উন্নয়নের বিলবোর্ড ও অস্বীকৃত আদিবাসী

সীমান্তে দাঁড়িয়ে উদ্বাস্তু আদিবাসীদের ফিরে আসার আহ্বান একজন প্রতিমন্ত্রীর
সীমান্তে দাঁড়িয়ে উদ্বাস্তু আদিবাসীদের ফিরে আসার আহ্বান একজন প্রতিমন্ত্রীর

চলে গেল আনন্দের ঈদ ও উৎকণ্ঠার আদিবাসী দিবস। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আদিবাসীরা জানতে চেয়েছেন, আদিবাসী দিবস পালন করা যাবে কি না। গতবার রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী দিবস না পালনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আদিবাসী দিবস পালনের দাবিতে রাজপথে মিছিল নামলে পুলিশ তা থামিয়ে দেয়। আদিবাসী জনগণের ভেতর সেই ক্ষত ও দাগ উজ্জ্বল হয়ে আছে। সরকারের তরফ থেকে এ বছর কোনো নির্দেশনা না এলেও, ঈদ উৎসবের ভেতর পড়ে যাওয়ায় এবারের আদিবাসী দিবস এ সময়টাতে আয়োজিত হয়নি। আগে-পরে মিলিয়ে দিবসটি পালন করছেন অনেকেই। কিন্তু দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণের আত্মপরিচয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে অস্বীকার করে আসছে। ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’, ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘ট্রাইবাল’—এ রকম একটির পর একটি পরিচয় চাপিয়ে দিয়ে চলেছে। সরকারিভাবে ‘দেশে কোনো আদিবাসী নেই’ ধারণাকে প্রতিষ্ঠায় জবরদস্তি জারি রাখলেও এই প্রথম দেশে দুটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। দেশের নিরুদ্দেশ আদিবাসীদের হদিস খুঁজে বের করেছে সরকার। বান্দরবানের নিরুদ্দেশ চাক ও খাগড়াছড়ির উদ্বাস্তু ত্রিপুরাদের ‘খুঁজে’ পেয়েছে রাষ্ট্র। ‘হারিয়ে যাওয়া আদিবাসী আবিষ্কার’ হিসেবে সরকার এটিকে বিলবোর্ড বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার করতে পারত। ঘটনাটি বিরল। উচ্চবর্গ বাঙালির নিপীড়নে উদ্বাস্তু ও নিরুদ্দেশ হওয়া নিম্নবর্গ আদিবাসীদের কোনো হদিস রাষ্ট্র এর আগে কখনো করেনি।

এ কেমন সার্বভৌমত্ব?
৫ আগস্ট ২০১৩ তারিখে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপানো হয়েছে। ‘আলোকচিত্র-রাজনীতির’ ডিসকোর্সে এ ধরনের উপস্থাপন ঘিরে বাহাস থাকলেও, ছবিটি রাষ্ট্র কর্তৃক উদ্বাস্তু হওয়া ‘আদিবাসী আবিষ্কারের’ এক তরতাজা নমুনা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, আতঙ্কে বসতভিটা ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে নিজ দেশের দিকে তাকিয়ে আছে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং ইউনিয়নের কয়েকটি আদিবাসী পরিবার। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার সীমান্তরেখা ফেনী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে উদ্বাস্তু আদিবাসীদের নিজ নিজ বসতঘরে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন। কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য এ ছবি বড় লজ্জার, বড় অপমানের এবং বড় বেদনার। এ ছবি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, রাষ্ট্র তার জনগণের জানের সুরক্ষা ও মালের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। ছবিতে ফেনী নদীর এপার এবং ওপার আমাদের কাছে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত হলেও, উদ্বাস্তু আদিবাসী জনগণকে তা নিরাপত্তাহীনতা ও নিরাপত্তার সীমানা হিসেবেই পাঠ করতে হয়েছে। তাহলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী? তাহলে রাষ্ট্র টিকে আছে কার দায় ও দেনায়? জনগণের রক্ত-ঘামের টাকায় রাষ্ট্র তার বিলাসী নিরাপত্তাবলয় তৈরি করলেও, জনগণকে সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্রের কারিগরি ও মনস্তত্ত্ব ব্যর্থ হচ্ছে বারবার।
৩ আগস্ট ২০১৩ তারিখে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং ইউনিয়নের তাইন্দং, বান্দরশিংপাড়া, সর্বেশ্বরপাড়া, বগাপাড়া, তালুকদারপাড়া ও লাকু হেডম্যানপাড়ার আদিবাসী ত্রিপুরাদের বসতভিটা আক্রমণ করে অভিবাসিত বাঙালিরা। এ ঘটনায় হাজারো আদিবাসী জন্মমাটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ৪ আগস্ট ২০১৩ সরকারের প্রতিনিধিরা তাদের ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তে ‘আবিষ্কার’ করে। রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়ে উদ্বাস্তু আদিবাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছে (প্রথম আলো, ৭ আগস্ট ২০১৩)। বলা হচ্ছে, একজন বাঙালি মোটরসাইকেলের চালকের ‘অপহরণ গুজব’ ছড়িয়ে এ ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আদিবাসী জনপদে এ ধরনের ‘বাঙালি জাত্যভিমান’ কোনো গুজব রটনার অপেক্ষা করে না। এটি জিইয়ে আছে। কারণ, রাষ্ট্র এই বৈষম্যের গণিতকে সব রকমের বৈধতা দিয়ে মোটাতাজা রাখছে। ২০১২ সালের আগস্ট মাসেও এ অঞ্চলে অভিবাসিত বাঙালিরা আদিবাসী জনপদে হামলা চালিয়েছেল। রাঙামাটি, নওগাঁ, দিনাজপুর, মধুপুর, রাজশাহী, নাটোর, কক্সবাজার, বান্দরবান, মৌলভীবাজার ও সিলেট—সবখানেই আদিবাসী জনপদ এক করুণ রক্তপ্রবাহের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এবারের ঘটনাটি কেবল অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা এ কারণে যে রাষ্ট্র এবার উদ্বাস্তু আদিবাসীদের খুঁজে বের করে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে।

