'তফাত যাও, সব ঝুট হ্যায়'

খলিফা হারুন অর রশীদ তাঁর রাজ্যের মানুষের অবস্থা জানতে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন। রাতের বেলায় কান পাততেন কারও জানালার কাছে। কিন্তু রাতের বেলা কেন? রাতের কথার বেশির ভাগই ব্যক্তিগত হওয়ার কথা। তা জেনে শাসক কী করবেন? আধুনিক কালে রাতের কথা কমে গেছে মানুষের। খোলা মনে কথা বলা বিপদেরও বটে। তাই সন্ধ্যার পর বাসাবাড়িতে মানুষ চুপ থাকে, কথা বলে টেলিভিশন। আজকের যুগে খলিফা হারুন মানুষের হালচাল জানতে ঘরে ঘরে কান পাতলে হিন্দি সিরিয়াল কিংবা দেশি টক শোর সংলাপ ছাড়া কিছুই শুনতে পেতেন না। মানুষের কথা জানতে তাই দিনের বেলা সদর রাস্তায় কান পাতাই ভালো।
রাজশাহী শহরের সাহেব বাজারের একটু ভেতরের দিকের এক চায়ের দোকান। যা হয়, এসব আড্ডায় কারও কথাই মাটিতে পড়ে না। একজনের চায়ে চুল পড়েছে, সে বিরক্ত হয়ে চা-ওয়ালাকে ঝাড়ছে, ‘চা কি চুল দিয়ে রেন্ধেছ, মামা?’ আরেকজন যুবকমতো বসে বসে সিগারেট ফুঁকছিল, সে ছাড়বে কেন? কথা মাটিতে পড়ার আগেই তার উত্তর, ‘পড়বে না ক্যান মামা, সরকারের চুল পড়ছে আর উড়ছে যে!’ এরপর চুল নিয়ে চাপান উতোর আর থামায় কে? কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, নির্বাচন প্রশ্নে সংবিধান থেকে একচুলও সরবে না সরকার। রাজনীতির কেশকীর্তনের সেটাই শুভসূচনা। এরপর বিরোধীদলীয় নেত্রী নিজস্ব কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে চুলকাব্যে অবদান রাখেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের তালিকা অনুযায়ী এরপর বাকিরা যার যার মনের মাধুরী মিশিয়ে কেশকীর্তনের পসরা সাজান। সংবাদপত্র আর টক শোর সুবাদে চুলকেন্দ্রিক লোককথা এখনো চলমান। যা হোক, চায়ের দোকানের বকাবাজির মধ্যে চুলের ব্যবহার রঙ্গ-তামাশার খিল খুলে দিল। প্রথমে বোঝার উপায় নেই, কে কোন পক্ষে। যে লোক সরকারকে একহাত দেখে নিচ্ছে, সেই লোকই দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলকেও ছাড়ছে না। অনেকক্ষণ খেয়াল করার পর বোঝা গেল, আসলে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ কারও পক্ষেই নেই। চলমান রাজনীতির বুলিগুলো তাঁরা ব্যবহার করছেন বটে, কিন্তু কোনো পক্ষের প্রতিই তাঁদের তেমন আস্থা নেই। জিজ্ঞেস করলে বলেন, রাজনীতির আমরা কী বুঝি? রাজনীতি কি পেটে ভাত দেবে? রাজনীতি কি আমাদের কাজ?
এই কথাগুলোর টানেই বাংলাদেশি গণতন্ত্রের আলগা কাছাটা খুলে পড়ে। রাজনীতি মানুষের রুটি-রুজির উন্নতি করবে, এমন আশা মানুষ ছেড়ে দিয়েছে। নেতা-নেত্রীরা সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করেন, এই বিশ্বাসও তাঁদের নেই। জিজ্ঞেস করলাম, তাই বলে কি ভোট দেবেন না? গত নির্বাচনে দেননি? মুখের কথায় অধিকাংশই সরকারকে দুষলেও ভোটের পছন্দের বেলায় দেখলাম নীরব। কোন দলকে ভোট দেবেন কিংবা কোন দলকে ক্ষমতায় দেখতে চান, সেটা যেন এক রাষ্ট্রীয় গোপন সত্য। প্রকাশে বাধা আছে! এই গোপন করবার ইচ্ছার মধ্যে তাঁদের অসন্তোষটা খেয়াল করা যায়। যেন ‘মনের কথা মনে আছে, সময় হলেই টের পাবা’ জাতীয় মনোভাব। ভোট দিয়ে শোধ বা প্রতিশোধের এটুকু সুযোগ ছাড়া বাংলাদেশি গণতন্ত্র আর কিছু দিয়েছে কি? এবার সেই সুযোগও মিলবে কি না, তা নিয়ে মানুষের উদ্বেগ লক্ষ করা যায়। ভোটকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের এই একমাত্র সুযোগটি মানুষ হাতছাড়া করতে চায় না। রাজধানী থেকে বিভাগীয় শহর, বিভাগীয় শহর থেকে মফস্বল পর্যন্ত নির্বাচনের জন্য মানুষের নীরব প্রতীক্ষা টের পাওয়া যায়। পটিয়ার কামরুল রাজশাহী শহরে রিকশা চালান। গতবার ভোট দেননি, এবার ভোটার হয়েছেন। তিনিও তক্কেতক্কে আছেন নির্বাচনের। সরকারকে কেমন লাগে জানতে চাইলে বলেন, ‘সরকার সবার হবে না? তা-না সরকার হোয়েছে কানা, সবাইকে দেখে না।’
