ধর্মান্তর নিয়ে বিশ্বাস ও কর্তব্যের দোলাচলে মোদি

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

দিল্লির আর্চবিশপ অনিল জে টি কাউটো ২৪ ডিসেম্বর িখ্রষ্টান সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রদেশে খ্রিষ্টান ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজনকে যেভাবে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে, তাতে তাঁরা খুবই উদ্বিগ্ন। তাঁরা বলেন, বেশ কিছু উগ্র হিন্দু সংগঠন ধর্মান্তরকরণের এই কর্মসূচির নাম দিয়েছেন ‘ঘর ওয়াপসি’ বা ঘরে ফেরা। গরিব মানুষদের তারা হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনছে নানা প্রলোভন দেখিয়ে। এর ফলে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে তাঁরা বলেন, পরিস্থিতি না হলে হাতের বাইরে চলে যাবে।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী কী বলেছিলেন, আর্চবিশপ তা পরে সাংবাদিকদের জানান। তাঁর কথায়, নরেন্দ্র মোদি তাঁদের বলেন, ধর্মান্তরকরণের এ বিষয়টি মিডিয়ার সৃষ্টি। মিডিয়াই এটাকে ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখাচ্ছে। তাঁর পরামর্শ, এটাকে এত সিরিয়াসলি নেবেন না।
ধর্মান্তরকরণ নিয়ে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের প্রধানমন্ত্রী যে কথা বললেন, সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের শেষ সপ্তাহে রাজ্যসভায় তা বললে সংসদের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটত না। বিমা, কয়লার ব্লক বণ্টন বা অভিন্ন বিক্রয় কর বিলগুলোও পাস হয়ে অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু তা তিনি করেননি। বিবৃতি দেবেন না বলে জেদ ধরে বসেছিলেন। অথচ কেন, তার কোনো সদুত্তরও তাঁর দলের কেউ দিতে পারেননি। সংসদে কেন তিনি মৌন ছিলেন, আর্চবিশপ ও তাঁর সঙ্গীরা নাকি তা জানতে চেয়েছিলেন। মোদি তাঁদের বলেন, তিনি অন্য প্রধানমন্ত্রীদের মতো নন। তাঁর যা কিছু বলার তা আগেই বলে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘আপনাদের পছন্দ হোক না হোক সবাইকে নিয়ে সবার জন্য আমি কাজ করে যাব। সবকা সাথ সবকা বিকাশ আমার স্লোগান। তা থেকে আমি বিচ্যুত হব না।’
আর্চবিশপ অবশ্যই নিশ্চিন্তমনে ফিরে আসেননি। সে কথা সাংবাদিকদের কাছে কবুলও করেছিলেন। বলেছিলেন, তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁরা চান সরকার সব নাগরিকের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা নিশ্চিত করুক। তাঁরা চান সরকার যেন অশান্তি সৃষ্টি হতে না দেয়।
সত্যি বলতে কি, মোদির শাসনের সাত মাসের মাথায় আচমকাই ধর্মান্তর নামের এই বিষফোড়াটা অস্বস্তি শুরু করছে। উত্তর প্রদেশের আগ্রা, মিরাট, মুজফফরনগর, গোন্ডা, আলীগড় জেলা থেকে প্রতিদিনই ধর্মান্তরের কোনো না কোনো কর্মসূচি কোনো না কোনো উগ্র হিন্দু সংগঠন ঘোষণা করছে। শুধু উত্তর প্রদেশই নয়, প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য গুজরাট, কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, ওডিশা, তামিলনাড়ু থেকেও এ ধরনের খবর আসতে শুরু করেছে। এমন এমন সংগঠনের নাম শোনা যাচ্ছে, যা আগে কোনো দিন কানে আসেনি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরং দল পরিচিত সংগঠন। তাদের নেতারাও পরিচিত। তারা এমন ধরনের কর্মসূচি অতীতে নিয়েছিল। গুজরাটের ডাংস জেলায় নব্বইয়ের দশকে তারা হিন্দু-খ্রিষ্টান দাঙ্গাও বাধিয়েছিল। ওডিশায় স্টেইনস পরিবারকে পুড়িয়েও মেরেছিল। কিন্তু এবার একার ক্ষমতায় বিজেপি সরকার গড়াতে এই দাপাদাপি যেন বড্ড বেড়ে গেছে। এমন ধরনের কথাবার্তা কেউ কেউ বলছেন, যা শুধু সংবিধানবিরোধীই নয়, আইনবিরোধীও। