বিটিভির সুবর্ণজয়ন্তী: কালের ধুলোয় লেখা

বিটিভির সুবর্ণজয়ন্তী
বিটিভির সুবর্ণজয়ন্তী

টেলিভিশনের ৫০ বছর। দীর্ঘ সময়। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। ভাবতে গেলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নানা ছবি, নানা ঘটনা। মনে পড়ছে, ষাট দশকের প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির কথা, পেয়েছি রাসটিকেট, মঞ্চে হয়েছি উত্তাল, চলচ্চিত্রে জীবনকে করেছি রঙিন, খেলাধুলায় উড়িয়েছি মহল্লার ধুলো। রং ও তুলির মধ্য থেকে হয়েছি চারুশিল্পী।
আর্ট কলেজের শিক্ষা শেষে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বাৎসল্য ও অনুপ্রেরণায় আমি তখন তদানীন্তন পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের চাকরিতে যুক্ত হয়ে গেলাম। তবে এখানে বেশি দিন চাকরি করতে হয়নি। দেশে এল জাদুর বাক্স—টেলিভিশন। বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও টেলিভিশনের তৎকালীন অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ কলিম শরাফীর সহযোগিতায় ১৯৬৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, উদ্বোধনের দুই মাস পরেই চলে এলাম টেলিভিশনে। তখন টিভি কেন্দ্রটি ছিল ডিআইটি ভবনে। আমার পদবি দেওয়া হলো ‘স্টাফ আর্টিস্ট’; অর্থাৎ সেট ডিজাইন, দৃশ্যসজ্জা, অনুষ্ঠানের শিরোনামসহ অংশগ্রহণকারী শিল্পী ও কলাকুশলীদের নাম নতুন নতুন আঙ্গিকে লিখে টেলিভিশনের পর্দায় পৌঁছে দেওয়া। আর একজন গুণী শিল্পী আমি এখানে পেলাম, তিনি আমার আর্ট কলেজের শিক্ষক শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। তিনি ছিলেন সেই সময় টেলিভিশনের প্রযোজক। স্টেশন-প্রধান হিসেবে পেলাম রুচিমান, কর্মঠ ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষ জামিল চৌধুরীকে। আরও পেলাম টিভি নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জামান আলী খানকে। ষাট দশকে ড্রামা সার্কেলে নাটক করার সুবাদে পেলাম মনিরুল আলমকে। তখন প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন খালেদ সালাউদ্দিন, যিনি জহির রায়হানের সঙ্গে প্রথম রঙিন ছবি সঙ্গম পরিস্ফুটন করে সব মহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন। মনে পড়ে অমায়িক সহজ-সরল ব্যক্তিত্বপূর্ণ বন্ধুবৎসল মানুষ আকমল খানকে। সে সময় আরও ছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু হুমায়ুন চৌধুরী, যিনি পরবর্তী সময়ে টেলিভিশনের সংবাদ পাঠক, ঘোষক ও সংবাদ বিভাগের প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সে সময় অতিশয় ভারী ও বিশাল দুটি ইমেজ অরিথন ক্যামেরা চালানোর মাধ্যমে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানকে যাঁরা অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন ক্যামেরাম্যান গোলাম মোস্তফা, মাহমুদ আহমেদ ও রফিকুল বারী চৌধুরী। আর একজনের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করতে চাই: নাট্যকার-অভিনেতা, নাট্য প্রযোজক আবদুল্লাহ আল-মামুন।
১৯৬৮ সালে বহিঃসংবাদ সংগ্রহ ও রেকর্ডিং করে পরবর্তী সময়ে প্রচার করার জন্য দুটি বিশাল আকৃতির ওবি ভ্যান (আউটার ব্রডকাস্টিং ভ্যান) এসে উপস্থিত হলো। আমরা ভাবতে শুরু করলাম, কীভাবে এই ওবি ভ্যান ব্যবহার করে নাটক করা যায়। মামুন, আমি ও ক্যামেরাম্যান মাহমুদ—তিনজনে বসে ঠিক করলাম, এই ভ্যান দিয়ে বাইরে কোথাও গিয়ে ধারাবাহিক কোনো নাটক করব। চলচ্চিত্র স্টুডিওর মতো আমাদের এমন একটা স্টুডিও চাই, যেখানে নাটকের দৃশ্য সাজিয়ে রেখে দেওয়া যায়। এভাবে দৃশ্যের পরে দৃশ্য ধারণ করে নাটকের দৃশ্যপরম্পরা অনুযায়ী