দুদক কেন সিবিআই হতে পারবে না?

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

দুর্নীতি একটি সমাজের মূল্যবোধের ওপর অশুভ প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি এটা ব্যাহত করে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। তাই জনকল্যাণকামী কোনো রাষ্ট্র একে প্রশ্রয় দিতে পারে না; নিয়ে থাকে নানাবিধ কার্যক্রম। শাসনব্যবস্থা যেখানে সুদৃঢ়, সেখানে দুর্নীতি কেউ করলেও আইনিভাবে সাজা পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাই কমে যায় দুর্নীতির পরিসর। একপর্যায়ে আমাদের দেশটি গোটা বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছিল পর পর বেশ কয়েক বছর। এমনই অবস্থায় একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠার সঙ্গে উন্নয়ন সহায়তাকে শর্তযুক্ত করে ফেলে উন্নয়ন সহযোগীরা। সুশীল সমাজও এরই পক্ষে জোর অবস্থান নিয়েছিল। এ অবস্থাতেই ২০০৪ সালে এতৎসংক্রান্ত আইন কার্যকর ও কমিশন গঠিত হয়। দেখতে দেখতে এটা এক দশক পাড়ি দিল।
এ দশকে দুটো সরকার গেছে। তৃতীয়টি চলছে দ্বিতীয় মেয়াদে। শুরুর দিকে গঠিত কমিশন কার্যত নিষ্ক্রিয়ভাবে দুই বছরের অধিক পার করে দেয়। এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। পুনর্গঠিত হয় কমিশন। জরুরি অবস্থা জারিসংক্রান্ত অধ্যাদেশ এবং এতৎসংক্রান্ত বিধিমালা দুদকের স্বাভাবিক ক্ষমতার সম্পূরক হিসেবে কাজ করতে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি ভিন্ন ধরনের একটি গতি পায়। এ নিয়ে বিতর্ক আছে পক্ষে-বিপক্ষে। তার পরও জরুরি বিধিমালার আলোকে গঠিত সংক্ষিপ্ত আদালতগুলোর রায়ও উচ্চ আদালতে প্রায় সব ক্ষেত্রে বহাল থাকেনি। মুক্তি পেয়ে যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা।
পত্রিকান্তরের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ ১০ বছরে দায়েরকৃত মামলার ৪৭ শতাংশ সাজা হয়েছে। তাও নিম্ন আদালতে। যারা আপিল করেনি, তারা ছাড়া প্রায় সবার দণ্ড উচ্চ আদালতে বাতিল হয়েছে। দৈনিকের প্রতিবেদন অনুসারে, দণ্ড বাতিলের মূল কারণ অনুসন্ধান কার্যক্রমে দুর্বলতা ও দুদক আইনজীবীদের কার্যত প্রায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকা। এ তো গেল যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত চালিয়ে অভিযোগপত্র দিয়েছিল তাদের প্রসঙ্গ। অনেকেই তো সে স্তরেও মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে। সে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য দুদকের তদন্তকারীরা কতটা আগ্রাসী ও আন্তরিক, এ নিয়ে প্রশ্ন আসছে বারবার। সম্প্রতি টিআইয়ের একটি প্রতিবেদনে এ সংস্থার ভূমিকার সমালোচনা করা হয়েছে। দুর্নীতির সূচকে গত বছরের চেয়ে মান কিছু নেমেছে বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখ করা যায়, এক-এগারোর পর ক্রমান্বয়ে কিছু মাত্রায় উন্নীত হচ্ছিল সে সূচক। এবারে কিছুটা নিম্নমুখী বলে টিআই দাবি করছে। টিআইয়ের এ মতামতের সঙ্গে দুদক একমত হয়নি।
যা-ই হোক, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দুর্নীতিপরায়ণদের আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব দুদকের। দুর্নীতি প্রতিরোধ একটি সময়সাধ্য বহুমুখী কাজ। এর জন্য গোটা সমাজব্যবস্থাকে দুর্নীতিবিরোধী ও সচেতন করা আবশ্যক হবে। প্রয়োজন হবে অনেক আইনকানুন ও বিধিবিধানের পরিবর্তন। তবে যারা দুর্নীতি করছে, তাদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়াটি কঠিন হলেও অসম্ভব হওয়ার কথা নয়। পেশাদারত্বের নিরিখে তদন্ত, আদালতে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন ও আইনি লড়াই করার জন্যই তো স্বাধীন সত্তাবিশিষ্ট এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এর চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়া হয় অতি উচ্চক্ষমতা ও মর্যাদাসম্পন্ন একটি বাছাই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে। সেই কমিটিতে সুপ্রিম কোর্টের দুজন বিচারক রয়েছেন। বাছাই কমিটির সুপারিশে নিয়োজিত চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের চাকরি বিচারপতিদের মতোই সুরক্ষিত। সুতরাং, আইনানুগ যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তঁাদের কারও অনুরাগ বা বিরাগের তোয়াক্কা করার আবশ্যকতা নেই। যে-কাউকে আদালতে অভিযুক্ত করতে তঁারা সক্ষম। এতে প্রশ্ন আসে, এ বিশাল মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তঁাদের সাফল্যের পালে হাওয়া লাগছে না কেন? গলদ কোথায় আর কীভাবেই বা তা দূর করা যায়, সেটা ভাবতে হবে কমিশন ও সরকারকে। সুশীল সমাজের পরামর্শও নিতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। আমরা কেবলই ভাঙা-গড়ার খেলায় মেতে থাকতে পারি না।
