ওদের সবার যদি ব্রডব্যান্ড থাকত!

বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে (আইসিটি) তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গেল দুই দশকে নানা কর্মকাণ্ড হয়েছে। এর অনেকগুলোই নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের। যেমন ১৯৯৬-৯৭ সালে কম্পিউটারের ওপর আমদানি শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনা, মোবাইল ফোনসেবার একচেটিয়া বাণিজ্য বন্ধ করে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে মোবাইল ফোন চালুর লাইসেন্স দেওয়া। আবার অন্যদিকে কিছু প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল বিশ্ব আইসিটি বাণিজ্যের একটি অংশ করায়ত্তের চেষ্টা করা। যেমন দেশীয় আইসিটি প্রতিষ্ঠানসমূহের সংগঠন বেসিসের আত্মপ্রকাশ এবং সফটওয়্যারশিল্পের ওপর আয়কর রেয়াত। তবে ধারণা করি, মোবাইল ফোনের প্রসারের পরে তৃণমূল পর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিকে পৌঁছে দেওয়ার তিনটি মাইলফলকের একটি হলো দেশের সব ইউনিয়নে তথ্য ও সেবাকেন্দ্র চালু করা। সম্প্রতি এই কেন্দ্রগুলোর চার বছর পূর্তি হয়েছে।
এর আগে ১৯৯৪ সালে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কম্পিউটারে ফলাফল প্রক্রিয়াকরণের উদ্যোগ ছিল তৃণমূলে তথ্যপ্রযুক্তিকে নিয়ে যাওয়ার প্রথম বড় উদ্যোগ। তারপর অনেক বছর ধরে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটকে জনপ্রিয় করার নানা কৌশল নেওয়া হলেও মানুষ নিজেদের উদ্যোগে উপজেলায় ইন্টারনেট নিয়ে যায় ২০০১-০২ সালে। সেবার ডিভি লটারির আবেদন ইন্টারনেটে করতে হয়েছিল। এ দুই ঘটনা থেকে এটি খুবই পরিষ্কার যে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ইন্টারনেটের প্রসারের সঙ্গে ব্রডব্যান্ডের পাশাপাশি সবচেয়ে দরকার স্থানীয় ও সবার উপযোগী তথ্য আধেয় (কন্টেন্ট)। কারণ, ইন্টারনেটে যদি কাজের কাজ করা না যায়, তাহলে সেটি কখনোই তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের আকর্ষণের কারণ হবে না।
ঠিক এ কাজটাই করেছে ইউনিয়নে স্থাপিত তথ্য ও সেবাকেন্দ্রগুলো। সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই কেন্দ্রগুলো থেকে প্রায় ৬০ ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে। (‘তথ্যপ্রযুক্তিসেবা গ্রামে গ্রামে’, প্রথম আলো, ১২ ডিসেম্বর ২০১৪)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ রকম প্রায় ৫ হাজার কেন্দ্রে প্রতিদিনই প্রায় ৪০ লাখ লোক এই সেবাগুলোর কোনোটি গ্রহণ করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ইউনিয়ন তথ্যসেবাকেন্দ্রগুলো প্রায় ১২ কোটি সেবা দিয়েছে এবং এর বিনিময়ে উদ্যোক্তারা এ পর্যন্ত প্রায় ১৪০ কোটি টাকা আয় করেছেন। বিগত সময়কালে এই কেন্দ্রগুলোতে ৪ লাখ ভূমি পর্চার আবেদন, এক লাখ তরুণ-তরুণীর কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ২০ লাখ বিদেশে যেতে ইচ্ছুকের রেজিস্ট্রেশন ও ৯০ হাজার মোবাইল ব্যাংকিং-সেবা দেওয়া হয়েছে। বলা যেতে পারে, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ইউনিয়ন পরিষদ সম্পর্কে প্রচলিত ধরাণারই পরিবর্তন করেছে।
সবার কাছে ইন্টারনেটকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী যে কার্যক্রম চলছে, তার একটি বড় উদাহরণ হতে পারে আমাদের এই কেন্দ্রগুলো। এই কেন্দ্রগুলোর সব কটিতে যদি উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড থাকত!!!
