ভয়ংকর রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও জননিরাপত্তা

রাজনীতির নামে এ ধ্বংসযজ্ঞ আর ক​ত দিন? l প্রথম আলো
রাজনীতির নামে এ ধ্বংসযজ্ঞ আর ক​ত দিন? l প্রথম আলো

সম্প্রতি আমি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলাম। সেখানে পৌঁছানোর পরই রাজ্যের রাজনীতির ব্যাপক তোলপাড়। সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারির দায়ে রাজ্যের পরিবহনমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটল। মন্ত্রী মদন মিত্র গ্রেপ্তার হলেন। ভারতের ক্রিমিনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) রিমান্ডেও নিয়ে গেল। তাই নিয়ে রাস্তাঘাটে বিক্ষোভ। টেলিভিশনের টক শোগুলোতে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নামলেন পথে। কিন্তু আইন এগিয়ে চলল তার মতোই। অকাট্য সব যুক্তি দিয়ে সিবিআই তার কাজ করে চলল।
এ সময় আমি বহরমপুরের নাট্যদল ‘ঋত্বিকের’ উদ্বোধনে কলকাতার বিজ্ঞজনদের সঙ্গে গিয়েছি ট্রেনে। গিয়েছি শান্তিপুরে। সেখান থেকে ফিরেছি কলকাতায়। কলকাতায় নান্দীকারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। নাটক দেখেছি। সিনেমা দেখেছি। বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছি। চিকিৎসক দেখিয়েছি।
আমার এই ঘুরে বেড়ানোতে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। রেললাইন উপড়ে দেয়নি কেউ। পথে ব্যারিকেডও ছিল না। আলীপুর আদালতের কাছ দিয়ে ঘুরে এসেছি। মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে চলে যাওয়ার পর এবং ফিরে এসে আদালতে হাজির হওয়ার মধ্যেও নেতা-নেত্রীদের উচ্চকণ্ঠ শোনা গেলেও জনজীবনে কোথাও কোনো সংকট হয়নি। আমি বাংলাদেশের মানুষ। এ রকম পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা। কিন্তু পশ্চিম বাংলার মানুষের মধ্যে কোনো শঙ্কা লক্ষ করিনি। শুধু একটা সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছিল, কেন্দ্রের বিজিপি সরকার এবার পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে যেতে পারে। সেটি হবে পশ্চিমবঙ্গের জন্য এক বিপর্যয়।
ফিরে এলাম নির্বিঘ্নে। জননিরাপত্তা অটুট থাকল। সরকারি দল তৃণমূল একটা হরতাল বা অবরোধও দেয়নি। তবে জনমনে মদন মিত্র, তৃণমূল ও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। সাড়ে তিন বছরের মাথায় মমতার সরকার দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পেছনে কিছু শিল্পী-সাহিত্যিকের অবদান ছিল। সিঙ্গুরের ঘটনার পরই তাঁরা তৃণমূলের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল সেই ঋণ শোধ করে। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে নির্বাচিত হন। কিন্তু মূল কাজ থেকে তাঁরা বিরত থাকেন। নাটকের ক্ষেত্রে একটা সংকোচননীতিও গ্রহণ করেন। সুযোগ-সুবিধাগুলো কুক্ষিগত করতে গিয়ে তাঁরা বিতর্কের সূচনা করেন। অতীতে সিপিএম সরকার প্রকাশ্যে এসব কাজ করেনি। বাংলাদেশে এসব অবস্থা সব সময়ই বিরাজ করে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারা দুর্ধর্ষ হয়ে পড়ে। দখল করে নেয় গণমাধ্যম থেকে সব জায়গা। আওয়ামী লীগও এ ক্ষেত্রে কোনো উদারতার পরিচয় দেয় না। আমজাদ হোসেনের মতো লেখক-শিল্পীও বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রবেশাধিকার পান না। দেশের অধিকাংশ শিল্পী-সাহিত্যিক বিএনপিবিরোধী, তার কারণ মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের সঙ্গে বিএনপির সহাবস্থান। সবাই যে আওয়ামী লীগার, তা নয়। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের উদাহরণই গ্রহণ করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের রাজনীতিবিদদের মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য নেই। বিরোধীদের বক্তব্যকে খণ্ডন করতে গিয়ে সত্য-মিথ্যা বলতে তাঁদের দ্বিধা নেই। কিন্তু জনগণকে তাঁরা পরোয়া করেন। দিনের পর দিন হরতাল দিয়ে, আগুন দিয়ে নির্বিঘ্নে নিজ গৃহে বসে খিচুড়ি-বিরিয়ানি খান না। তাঁদের কাছে যাওয়া যায়, প্রশ্ন করা যায়। আবার জাতির প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধও হন।