এটি তলিয়ে দেখতে আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা সংক্ষেপে সিবিআই নামক প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে কিছু আলোচনা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। উল্লেখ্য, সেখানে দুর্নীতি দমনের জন্য একাধিক সংস্থা রয়েছে। তবে গত বেশ কয়েক বছর চাঞ্চল্যকর কিছু তদন্ত এবং আদালতে লড়ে আসামিদের শাস্তি বিধানে সক্ষম সংস্থা সিবিআই অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বস্তুত সিবিআই ভারত সরকারের একটি অধিদপ্তর। এর সাংবিধানিক কোনো অবস্থান নেই। দিল্লি স্পেশাল পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৪৩-এর আইন অনুসারে এটা চলছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে সমর সরঞ্জাম সরবরাহ বিভাগের লেনদেনে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ আসতে থাকায় এর প্রতিষ্ঠা। ১৯৬৩ সালে নাম পাল্টে হয় সিবিআই। খুন, অপহরণ ও সন্ত্রাসসংক্রান্ত বিষয়াদি এর আওতায় আসে। ১৯৮৭ সালে আরও সুবিন্যস্ত করে দুর্নীতি দমন ও বিশেষ অপরাধ নামের দুটো বিভাগ এতে চালু করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এর কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ থাকার কথা। যেতে পারে কোনো রাজ্যে সে রাজ্য সরকারের সম্মতিতে। এর সংস্থাপ্রধানের পদবি পরিচালক। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সিবিআই। এর পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটিতে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতা আর প্রধান বিচারপতি কিংবা তঁার মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি। অর্থাৎ রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় উভয় দিকের সমর্থনপুষ্ট এ পদকে দিয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। সংস্থাটি হয়েছে অনেক সক্রিয় ও সফল। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে।
অভিযোগ আছে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত হওয়ার। এ ধরনেরই প্রভাবে নরসিমা রাও, জয়ললিতা, লালুপ্রসাদ যাদব আর মুলায়ম সিং যাদবের মামলা বিলম্বিত করার অভিযোগও ছিল। তেমনি বিলম্বিত হচ্ছিল বিগত ইউপিএ সরকারের টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে টুজি স্পেকট্রাম বিতরণে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ। কিন্তু প্রায় সব কটিই আদালতের নির্দেশে জোরদার করতে বাধ্য হয়েছে সিবিআই। গ্রেপ্তার করেছে ক্ষমতাসীন সরকারের কেন্দ্রীয় টেলিযোগাযোগমন্ত্রীকে। জয়ললিতার মামলার বিচার হয়েছে ভিন্ন রাজ্যে। তিনি দণ্ডিত হয়েছেন। দণ্ডিত হয়েছেন লালুপ্রসাদ যাদব ও ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী শিবু সরেন। আপিল চলমান রয়েছে। সম্প্রতি সিবিআই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একজন মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে সারদা কেলেঙ্কারিতে। এ ঘটনায় আরও অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত আছেন।
সিবিআইয়ের কর্মপরিধি সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট। কোনো চাঞ্চল্যকর দুর্নীতি মামলার সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার না চাইলেও আদালতের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের পঁাচজন বিচারপতির একটি বেঞ্চ ২০০১ সালে বিস্তারিত শুনানির পর সিদ্ধান্ত দেন যে জনস্বার্থ রক্ষা আদালতের শুধু ক্ষমতা ও আওতাধীন বিষয় নয়, দায়িত্বও বটে। এমনই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের দুদকের মতো শক্ত আইনি ব্যবস্থা না থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকারের একটি অধিদপ্তর দুর্নীতির ঘটনায় গোটা ভারত দাবড়ে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কিত বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, আমলা ব্যবসায়ীসহ অনেকে। তাদের সাফল্য উল্লেখ করার মতো। ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দায়ের করা মামলায় তারা গড়ে প্রায় ৬৮ শতাংশে জিতেছে। আপিলের ফলাফল এতে ধরা হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সেখানেও তেমন হেরফের হবে না। উল্লেখ্য, আমাদের দুদকের ক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলতে একটি সংশোধনী উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছেন। বহাল রয়েছে দুদকের পূর্ণ কর্তৃত্ব।
সিবিআই কর্মকর্তারা সবাই সাধু-সজ্জন নন। তঁাদের পক্ষ হয়ে আদালতে মামলা লড়া আইনজীবীরাও কেউ ঢিলেমি দিতে পারেন কারণে-অকারণে। সব ক্ষেত্রে সফল হওয়া সম্ভবও নয়। তবে দুর্নীতির প্রশ্নে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়—এ বার্তা সিবিআই সফলভাবে দিয়েছে ভারতবাসীকে। তবে আমাদের সীমাবদ্ধতা কোথায়? সিবিআই কার্যক্রমের প্রতি সম্মিলিত রাজনৈতিক অঙ্গীকারের একটি ছাপ ইতিবাচক প্রভাব রাখছে মনে করলে ভুল হবে না। সে অঙ্গীকার কিন্তু এ ধরনের সংস্থার সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুদকের সামনে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান যেকোনো বাধা অপসারণেও এ ধরনের অঙ্গীকারের বিকল্প কিছু নেই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]