ব্রডব্যান্ডের জন্য আক্ষেপটা বড় করে দেখা দিচ্ছে এ কারণে যে এর মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিকে আরও বেশি দিন পরিবর্তনের জন্য ব্যবহার করা যায়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নিয়ে বিলম্বে রাষ্ট্রীয় মনোযোগ দিলেও আমাদের সুযোগ আছে এই খাতে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের। অথচ ২০১৪ সালের বিশ্বের ব্রডব্যান্ড পরিস্থিতির প্রতিবেদন পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে, আমরা এই খাতে যতটা মনোযোগ দেওয়া দরকার তা দিচ্ছি না। দেশের প্রায় অধিকাংশ বাড়িঘর এবং প্রায় সব মানুষ মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় থাকার পরও আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) হিসাবে আমাদের দেশে শতকরা মাত্র সাড়ে ছয়জন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। আর দেশের মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়িঘরে ইন্টারনেট-সেবা পৌঁছেছে। একইভাবে ব্রডব্যান্ডের হিসাবে আমাদের অবস্থা খুবই করুণ। দেশে মোবাইল ব্রডব্যান্ড ব্যবহার করে প্রতি হাজারে মাত্র চারজন। ফলে বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১২৮তম।
অথচ ২০০৯ সালে গৃহীত জাতীয় ব্রডব্যান্ড নীতিমালার লক্ষ্যই ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে শতকরা ৩০ জনের কাছে ব্রডব্যান্ড পৌঁছানো। আর মাত্র এক বছরের মধ্যে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিনই হবে, যদি কোনো বিশেষ উদ্যোগ না নেওয়া নয়। ব্রডব্যান্ডের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তরুণদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগও জ্যামিতিক হারে বাড়ে। এমনকি বর্তমানের এই দুর্বল ব্রডব্যান্ড অবকাঠামো নিয়েই আমাদের তরুণেরা প্রতিদিন কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন মুক্ত পেশা থেকে। কেবল ফেসবুককে ব্যবহার করে একটি নতুন উদ্যোক্তাগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যাদের সংখ্যা এখন প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি এবং তাদের মাসিক গড় আয় কখনো কখনো কয়েক লাখ টাকার বেশি। প্রায় ৫০ বছরে একটি দেশীয় করপোরেট হাউস ৪৫ হাজার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে কয়েক বছরের চেষ্টায় প্রায় ৩০ হাজারের বেশি তরুণ-তরুণী ইন্টারনেটে তাঁদের জীবিকার সন্ধান করতে সক্ষম হয়েছেন। কাজে আমাদের গ্রামগুলোকে ব্রডব্যান্ডের আলোয় আলোকিত করার ব্যবস্থা করা দরকার।
জাতীয় ব্রডব্যান্ড নীতিমালায় ২০১০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ গ্রামকে ব্রডব্যান্ডের আওতায় আনার কথা ছিল, কিন্তু সেটি এখনো অর্জিত হয়নি। অবশ্য উদ্যোগ নিলে এই লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হবে না। এই খাতে প্রয়োজনীয় অর্থেরও সংস্থান রয়েছে বিটিআরসির কাছে। ২০১০ সাল থেকে দেশের সব মোবাইল অপারেটর তাদের রাজস্ব আয়ের একটি অংশ সর্বজনীন সেবা দায়বদ্ধতা তহবিলে (ইউনিভার্সাল সার্ভিস অবলিগেটরি ফান্ড) জমা দিয়েছে। ইতিমধ্যে এই তহবিলে কয়েক শ কোটি টাকা জমা হয়েছে। টেলিযোগাযোগ আইন অনুসারে পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোতে নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ও ব্যবহার বাড়ানোর জন্য এই তহবিলের টাকা ব্যবহার করার কথা। কিন্তু একটি অনুমোদিত গাইডলাইন না থাকায় এই খাতের অর্থ এখনো অব্যয়িত পড়ে আছে। এই অর্থের সামান্য অংশ খরচ করে প্রতি উপজেলার একটি গ্রামকে ব্রডব্যান্ডের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। এমনকি সেটি বাস্তবায়নে এক বছরের বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না।
দেশের আনাচে-কানাচে ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী নতুন স্বপ্ন দেখছে। ব্রডব্যান্ডের আলো তাদের সেই স্বপ্নকে ধরার সহজ সুযোগ করে দিতে পারে। আমরা যত তাড়াতাড়ি এই সত্য বুঝতে পারব, ততই তরুণদের জন্য আগামীর বাংলাদেশ স্বপ্নপূরণের দেশ হয়ে উঠবে।
মুনির হাসান: যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক, প্রথম আলো এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।