মদন মিত্রকে গ্রেপ্তারের কারণে জনজীবনকে অচল করা যায় না, এটা তাঁরা বোঝেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায়ের দিন এখানে অসংখ্য গাড়ি ভাঙচুর হয়। মানুষকে পুড়িয়ে মেরে যে জনসমর্থন পাওয়া যায় না, এটা এখানকার রাজনীতিবিদেরা বোঝেন না।
ভারতের জনগণ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা নির্ধারিত হয় সেখানকার সমস্যা বিবেচনা করেই। তাই জয়-পরাজয় সেখানকার নেতারা নির্দ্বিধায় মেনে নেন। কেন্দ্রে কংগ্রেস দলের পরাজয় বা বাংলায় সিপিএমের পরাজয়কে তাই নেতারা মেনে নিতে বাধ্য, কারণ তাঁরা যুক্ত হয়েছিলেন নানা জনস্বার্থবিরোধী কর্মে। তাই এবার আত্মসমালোচনার পালা।
তার পরও ভারতে দাঙ্গা হয়। কখনো রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে তা হয়ে থাকে। গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এ দায় অস্বীকার করতে পারেন না। দাঙ্গা এখানেও হয়েছে। এ দেশেও চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে দাঙ্গা করেছে। পূজার সময় এ দেশে বিশেষ অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। এই দাঙ্গাকারীদের মধ্যে দুই দলের লোকেরাই থাকে। দাঙ্গায় বা ভয়ে যাঁরা দেশ ত্যাগ করেন, তাঁরা তৃণমূল বা বিজেপির সঙ্গেই যুক্ত হন। তাঁদের চাপেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিস্তা চুক্তিতে বিরোধিতা করতে হয়। যাক সেসব রাজনৈতিক প্রশ্ন।
একসময় জওহরলাল নেহরুর বাবা মতিলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘ভারতের রাজনীতিবিদ ভালো, পাকিস্তানের জনগণ ভালো।’ এই উক্তি তিনি করেছিলেন যখন রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী প্রমুখ। তারপর অনেক সময় চলে গেছে। বাংলাদেশ হয়ে গেছে। যেখানে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা এসেছেন। আজকে যখন ভারতের নেতাদের দিকে তাকাই, দেখি তাঁরা অধিকাংশই প্রবীণ। রাজনীতির অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন। তাঁদের তুলনায় আমাদের নেতৃত্ব অনেক তরুণ। অনেক নেতার জন্ম সত্তর ও আশির দশকে। কোনো ইতিহাস ছাড়াই সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে রাজনীতিতে এসেছেন।
এ ঘটনা ভারতে ঘটেনি। পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে ঘটেছে। রাজনীতির একটা আদর্শ ও ইতিহাস লাগে, গণসম্পৃক্ততা লাগে। এসব এই তরুণদের ক্ষেত্রে লাগেনি। যুক্তিহীন গালাগালি এখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। তাই ছাত্রলীগ-যুবলীগে যেমন মারামারি, তেমনি ছাত্রদল-যুবদলেও চলছে সংঘর্ষ। দুটি বড় দলের মধ্যেই চলছে এসব ঘটনা।
বাঙালি অনেক আবেগপ্রবণ, এই আবেগ অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী সুদীর্ঘ আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী অবস্থান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার—এ সবই আমাদের যৌক্তিক আবেগের প্রকাশ।
গণতন্ত্র মানে সব মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু সেই মতামত যদি বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাহলে তা অগ্রহণযোগ্য। দেশে জননিরাপত্তার প্রশ্নে একটা ঐকমত্যে তো পৌঁছানো দরকার। রাজনীতি তাদের দলের কথা বলবে, তর্ক করবে, আন্দোলন করবে। কিন্তু একজন নিরীহ নাগরিকের জীবনটা নির্বিঘ্ন করতে এর বিকল্প তো কিছুই নেই।
