশীর্বাদ ও ভালোবাসা নিও। দূর থেকে দোয়া করছি, মনে হয় আমার প্রাণের সাথে মিশেই রয়েছ। রাতে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করি তোমরা কী করছো। বিশেষ করে তুমি, গিন্নি বান্নি সেজে যত ঝামেলা ঠেলে কাজ করছো। অল্প বয়সে অনেক দায়িত্বের ভার পড়েছে। এ জগতে সেই বড়, যে নাকি সব রকমের ছোটবড় দায়িত্ব কেমন হাসিমুখে, কঠিন জিনিসও সহজে সামলিয়ে এগিয়ে যায়—তুমিও এভাবেই বিন্দু বিন্দু করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, কত সুন্দরভাবে ধাপগুলো উত্তরণ করতে পারবে, আমি যেনো দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি—তারপর ঐ দূরে ধীরে ধীরে আমাদের কাজও ফুরিয়ে আসবে, কোনো একদিন সূর্য অস্তমিত হবার সাথে আমরাও ডুবে যাবো। এই তো কত সুন্দর নিয়মের ধারা। ...
চিঠি–৩, ছোট মেয়ে মিমিকে ১৯৯২ সালে লেখা:
প্রিয় মিমি,
... জীবনটা নিয়মের মধ্যে বাঁধা। যে জীবনকে নিয়মের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারে ভারসাম্য বজায় রেখে, সে সুখীও হতে পারে এবং নিজেকে কব্জায় রাখতে পারে। তার কাছে দুঃখ-বেদনা চ্যালেঞ্জস্বরূপ। তোমাকে জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। কেইভানের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রেখো। বেশি বকাবকি কখনো কোরবে না। জীবনেও না। ওর মধ্যে সুপ্ত অনন্য গুণাবলির স্তরকে ধাপে ধাপে এগিয়ে তোলা তোমাদের এক বিরাট দায়িত্ব। ... তোমার ও সুমীর কথা বারবার মনে পড়ে।.... স্মৃতির পর্দায় দৃশ্যগুলো একের পর এক ভেসে বেড়ায় মিলিয়ে যায়—মন কেমন উদাস হয়ে যায়। ...
চিঠি–৪, বড় মেয়ে রিপিকে ২০০৪ সালে লেখা:
প্রিয় মা আমার রিপি,
তোমার কথা ফুলঝুরির মতো মনে হয়ে দোলা দিয়ে কোথায় নিয়ে যায়, সারাক্ষণই মনে হয় খেলা কোরি। সে খেলায় দুঃখ সুখ কান্না হাসির এক আধার। ...
আমার লেখা আমার জীবনের স্বপ্নের খনি। যদি লিখে রেখে যেতে পারি, অনেকগুলো জীবন্ত গল্পের এক মহিরুহ নন্দনকানন রচিত হবে। জীবন যে কত সুন্দর, জীবন যে কত বাস্তব এবং সর্বশেষে এক মহাশূন্য। ... জীবন শূন্যের মাঝে—সেই জীবন তো শূন্যেই মিলিয়ে যাবে।
ডায়েরির পাতায় লিখে রাখা তার অন্তর্নিহিত চাওয়া-প্রার্থনাগাথা
গিলবার্ট হল্যান্ড
‘প্রভু আমাদের মানুষ দাও।
এ সময় দাবী করে শক্তিশালী মন, মহান হৃদয়
সত্যিকার বিশ্বাস এবং প্রকৃত হাত।
সেইসব মানুষ দাও, যাদের হত্যা করতে পারে না গভীর লোভ।
সেইসব মানুষ দাও যাদের সম্মানবোধ আছে।
সেইসব মানুষ দাও যারা মিথ্যা বলবে না।
ন্যায়বিচার দেশকে শাসন করুক এবং সৎসাহস
আমাদের প্রয়োজন পূরণ করুক।’
সিমিন হোসেন রিমি: সাংসদ, লেখক ও সমাজকর্মী।
[email protected]