সম্পাদনা করে নাটক তৈরি করা হলো। সে সময় অর্ধনির্মিত রামপুরা টিভি ভবনের চারদিকে দেয়াল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। স্টুডিওর ভেতরে ছিল বালুর স্তূপ। আলো ছিল না। পারটেক্স, হার্ডবোর্ড, কাঠ দিয়ে বানালাম সেট। বাঁশের সঙ্গে লাইট বেঁধে আলোর ব্যবস্থা করা হলো। ওবি ভ্যান দিয়ে শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস সংশপ্তক ধারণ করা হলো। এর সেট নির্মাণের দায়িত্বে ছিলাম আমি এবং এস এ কিউ মঈনুদ্দিন। এই সেটে আমরা পুকুরঘাট, ঘরবাড়ি, দালানকোঠা ইত্যাদি বানিয়েছি। আর পারটেক্স, হার্ডবোর্ডে এঁকে দৃশ্যানুযায়ী কেটে দূরত্বের ইলিউশন তৈরি করা হলো। এভাবেই তৈরি হলো রেঙ্গুনের রেলস্টেশন। এটাই রামপুরা টিভি স্টেশনের প্রথম ধারাবাহিক প্রযোজনা। তাতে সে সময়কার খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী কবরী, রোজী, ফতেহ লোহানী, এ টি এম শামসুজ্জামানসহ আরও অনেকে অভিনয় করেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে ওবি ভ্যান এই দিয়ে ডিআইটির ছোট্ট স্টুডিওতে তৈরি হয়েছিল টেলিভিশনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য নাটক মুখরা রমণী বশীকরণ। এটি নির্মাণ করেছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার।
ফিল্ম সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত ফাহিম উদ্দিন মালিক এরশাদ, মাসুমা খাতুন, রাজিয়া চৌধুরী ও মডি কোহেন, যিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ঘোষক তাঁদের পেলাম পরম বন্ধু হিসেবে। চাকরিতে কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী ও কবি শহীদ কাদরীকে পেলাম অন্তরঙ্গ সহকর্মী হিসেবে। এরপরই পেয়েছিলাম আমার দুই ঘনিষ্ঠ স্কুলবন্ধু হায়দার রিজভী ও শামসুল ইসলামকে। তাঁদের সঙ্গে টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে সবাই যেন একই পরিবারের সদস্য হয়ে গেলাম। তখন এতসব সৃজনশীল ব্যক্তির মেধা-মনন ও শ্রমের বিনিময়ে টিভি দর্শকেরা পেতেন অসাধারণ সব টিভির অনুষ্ঠান। নাটক যার মধ্যে অন্যতম।
শিল্পনির্দেশনা ও অভিনয়ের পাশাপাশি আমি নাটক প্রযোজনাও করেছিলাম। আমার প্রথম প্রযোজিত টিভি নাটক জিয়া আনসারী রচিত প্রতিবিম্ব। এতে প্রধান তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর, রিনি রেজা ও সাজ্জাদ। এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, শিল্পীর সত্তা অভিন্ন সত্তা।
তখন সব অনুষ্ঠানই প্রচারিত হতো সরাসরি। ধারণ করার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। এমনও দিন গিয়েছে, তৈরি করা সেটের দেয়ালটি সম্পূর্ণ করতে পারিনি, এদিকে নাটক শুরু হয়ে গিয়েছে। তখন অসম্পূর্ণ দেয়ালটিকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মাঝেমধ্যে হাত-পা অবশ হয়ে যেত। সাদা কাগজ বা বোর্ডের লম্বা প্যানেলে ছবি এঁকে গানের দৃশ্যে প্রাকৃতিক ইমেজ সৃষ্ট করা হতো। প্রতিদিন মাথায় ঢুকত নতুন নতুন ইমেজ, দৃশ্যকল্প ও ইলিউশন করা পাহাড়, বন; কখনো বড়লোকের বাড়ি, কখনো নিম্নবর্ণের মানুষের ঘরবাড়ি, আবার কখনো রাজা-বাদশার প্রাসাদ নির্মাণ করা হতো। বিভিন্ন সংগীত অনুষ্ঠানে ইন্টারলিউডে মিউজিকের সময়টুকুতে থাকত ঝড়, তুফান, নদী, সমুদ্রের কল্লোল, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্যকল্প। সবই করা হতো ওই চার দেয়ালের মধ্যে। দীর্ঘদিন পর যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন সত্যিই বিচিত্র অনুভূতি জাগে। কী হতে চেয়েছিলাম আর কী হয়ে গেলাম। এটাই বুঝি মানুষের জীবনের চিত্রনাট্য।
