তিন নারীর মুখোমুখি: বাস্তবতা একই

নারী
নারী

সম্প্রতি বরিশালে গিয়েছিলাম সেখানকার নারীদের কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে সম্পর্কে ধারণা নিতে। আমি শুনেছিলাম, নারীদের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে বরিশাল একটি রক্ষণশীল জেলা। সেখানকার ব্যাপারগুলো বোঝার ব্যাপারে আমি আগ্রহী ছিলাম। এই যাত্রায় এমন তিনজন চমৎকার নারীর মুখোমুখি হয়েছি, যারা আমাকে এই চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিটা বুঝতে সাহায্য করেছে।
লঞ্চেই পরিচয় হয় রিমা নামের সাত বছর বয়সী মেয়ের সঙ্গে। ক্যামেরা দিয়ে তার কয়েকটা ছবি তুলতেই তার মেজাজ খারাপ করা ভ্রুকুটি উজ্জ্বল হাসিতে পরিণত হলো। ঢাকায় তার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে সে এখন বাড়ি ফিরছে। বোনের বিয়ের যৌতুকের জন্য তার বাবা ৩০ হাজার টাকা খরচ করেছে বলে সে জানাল। রিমার আগে তার বাবাকে আরও দুই কন্যার বিয়ে দিতে হবে। স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে পরিবার বা মায়ের কাছ থেকে তেমন কোনো চাপ নেই, তাই পথচারীদের কাছে ফুল বিক্রি করাটাই তার পছন্দ। এভাবে নিজের বিয়ের যৌতুকের টাকা সে নিজেই জমাতে চায়। জানতে চাইলাম, এর চেয়ে কি চাকরি করা বা বিয়ের বিষয় নিয়ে এত না ভাবাই ভালো না? আমার এই প্রশ্ন তাকে বিস্মিত করেছে। সে ধৈর্য নিয়ে আমাকে বোঝাতে শুরু করল যে একজন মেয়েকে অবশ্যই বিয়ে করতে হবে এবং এভাবে মা-বাবার সম্মান রক্ষা করা তার দায়িত্ব। আমি বললাম, বেশির ভাগ স্বামীই তো স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়। এর সঙ্গে সেও একমত। জানাল তার বেশির ভাগ জ্ঞাতি বোনই স্বামী পরিত্যক্তা ও সন্তান নিয়ে একা থাকে। এর পরও অবিবাহিত থাকার চেয়ে তার কাছে এই পরিত্যক্ত জীবনই কম অপমানকর! আমি বুঝলাম শিক্ষা ও স্বাবলম্বী হওয়ার অবারিত সুযোগগুলো এই দুর্দশাগ্রস্ত মেয়েদের কাছে কতটা মূল্যহীন!
রানীর বয়স ২০ বছরের বেশি হবে না। এরই মধ্যে তিনি স্বামী পরিত্যক্তা, একটি পঙ্গু ছেলের মা। ছেলের জন্মের পর স্বামী তাঁকে ছেড়ে দেন। স্বামীর অভিযোগ, অভিশপ্ত নারী হওয়ার কারণেই রানী পঙ্গু সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এখন তাঁর চাওয়া কী? তিনি স্পষ্ট করেই সরকারের কাছ থেকে সাহায্য দাবি করলেন। আমরা দেখেছি যে আমাদের প্রায় আড়াই কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই নিজেদের অবস্থার জন্য সরকারকে দায়ী করেন না। রানী চান সরকার তাঁর মতো পঙ্গু সন্তানের মায়েদের দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ ও চাকরি প্রদান করুক। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি কোনো স্বপ্ন দেখেন কি না? তিনি প্রার্থনা করেন তাঁর স্বামী তাঁর কাছে ফিরে আসুক। জানলাম একসময় দুজন মানুষের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। রানী জানালেন, যদি তাঁর স্বামী থাকত তাহলে কেউ তাঁকে তুলে নিতে পারত না। আমাদের সমাজে একজন নারীর একা জীবনযাপন যে কতটা অনিরাপদ, তা আবার পরিষ্কার হলো আমাদের সামনে।