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করে তোলা হবে। ভারতে চলে আসা তিন কোটি বাংলাদেশিকে হিন্দু হয়ে থাকতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথা শুনে সংখ্যালঘুরা ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছে। বিবৃতির পাল্টা বিবৃতি আসছে। উত্তেজনা বাড়ছে। অথচ সরকার নীরব। প্রধানমন্ত্রীও স্পিকটি নট।
অথচ এই নরেন্দ্র মোদিই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ও পরে কয়েকটা কথা বেশ জোর দিয়ে বলতেন। যেমন তিনি বলেছেন, ভোটের আগে আমি ছিলাম বিজেপির প্রার্থী। ভোটের পরে এখন আমি সারা দেশের প্রধানমন্ত্রী। এ কথাও বলেছেন, ভারতকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী করে বিকাশের পথে নিয়ে যাওয়াই আমার একমাত্র লক্ষ্য। লালকেল্লা থেকে ভাষণের সময় তো তিনি এ কথাও বলেছিলেন, অন্তত ১০ বছরের জন্য দাঙ্গা-হাঙ্গামাকে ছুটি (মোরাটোরিয়াম) দিয়ে দেওয়া হোক। এসব কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, তাঁর অতীতকে ছাপিয়ে বর্তমান যেন প্রতিভাত হয়। মোদি আসলে একধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন। দেশের মানুষ বিশ্বাসযোগ্যতার সেই অর্ঘ্য তাঁকে সঁপেছিল। এখন ধর্মান্তরের এই ঢক্কানিনাদের মধ্যে সেই বিশ্বাসযোগ্যতারই প্রমাণ তাঁকে রাখতে হবে। তা না পারলে বুঝতে হবে, দেশের মানুষের সঙ্গে তিনি প্রতারণা করেছেন।
আর্চবিশপের কাছে মিডিয়াকে দোষী খাড়া করলেও মোদি বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, বিশ্বাস ও কর্তব্যের ফাঁকে তিনি আটকা পড়ে গেছেন এবং এটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের একনিষ্ঠ কর্মী তিনি। সেই শুরুর দিন থেকেই সংঘের আদর্শে তিনি লালিত। হিন্দুত্ববাদে দীক্ষিত। আজীবন যে আদর্শকে মাথায় করে রেখেছেন, প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই আদর্শকেই সর্বস্তরে স্থাপন করবেন, এই আশা করাটা সংঘের চালকদের দিক থেকে অন্যায় নিশ্চয় নয়। কিন্তু তিনি যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী? যে ভারত ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করে এক উদার ও আধুনিক দেশ হিসেবে মাথাচাড়া দিয়েছে, সেই দেশের কান্ডারি হয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তাঁকে আইনের শাসনকেই তো আঁকড়ে ধরতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হতে হবে সবার, শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের নয়। একদিকে বিশ্বাস, অন্যদিকে কর্তব্য—এ দুইয়ের কোনটা প্রাধান্য পাবে, সেই দোলাচলে আপাতত মোদি বন্দী। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সংঘ পরিবারের কাজকর্মে রাশ টানতে হবে। আবার সংঘ পরিবারের লাগাম ছাড়লে তাঁকে পরিহাস করবে তাঁরই দেওয়া স্লোগান, সবকা সাথ সবকা বিকাশ।