নিরুদ্দেশ চাকদের খোঁজে কমিশন
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের চাকরা বহিরাগত বাঙালি, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নজনিত বলপ্রয়োগ এবং বিভিন্ন নামে-বেনামে কোম্পানির জবরদখলের কারণে আজ নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হয়েছে। চাকদের ভূমি হারানোর ঘটনার প্রতিকার চেয়ে আদিবাসী মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে আবেদন করে। মানবাধিকার কমিশনের প্রস্তাবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ১১ জুন ২০১৩ তারিখে তদন্ত করে সংযুক্তিসহ ৩৩ পাতার প্রতিবেদন দাখিল করে (সূত্র: নং ২৯.২২৪.০০০.০০৬.১৯৮.২০১৩-১১৪)। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আলমগীর হোসেন ২৯ মে ২০১৩ থেকে ৩১ মে ২০১৩ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাদুরঝিরি চাকপাড়া থেকে ১০টি চাক পরিবার চলে গেছে এবং বাকি চারটি পরিবার চলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। পাঁচ বছর আগে অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে এখানকার লংগদু চাকপাড়া থেকে সবাই নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হয়। চাকদের ভূমি দখলের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান শামসুল আলম ও জালাল আহমেদসহ ১৪ জন বাঙালি ভূমি দখলকারীর নাম উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদন এঁদের গ্রেপ্তার করে চাকদের জমি চাকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে ডেসটিনি গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানির অবৈধ ভূমি দখলের সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে প্রথম আলো জানায়, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা ২৫ একরের শত শত প্লট ইজারা নিয়েছেন, অনেকে ইজারার শর্ত ভঙ্গ করেছেন (২২.৬.২০১৩)। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনপদে একের পর এক প্রশ্নহীন এ ভূমি দখলের সূত্র টিকে আছে কেবল রাষ্ট্রের অধিপতি বাঙালি বাহাদুরি মনস্তত্ত্বের কারণেই। উল্লিখিত তদন্ত প্রতিবেদনও ভূমি জবরদখলের কারণগুলো উল্লেখ করেছে। ভূমি দখলদারদের কখনোই বিচারের সম্মুখীন হতে হয় না, একবার দখল করলে নির্বিঘ্নে ভোগ করা যায়, সুনির্দিষ্ট জরিপ নেই, ভবিষ্যতে জরিপ হলে রেকর্ড করা যাবে—এমন মনোভাব জারি আছে। জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন অবৈধ দখলদারদের পক্ষ নেয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ কার্যকর ভূমিকা পালন করে না বলেই ভূমি জবরদখল টিকে আছে।
রাষ্ট্রকে এ অন্যায় জবরদখল ঠেকাতে ন্যায়পরায়ণ ও সাহসী হতে হবে। চাক মানে দাঁড়িয়ে থাকা। চাকরা কি নিজ ভূমিতে দাঁড়ানোর জায়গা পাবেন? রাষ্ট্র কি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনকে আমল দেবে?

অস্বীকারের সংস্কৃতি
হঠাৎ করেই রাজধানী ঢেকে যায় সরকারের উন্নয়নের বিলবোর্ডে। হয়তোবা বঞ্চিত আদিবাসী মুখগুলোও ঢেকে যাবে উন্নয়নের বিজ্ঞাপনে। আদিবাসী প্রশ্নে রাষ্ট্রের উন্নয়নকে পাঠ করলে আহাজারি আর অস্বীকারের সংস্কৃতি ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আদিবাসী আত্মপরিচয়কে স্বীকার করে সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার ভূমি সমস্যার সমাধান করার অঙ্গীকার করলেও’ সরকার তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এ বছরের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্যে আদিবাসী জাতিগুলোর অধিকারসংক্রান্ত সব চুক্তি ও অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কথা ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু নিদারুণভাবে রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণের প্রতি সে সম্মান ও স্বীকৃতি প্রকাশ করছে না। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ, আইএলও কনভেনশন ১০৭ স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ আইন, বন্য প্রাণী আইন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনের মতো অনেক জাতীয় আইন ও নীতি আদিবাসী অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু রাষ্ট্র এসব মানছে না। টালবাহানা আর বাহাদুরি থামিয়ে আদিবাসী জনগণের চোখেই আদিবাসী জগৎকে দেখার প্রস্তুতি নিতে হবে রাষ্ট্রকে। উন্নয়নের বিলবোর্ড নয়, সত্যিকারের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলে বঞ্চিত আদিবাসী জনগণের বুকের সীমানাতেই চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
পাভেল পার্থ: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
[email protected]