তৃতীয় নারীটি বৃদ্ধ। মুখে ভাঁজ ও পাকা চুলের এই নারী চোখে দেখতে পারেন না। ঢাকা থেকে নারীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে এসেছি জেনে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তাঁর অসুস্থ এক ছেলের চিকিৎসার জন্য নিজের শেষ সম্বল রিকশা বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু ছেলেটিকে বাঁচাতে পারেননি। কয়েক মাস আগে মারা গেছে সে। এরপর বৃদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন আরেক পুত্রের ঘরে। তাঁর এই দায়িত্বহীন পুত্র ও অত্যাচারী পুত্রবধূ তাঁকে একসময় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। বয়স্কদের জন্য সরকারের নিরাপত্তা ভাতার বিষয়টি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও দেখলাম যে তিনি শুধু তাঁর প্রয়াত ছেলেকে নিয়েই কথা বলতে আগ্রহী। মৃত ছেলের মিলাদের জন্য অর্থই এখন তাঁর সবচেয়ে বড় চাওয়া। তিনি তাঁর নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য নয়, বরং ছেলের মৃত্যু তাঁকে যে ক্ষতবিক্ষত করেছে, সে জন্যই কাঁদছিলেন। এটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে ধনী-গরিবনির্বিশেষে আমরা সবাই নিজেদের চেয়ে আমাদের সন্তানদের সবচেয়ে বেশি দামি মনে করি। তাদের জন্য আমরা দরকারি চিকিৎসা, শিক্ষা ও চমৎকার জীবনযাপন কামনা করি।
বরিশাল যাত্রায় যে তিন নারীর মুখোমুখি হয়েছিলাম, এই সমস্যা শুধু এখানকার নারীদের একক সমস্যা নয়। বাংলাদেশের সবখানেই অতিদরিদ্র নারীদের অবস্থা একই। অতিদরিদ্র নারীরা পুরুষদের চেয়েও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। নারী ও শিশুরাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রথম শিকার। সম্পদের ওপর অধিকার না থাকলেও তাদেরই সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হয়। বাসার কাজ বা খাওয়ার পানি সংগ্রহ নারীদের কাজ হিসেবেই বিবেচিত। কিন্তু খাবারের ক্ষেত্রে নারীরা বৈষম্যের শিকার, অবহেলিত থাকে কন্যাশিশুরা। মেয়েদের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহূত হয় পারিবারিক নির্যাতন। এটা কোনো পারিবারিক ব্যাপার নয় বরং সামাজিক অপরাধ। এই মৌনতা ভাঙা খুবই জরুরি।
মেয়েদের রক্ষায় বাংলাদেশে ৩৬টি আইন আছে কিন্তু আমরা জানি যে নীতি প্রণয়ন করার চেয়ে প্রয়োগ অনেক কঠিন। এসব চর্চায় পরিবর্তন আনতে, প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাস ভাঙতে ও সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ পরিবর্তন করতে ভিশন ও কর্মপরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। বরিশালের অভিজ্ঞতায় এটা স্পষ্ট হলো যে মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে সেখানে তেমন কোনো প্রচেষ্টা নেই। বিভিন্ন এনজিওর কিছু অর্থনৈতিক উদ্যোগ অতিদরিদ্র মেয়েদের উপার্জন করার জন্য সম্পদ জোগানের চেষ্টা করে, যাতে তারা বিয়ের চাপে নত না হয়ে পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে পারে। কিন্তু সুযোগগুলো খুবই ক্ষীণ এবং চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। পূর্ণাঙ্গ ও নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামো ছাড়া মেয়েদের ক্ষমতায়ন ও সমতা-সাম্যের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে না। শুধু সাহায্য-সহযোগিতার কর্মসূচি মেয়েদের জীবনকে অর্থনৈতিক চাপ থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু তা কখনোই টেকসই ও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে না।
দরকার দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন, সমাজের প্রত্যেকের অংশগ্রহণ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। যুবসমাজ যে মূল্যবোধে বিশ্বাসী, তা রক্ষায় তারা যে পদক্ষেপ নিতে পারে, তা আমরা দেখেছি। নারী হিসেবে নারীর পক্ষে কথা বলতে থাকলে নিশ্চিতভাবেই পরিবর্তন নিয়ে আসা যাবে।
সাজিয়া ওমর: লেখক ও উন্নয়নকর্মী।
[email protected]