এখনে পর্যন্ত ভাগ্য কিন্তু মোদির সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করে। কমতে কমতে তা ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারে এসে ঠেকেছে। বিশ্বের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির হার কমছে। এল নিনো ভ্রুকুটি দেখিয়েছিল খুব। শেষ দিকে সেই ভয়ও মারাত্মক হয়ে ওঠেনি। ফসল উৎপাদন মার খেলেও তা সহনীয়। সব মিলিয়ে ভারতের আর্থিক ভবিষ্যৎকেও আন্তর্জাতিক মূল্যায়নকারীরা ইতিবাচক দেখছে। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসবই সুখ ও স্বস্তির কথা।
এই ফুরফুরে ভাবটা কিন্তু চোখের পলকে বানচাল করে দিতে পারে ধর্মান্তরের দাপাদাপি। করপোরেট ভারত প্রধানমন্ত্রীকে তারই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী অরাজনৈতিক সংগঠনের হর্তাকর্তারা ধর্মান্তর নিয়ে যে লাগামছাড়া প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, তাতে রাশ টানা না গেলে মোদি যে দ্রুত লক্ষ্যচ্যুত হবেন, শিল্পোদ্যোগীরা এবং বণিকসভার শীর্ষ কর্তারা তা জানাতে মোটেই দ্বিধাগ্রস্ত নন। ফিকির সভাপতি জ্যোৎস্না সুরি স্পষ্ট বলেছেন, ‘ধর্মান্তরের জিগির তুলে এই কট্টর হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় নেতারা সরকারের ফোকাসটাই নাড়িয়ে দিচ্ছেন। এটা বিরক্তিকর। এতে দেশের ক্ষতি।’ ধর্মান্তরের এ অবাঞ্ছিত প্রবণতা দেশের সংসদকে বেহাল করে রাখায় সিআইআই, অ্যাসোচামের মতো বণিকসভা এবং শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতিরা বিরক্ত। কেননা, এ কারণেই আর্থিক সংস্কারের বিলগুলো পাস হলো না। এইচডিএফসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান দীপক পারেখ বলেছেন ‘আমরা গণতন্ত্র চাই, অকর্মণ্য গণতন্ত্র নয়।’ হিরো মোটরসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পবন মুনজাল প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বও চলে আসে। এঁদের প্রত্যেকেরই আশঙ্কা, ধর্মান্তরের মতো অনভিপ্রেত ঢেউ যেন উন্নয়নের নৌকো ডুবিয়ে না দেয়।
মোদি কি এসব জানেন না? বিপদটা কী এবং কোথায়, তা কি বোঝেন না? নিশ্চয় জানেন, নিশ্চয় বোঝেন। কিন্তু এ এক অদ্ভুত জাঁতাকল। জানেন-বোঝেন বলেই জম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচনে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের (এই ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে) আজন্ম অঙ্গীকারের প্রসঙ্গ উচ্চারণ পর্যন্ত করেননি। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (সারা ভারতের সবার জন্য এক দেওয়ানি আইন) প্রবর্তনের কথা বলেননি। কাশ্মীর উপত্যকা চষে বেড়িয়েছেন সরকার গড়ার তাগিদে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উপত্যকায় একটি আসনও বিজেপির জোটেনি। ধর্মান্তর নিয়ে যে হইচই চলছে, তাতে তাঁর দলের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়লে ছয় বছর পর উপত্যকার মুসলমানেরা তাঁদের প্রত্যাখ্যান করবে কি না, এ প্রশ্ন ও আশঙ্কা একাকার হয়ে উঠছে পিডিপি ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতাদের মনে।
নরেন্দ্র মোদিকে ব্যবস্থা নিতে হবে দ্রুত। চারদিকে ধর্মান্তরের বিষফোড়া পেকে গেলে উন্নয়ন শিকেয় উঠবে। উন্নয়ন, বিকাশ ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েই কিন্তু তিনি ক্ষমতাসীন হয়েছেন, ধর্মান্তরকরণের নয়।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।