বড়দিনে বড় মন

এন্ড্রু কিশোর
এন্ড্রু কিশোর

শিল্পী তো মানুষ। তাই কর্ম নিয়েই কেটে যায় দিনের বেশি সময়। এর মধ্যে প্রতিদিন গানের রেওয়াজের সময় ঈশ্বরের ভাবনা চলে আসে। সংগীত মানেই যে প্রার্থনা। স্কুলে ও পারিবারিকভাবে ধর্মের শিক্ষা পেয়েছি ছোটবেলায়ই। যার বিভিন্ন ধরনের প্রভাব হয়তো আমার মধ্যে পড়েও থাকবে। আমি সব সময় নির্মল ও সজীব থাকার চেষ্টা করি। এ থেকে এখন আমার মনে হয়, নির্মল ও সজীব থাকাটা কিন্তু খুব কঠিন কোনো কাজ না। চাইলেই সেটা সম্ভব।
আমাকে একজন বকা দিতেই পারে। বিনিময়ে তাঁকে পাল্টা বকা না দিয়ে লোকটি কেন আমাকে বকা দিল, সেটা ভাবার চেষ্টা করি। খুঁজে বের করতে চাই আমার কোন আচরণ তাকে কষ্ট দিয়েছে? হয়তো নিজের অজান্তে হলেও কষ্ট দিয়েছি বলেই তিনি আমাকে বকা দিচ্ছেন। এসব হয়তো ধর্মীয় শিক্ষার ফল। বাইবেলের একটা অনুচ্ছেদে আছে, একবার একজন যিশুকে একটা চড় মেরেছিলেন। চড় খেয়ে যিশু তাঁর দিকে আরেকটা গাল পেতে দিয়েছিলেন! যিশুর কাছ থেকে এই শিক্ষাই পেয়েছি। এ জন্য তাঁর জন্মক্ষণ আমার কাছে বিশেষ এক মুহূর্ত।
পারিবারিকভাবে শিখেছি, আমার দ্বারা যেন কারও ক্ষতি না হয়। এই বিষয়টাও আমি মেনে চলার চেষ্টা করি। সব ধর্মই মানবতার কথা, শান্তির কথা বলে। আমার মনে হয় ধর্ম অপব্যাখার কারণে পাল্টে যায়। খ্রিষ্ট ধর্মমতে, ২৫ ডিসেম্বর যিশু পৃথিবীতে আসেন শান্তির বার্তা নিয়ে। এই দিনটা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য আনন্দের এক দিন। বড়দিন হিসেবেই এটি বেশি পরিচিত। ছোটবেলায় সারা বছর অপেক্ষা করতাম এই দিনটার জন্য। বড়দিনে নানা ধরনের উৎসবে মেতে থাকতাম। রাজশাহীর চণ্ডীপুরে কেটেছে আমার স্কুল-কলেজের দিনগুলো। সেখানে আমাদের বয়সী কিশোরদের একটা দল মিলে বড়দিনের আগের সন্ধ্যায় পাড়া বেড়াতে বেরুতাম। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘ক্রিসমাস ক্যারল’ (যিশুর আগমনী বার্তা বা কীর্তন) গাইতাম আমরা। নেচে-গেয়ে ভোররাত পর্যন্ত এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতাম। এই সময়ে বাড়ির লোকজন আমাদের শুভেচ্ছাস্বরূপ নানা ধরনের খাবার ও অর্থ দিত। বড়দিনের আগে এই নির্ঘুম রাতে আমার সঙ্গী ছিল আমার অকালপ্রয়াত সহোদর স্বপন। আরও থাকত ছন্ধ্যা, মানু, জন, সঞ্জু, বিপুল, প্রবীরসহ অনেকে। এই নাচগানের মাধ্যমে যিশুর আগমনী বার্তা সবার দরজায় পৌঁছে দেওয়া হতো। সারা রাত নাচ-গানের পর বাসায় ফিরে ঘুমানোর আগেই আবার ব্যস্ত হতাম চার্চে যাওয়ার জন্য। নতুন পোশাক পরে ঘোরাফেরা আর চার্চে যাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। তবে সে সময়ের প্রতিটি বড়দিনেই আমার গলার স্বর থাকত ফ্যাসফেসে। মানে রাতভর গান করার পর গলা বসে যেত।
বড়দিনে নানা ধরনের খাবার তৈরি হয় সব খ্রিষ্টান পরিবারে। ভূরিভোজের এই পর্বটাও ছিল বিশেষ আনন্দের একটা সময়। আরও কিছুটা আগের বড়দিনের স্মৃতি মানেই সান্তা ক্লজের উপহারের জন্য অপেক্ষা। বাবা-মায়ের পরামর্শে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তাম আর সকালে উঠে সান্তা ক্লাজের উপহারে চমকে যেতাম। বড়দিনের মধুর স্মৃতিগুলো ছোটবেলাতেই বেশি। আস্তে আস্তে বড় হয়েছি আর বড়দিনটাও পাল্টে গেছে। মাঝে অনেক বছরই বড়দিন মানে দেশের বাইরে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়া। এভাবেই কেটেছে বড়দিন। এবারের বড়দিনটা ঢাকার পাশেই কাটবে। সাভারে অনেকটা মফস্বলের আবহে পরিবার নিয়ে বড়দিন উদ্যাপনের পরকিল্পনা করেছি। এখন তো সন্তানদের আনন্দ দেখেই বড়দিন আরও বড় হয়ে ওঠে আমার।
লেখক: সংগীতশিল্পী।