তাঁর কাছে যা শেখার আছে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মানুষের কাছে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সাধারণ পরিচয়, তিনি প্রধান বিচারপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। কথা সত্য বটে। তথ্য দুটোতে কোনো ভুল নেই। ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার উপযোগী রাজনৈতিক আবহাওয়া সৃষ্টির জন্য ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বও নিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন প্রণীত হওয়ার পর তিনিই প্রথম এ দায়িত্ব পালন করেন।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যখন বেঁচে ছিলেন, তাঁর নামের সঙ্গে এ দুটো পরিচয় পাশাপাশি বসালে তিনি নিজে তাতে বেশ আপত্তি করতেন। তিনি মনে করতেন, এ দুই পরিচয়ের মধ্যে একটি অন্তর্লীন বৈপরীত্য আছে। তিনি স্বস্তি বোধ করতেন প্রধান বিচারপতির পরিচয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন সত্য; কিন্তু এই ব্যবস্থাটিকে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির অন্তর্নিহিত প্রবল অনাস্থা ও অপরিসীম ক্ষমতালিপ্সার প্রতীক বলে গণ্য করতেন। নানা লেখায় তিনি তা বলেছেনও। তিনি এটিকে গ্রহণ করেছিলেন, কবি নজরুলের ভাষায়, ‘কণ্টকমুকুটশোভা’ হিসেবে।
কিন্তু মুশকিল হলো, অনেকে যেমনটা ভেবে থাকেন, গণতন্ত্রের মারণক্ষেত্র। ব্যাপারটির সত্যাসত্য বিচার বিরাট বিতর্কের বিষয়। তবে ইতিহাসের দিকে পেছন ফিরে তাকালে কথাটিকে পুরোপুরি উড়িয়েও দেওয়া চলে না। প্রকৃত ও ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র পাওয়ার জন্য ১৯৭১ সালে আমরা রক্ত ঝরিয়েছি। কিন্তু গত চার দশকেরও বেশি সময়ে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ রাজনীতির ঝাপটায় গণতন্ত্র বারবার দিশা হারিয়েছে। আমরাও কোমর বেঁধে উপর্যুপরি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেমেছি। আর এ প্রক্রিয়ায় যে প্রশ্নটি প্রধান হয়ে উঠেছে, তা হলো, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে কীভাবে ক্ষমতা তুলে দেওয়া সম্ভব? সে প্রশ্নে এখন যেমন ঘুম হারাম হয়ে যায়, ১৯৯৬ সালেও হতো।
১৯৯৬ সাল থেকে আমরা আদৌ কতটুকু এগিয়েছি, সে প্রশ্ন তোলার জায়গা এটি নয়। ঘটনা হলো, সে সময়ে বিএনপি সরকার ও বিরোধী দল আওয়ামী লীগের মধ্যকার প্রবল অনাস্থা ও সংঘাতময় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাস হয়। আইন অনুযায়ী সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হিসেবে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ওপর এর প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার দায়ভার পড়ে। এই ব্যবস্থাটি নিয়ে সমালোচনা থাকলেও তিনি বাস্তবতাবোধ বিসর্জন দেননি। দেশের সংকটকালে তাঁর ওপরে ন্যস্ত দায়বদ্ধতা থেকে পালাতেও চাননি। তবে এর উপয়ান্তর খুঁজেছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ভার বইটিতে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উটকো দায়িত্ব গ্রহণ করতে আমি কোনো উৎসাহ বোধ করিনি। আমি এই দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করলে সংবিধানের ৫৮গ(৩) শর্ত অনুসারে আমার অব্যবহিত পূর্বে যিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন, তাঁকে রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করতে পারতেন। আমার অব্যবহিত পূর্বে প্রধান বিচারপতি ছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ।’ তিনি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে গিয়ে তাঁকে এ দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। সাহাবুদ্দীন আহমদ জবাব দেন, তিনি দেখতে পাচ্ছেন দেশে ‘রক্তগঙ্গা বইবে’। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘ভারাক্রান্ত মনে’ ফিরে এসে গুরুদায়িত্বটি নেন।
দায়িত্বটি তিনি সুচারুভাবে পালন করেন, কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা সুমধুর হয়নি। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাপ তাঁর ওপরে এসে পড়ত মাত্রাছাড়া হয়ে। কখনো কখনো তা সৌজন্যের ন্যূনতম সীমাও পেরিয়ে যেত। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিনি যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন না, এ অভিযোগ তুলে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া একবার তাঁকে উত্তেজিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আমরা ঘরে থাকতে দেব না, দেশেও থাকতে দেব না।’
সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে মে ১৯৯৬-এ। সেনাবাহিনীর ওপর কর্তৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ও সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ নাসিম প্রবল দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ১৮ মে রাষ্ট্রপতি দুজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেন। একটি বক্তৃতায় এও বলেন যে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। বহু চেষ্টার পর নাসিম পরদিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার সময় পান। সাক্ষাতের পর নাসিম ফিরে আসেন দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে। সেখান থেকে তিনি সরাসরি আসেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের দপ্তরে।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নাসিমকে শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং বোঝান যে, সেনাপ্রধানকে কোনো পরামর্শ দেওয়ার অবস্থায় তিনি নেই। তিনি বরং এখন গিয়ে দুপুরের খাবার খান এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