ভারতে আন্দোলনের একটা কেন্দ্র থাকে। সেই কেন্দ্র কখনো লোকসভায়, রাজ্যসভায়, কখনো বিধানসভায়। এসব জায়গায় মীমাংসা না হলে রাজপথে। সেই রাজপথও নির্দিষ্ট। ইংল্যান্ড, আমেরিকায়ও রাজনীতির কিছু কেন্দ্র আছে। পূর্বানুমতি নিয়েই সেখানে সমাবেশ করতে হয়। কিন্তু আমাদের কোনো কেন্দ্র নেই, সমগ্র রাজপথ, অলিগলি, শিশুদের স্কুল, ঘরবাড়ি সর্বত্র। হরতাল মানেই সহিংসতা। কোনো জায়গাই নিরাপদ না। এ সময় মানুষ বাধ্য হয়েই ট্রেন, বাস, লেগুনায় ওঠে। সেখানেও আগুন দেওয়া হলো, রেললাইন উপড়ে ফেলা হলো। তাতে কার লাভ হলো? মারা গেল নিরীহ মানুষ। মানুষ হত্যা কি রাজনীতির উদ্দেশ্য? তাই দেখে আসছি অনেক দিন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা। তার আগে কী ঘটেছিল? একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশের আকাঙ্ক্ষা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে, ফাঁসির আদেশ হলেই হরতাল, ভাঙচুর, আগুন। নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল ও তার জোট আসেনি। তা–ও নির্বাচন হলো। কিন্তু ৫ জানুয়ারির ওই বিতর্কিত নির্বাচন তো বাস্তবে জাতিকে এক স্বস্তিকর অবস্থায় নিয়ে এল। গত বছর রাজপথের সহিংসতা থেকে তো বাঁচা গেছে। যদিও বছর না ঘুরতেই আবার সেই পৌনঃপুনিকতা। বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ। ঢাকায় মানুষ আসতে দেওয়া হবে না, এসব। ২০-দলীয় জোট তাণ্ডব চালায়, এ সত্যকে মেনে নিয়েও দেশকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় রাখা যাবে না। মীমাংসা হতে হবে রাজনৈতিক। রাজনীতির টেবিলে। জনগণকে জিম্মি করে নয়।
কয়েক দিন ধরেই মানুষ অস্বস্তিতে ভুগছে, অনিশ্চয়তা প্রতি পদক্ষেপে। হরতাল, অবরোধ মানুষকে আইন অমান্য করার অধিকার দিয়ে দেয়। কোনো ট্রাফিক নিয়ম কাজ করে না। দেশটা রিকশার যুগে ফিরে যায়। রকেটের যুগে বসবাস করে রিকশার গতিতে জীবনযাপন, কী দুঃসহ! ঘরে বসে ইন্টারনেটের চর্চা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। সকালে সবজির দোকানগুলোতে ক্রেতায় ভরা থাকে। দুই দিন ধরে ক্রেতাশূন্য।
বহু আগে থেকেই হরতাল, অবরোধ ভোঁতা হয়ে এসেছে। বরং আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে নেতিবাচক প্রভাবই পড়ে। এ সময় বোমাবাজি, জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করা—এসব মানুষ ঘৃণার চোখেই দেখে। আন্দোলনকারী দলও এখান থেকে লাভবান হয় না। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারি দলেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। রাজপথে শক্তি প্রদর্শন, অসহিষ্ণুতা এবং রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। না হলে সরকার ও বিরোধী দলকে মানুষ একইভাবে দেখবে।
গত এক বছরে একটা উন্নয়নের গতিধারা ছিল। সরকারি উন্নয়নের চেয়ে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিই সব সময় বেশি। নিরাপত্তা থাকলে তা আরও বেশি হতে পারে। জননিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ একটা এজেন্ডা। কিন্তু সব সময়ই উপেক্ষিত। পুলিশ, বিজিবি, র্যাব দিয়ে জননিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে সব দলের ভূমিকা প্রয়োজন।
মানুষের মধ্যে প্রবল আস্থাহীনতা। মানুষকে যে দল আস্থায় নিয়ে আসতে পারবে, সে-ই ক্ষমতায় থাকবে। মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে কেউ জয়ী হতে পারবে না।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।