এরপর ডিজাইন শাখায় এসে যুক্ত হলেন আনোয়ার হোসেন, লুৎফর রহমান ও ভাষাসংগ্রামী ইমদাদ হোসেন। পর্যায়ক্রমে আরও আসেন মহিউদ্দিন ফারুক, হাসান আহমেদ, এস এ কিউ মঈনুদ্দিন, হোসেন জামাল, শামসুল ইসলাম, ফিরোজ মাহমুদ, কাজী কাইয়ুম, আবদুল মান্নান, রেজাউল করিম, এ কে এম মাহতাব প্রমুখ শিল্পী। এসব প্রতিভাবান মানুষের সমন্বয়ে এ বিভাগ নতুন এক শৈল্পিক রূপে আবির্ভূত হলো। তাঁরা নিজের শিল্পকর্ম দিয়ে টিভির শিল্পনির্দেশনা শাখাকে উচ্চমার্গে নিয়ে যান, যার ফলে শিল্পনির্দেশনার যে বিকাশ, তা-ই পরবর্তীকালে মানুষের রুচি গঠন ও শিল্পমনস্কতা তৈরিতে অবদান রেখেছে।
টেলিভিশন মাধ্যমটিতে অনুষ্ঠান নির্মাণ কোনো একক প্রচেষ্টানির্ভর নয়, সম্মিলিত ও দলগত প্রচেষ্টার ফল। লেখক, শিল্পী শিল্পনির্দেশক, চিত্রগ্রাহক, প্রকৌশলী রূপকার, প্রযোজক এবং অন্য সব কর্মী একটি অনুষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে সমভাবে জড়িত। যে কারণে টেলিভিশনে নির্মিতব্য অনুষ্ঠান সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের সম্যক ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়।
নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বিটিভির যাত্রা হলো শুরু। ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধারা এসে দায়িত্ব নিলেন টেলিভিশনের। যাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন আমার পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধা শাহাদৎ চৌধুরী, পরবর্তী সময়ে যিনি বিচিত্রার সম্পাদক হয়েছিলেন, তাঁর নির্দেশে আমি টেলিভিশনে প্রচারের জন্য টেলপ-এ প্রথম লিখলাম ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’।
দীর্ঘদিন শিল্পনির্দেশনায় নিজেকে নানাভাবে নিয়োজিত রেখেও এবং প্রযোজকদের তাৎক্ষণিক চাহিদা অনুযায়ী ফ্লোর ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি বিভিন্ন কালজয়ী নাটকের দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো মুখরা রমণী বশীকরণ, আবার আসিব ফিরে, চোর, সহনায়ক, কারিগর, অনেক তারার হাতছানি, পিঞ্জর, রাক্ষুসী, সমান্তরাল, মাটির কোলে, জোনাকী জ্বলে, বহুব্রীহি, নিমফুল ইত্যাদি।
জীবনের এ দীর্ঘ পথপরিক্রমায় টেলিভিশনের অনেক জ্ঞানী-গুণী, সংস্কৃতিমান মানুষ আমার স্মৃতিতে এসে ভর করছেন। এই মুহূর্তে বড়াই স্মৃতিপ্রীতিতে আচ্ছন্ন হয়েছি আমি। আতিকুল হক চৌধুরী, খালেদা ফাহমী, আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম, মোমিনুল হক, মোস্তাফিজুর রহমান, নওয়াজীশ আলী খান, জিয়া আনসারী, মুসা আহমেদ, হায়দার রিজভী, বদরুন্নেসা আবদুল্লাহ—তাঁদের নিয়েও আমার অনেক স্মৃতি। এ ছাড়া আমার সহকর্মী, আমার সহযোদ্ধাদের মধ্যে এখানে যাঁদের কথা বলতে পারলাম না, তাঁরা হলেন সৈয়দ সালাউদ্দিন চৌধুরী, ফেরদৌসী পিনু, শিরীন মহল বন্দনা, মানিক দে, বিজয় সেন, জি এম এ রাজ্জাক, গোলাম কিবরিয়া, স্বপন আচার্য্য প্রমুখ। তাঁদের সম্পর্কে লিখতে পারলে হয়তো আমাদের শিল্পনির্দেশনার যে উন্নতি, বোধের যে বিকাশ, সেসব প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা বলা হতো।
এই যে জীবনের এত ব্যাপ্তি, জীবনের এত ঘটনা, এত স্রোত নিংড়ানো প্রবাহ, তা এক দিনে এবং একটি মাত্র লেখায় ধারণ করা সম্ভব নয়। দিনে দিনে সে যাত্রা শেষ হতেও চলেছে। আমার সব স্বপ্ন জড়ানো চোখে দেখতে পাচ্ছি আমি এক নতুন জগতে, আলোকিত অন্য এক ভুবনে প্রবেশ করছি। সেই আলো-ঝলমল ভুবনে আমি কি আমার সেসব পুরোনো বন্ধু—সুবর্ণ দিনগুলোয় যাঁরা ছিলেন আমার পাশে—তাঁদের আবার আলিঙ্গন করতে পারব? স্পর্শ করতে পারব সেই দিনগুলোকে?
কেরামত মওলা: অভিনেতা ও বিটিভির সাবেক কর্মকর্তা।