এরপর ঘটনা গড়িয়ে চলে দ্রুতগতিতে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে নাসিম অ্যাটাচড (ওএসডি) করেন চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে। সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর কিছু কিছু অংশ নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে সক্রিয় হতে শুরু করে। দেশ একটি রক্তাক্ত ঘূর্ণাবর্তের অতলে তলিয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দেয়। দেশের পরিবেশ থমথমে হয়ে পড়ে।
দুই পক্ষের অসহনশীলতা, রাষ্ট্রপতির অসত্য ভাষণ, রাজনৈতিক দলগুলোর অস্থিরতার মধ্যে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান অসামান্য ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তিনি কোনো দিকে ঝুঁকে পড়েননি। সব উপদেষ্টার সঙ্গে একত্রে বসে তাঁদের মধ্যে একাত্মতা গড়ে তুলেছেন। জাতির উদ্দেশে দেওয়া আশ্বাসভরা এক বক্তৃতায় দেশবাসী ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের শান্ত করেছেন। তাঁকে বোঝার জন্য এই ঘটনাটির কাছে সম্ভবত আমাদের বারেবারে ফিরে আসতে হবে।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ভার নামে একটি বই লিখেছেন। সে বইটিতে এসব ঘটনার বর্ণনা আছে। আশ্চর্যজনকভাবে তাতে কোনো ঝাঁজ বা তিক্ততা নেই। যা আছে, তা ঘটনাটিকে বোঝার আন্তরিক ব্যগ্রতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটির ভেতর-বাইরের নানা প্রসঙ্গ নিরাসক্ত চোখে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা। অনেক প্রসঙ্গের পরে আবারও তিনি এ আক্ষেপের কথা বলেছেন, ‘আমরা কি পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রেখে, দেশের আইনকানুন মেনে এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করে ক্ষমতা হস্তান্তরের মহাযজ্ঞ একদা নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের তত্ত্বাবধান ও পৌরোহিত্যে পালন করতে পারব?’

২.
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের যে প্রশ্নটি দিয়ে আমরা আগের পর্বটি শেষ করলাম, জাতি হিসেবে তার উত্তর দিতে পারলে গণতান্ত্রিকভাবে সাবালক হওয়ার একটি পর্ব আমরা পেরোতে পারব। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নিরাশাবাদী ছিলেন না। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে পূর্ববঙ্গের অতীত ইতিহাসের গভীরে এ জনগোষ্ঠীর উত্থানের আকুতি তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত-অসমাপ্ত নানা লেখায় জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার রেখা আঁকতে চেয়েছেন। আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে এক লেখায় তিনি বলেছেন, ‘আমার দাদার বাবা ছিলেন একজন কৃষক, আমার দাদা কৃষক-কাম-সিল্ক ব্যবসায়ী এবং আমার বাবা একজন আইনজীবী। শিক্ষাই ছিল আমার একমাত্র পুঁজি।’
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল বাঙালি জাতির উঠে দাঁড়ানোর সে আকুতির সঙ্গে একাত্মতার প্রকাশ। তিনি বারবার লিখেছেন, সোনার বাংলা অতীতের স্মৃতি নয়, আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। মনেপ্রাণে তিনি বিশ্বাস করতেন, এ স্বপ্ন আমাদের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব।
এর জন্য রাজনীতির মাঠে তিনি ন্যূনতম খেলার নিয়ম মেনে চলার তাগিদ অনুভব করেছেন। এক অগ্রন্থিত লেখায় তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সরকারবিরোধিতার যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তা বড়ই নিরাশাব্যঞ্জক। দেশ শাসন করার যিনি দায়িত্বভার বহন করেন, তাঁর জন্য সামর্থ্য-ক্ষমতার প্রয়োজন। তাঁর হাড়গোড় ভেঙে ঠুঁটো জগন্নাথ করলে দেশের সমূহ বিপদ। অনুরূপভাবে, বিরোধী দল দেশের সম্ভাব্য বিকল্প সরকার, সেই বিকল্পের হাড়গোড় ভেঙে তাকে আমরা ঠুঁটো করে রাখতে পারি না।...বিরোধী দলকে মনে রাখতে হবে...তাদের অধিকার বিশেষ অধিকার, সরকারের সমতুল্য নয়। তারা বিরোধী দলের দায়িত্ব সাধ্যমতো পালন না করলে তাদের মর্যাদার আসন নষ্ট হতে বাধ্য। অবশ্য বিরোধী দলের বাক্স্বাধীনতা সরকারি দলের চেয়ে ব্যাপকতর ও প্রশস্ততর।’
এ না হয় খেলার মাঠের নিয়ম। আমরা সামনে এগোব কী করে? মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বিপুল আস্থা এ ক্ষেত্রে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ওপর। তিনি আমাদের শিখতে বলেন কৃষকদের কাছ থেকে। ‘কাউকে যদি আদর্শ হিসেবে নিতে হয়, তাহলে কৃষকই আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত। তাঁর হরতালের সময় নেই, রাজনৈতিক কূটতর্ক চালানো বা ককটেল নিক্ষেপের সুযোগ নেই। তিনি ভালোই জানেন, তাঁকে জমি তৈরি করতে হবে, বীজ বপন করতে হবে, আগাছা বাছতে হবে এবং সময় হলে ফসল তুলতে হবে।’
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের আজ প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি আমাদের মধ্যে শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু তাঁর চিন্তা ও কীর্তির মধ্য দিয়ে বিলক্ষণ রয়ে গেছেন।
সাজ্জাদ শরিফ: কবি; সাংবাদিক।