ঢাকা থেকে রাজশাহী, রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে আবার ঢাকা। নির্বাচনের জন্য মানুষের প্রতীক্ষার প্রতিচ্ছবি দেখা গেল দেয়ালে দেয়ালে ঢাকাই সিনেমা স্টাইলের পোস্টারের ছড়াছড়ি দেখে। দেয়ালে কি বাসের পেছনে জনগণকে শুভেচ্ছা জানানোয় উদ্গ্রীব (সম্ভাব্য) প্রার্থীদের আলোকিত মুখমণ্ডল, উত্থিত হাত। কোন নেতা নতুন, কোন নেতা পুরোনো, তা তাঁদের পোস্টারের ভাষাতেই স্পষ্ট। কোনো এলাকার বর্তমান নেতা বা সাংসদের পোস্টারে দেখতে পাবেন সাফল্যের খতিয়ান আর ভবিষ্যতে অগাধ উন্নয়ন করার প্রতিশ্রুতি। নতুন প্রার্থীর পোস্টারে বলা কথা ‘সুযোগ দেন তো করে দেখাই’ টাইপের।
রাজশাহীর শিরোইল বাসস্ট্যান্ড মোড়। দেয়ালে সারি সারি সাঁটা পোস্টারের দিকে হাতের লাঠিটা তুলে রাজশাহীর আঞ্চলিক টানে চিৎকার করে বলছিলেন এক লোক। মধ্য বয়সী মানুষটার পরনে ময়লা বোঁটানো প্যান্ট-শার্ট, কাঁধে একটা লাল ঝোলা। মুখের সামনের সারির কয়েকটি দাঁতের জায়গায় শূন্য স্থান। কথা বলতে গিয়ে বাতাস বের হয়ে যাওয়ায় তাঁকে কিছুটা হাস্যকর দেখায়। হঠাৎ মুড়ির টিনমার্কা লোকাল বাসে উঠে প্রথম বাক্যেই তিনি সবার চোখ-কান আটকে ফেললেন তাঁর দিকে, ‘মামুর ব্যাটারা, বস্তা বস্তা টাকা বিদেশে পাঠাইতেছে, আর বাসে একটা এসি দিতে পারিল না!’ বাঙালি কথার জবাবে কথা বলবে না, এমন বেরসিক কোনো দিনই ছিল না। পেছন থেকে এক যাত্রী ফোড়ন কাটেন: ‘মামা, তুমিই না হয় এসি লাগায়া দেও।’
জবাবে হাতের ছোট লাঠিটা বাইরের দেয়ালের পোস্টারগুলো থেকে সরিয়ে বাসের যাত্রীদের সবার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে ছাড়লেন তাঁর অবিস্মরণীয় সেই উক্তি; রাজশাহীর টানে সম্পূর্ণ সাধু ভাষায় বললেন: ‘হেই, তোমরা সব কেমিকেল, আর আমি অরিজিনাল।’ এক মন্ত্রীর নামের মধ্যাংশ উল্লেখ করে বাসের সবাইকে হাসিয়ে উত্তর দেন, ‘...কইছে, রাবিশ! সব চোর!’ এই কথা রেকর্ড হইয়া গিয়াছে। বিশ্বের আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, সৌদি আরব সবাই রেকর্ড করে লিয়েছে...খালি ভারত ছাড়া।’ কৃতিত্বের রেকর্ড গড়াকে তিনি টেপ রেকর্ডারে কথা রেকর্ড করা বুঝেছেন। কেন ভারত এমন বিখ্যাত উক্তি রেকর্ড করার সুযোগ ছাড়েনি জানতে চাইলে চোখ টিপে হাসেন। এর অর্থ, রহস্য আছে বাপু, বলা যাবে না। আসলেই বলবার উপায় নেই।
ততক্ষণে আমার গন্তব্য এসে গেছে। লোকটার পিছু পিছু আমিও নেমে পড়ি। নেমেই রাস্তার মাঝখানে চলে গেলেন তিনি। রিকশায় ট্রাকের পেছনে লাঠির বাড়ি মেরে চিৎকার করতে থাকলেন, ‘ওপর থেকে পাওয়ার পাইছি, সব...বেটারে সোজা করিয়া দিব, পালাও পালাও।’ দুপুরের খর রোদের মধ্যে সবকিছু যখন পুড়ছে, রাজশাহীর আর্দ্র বাতাস যখন শরীর থেকে ঘাম নিংড়ে বের করে আনছে, তখন আমার যেন বিভ্রমই হলো। ‘অস্বাভাবিক’ সত্যভাষী মানুষটিকে মনে হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষুধিত পাষাণ গল্পের মেহের আলী, যে অভিশপ্ত প্রাসাদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে কেবল বলছিল, ‘তফাত যাও, তফাত যাও, সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।’
মানুষটি খুব সম্ভব রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়েননি। তাঁর হয়তো জানার কথা নয়, সরকারের যে প্রবীণ মন্ত্রীর বেফাঁস মন্তব্য তিনি অভিনয় করে দেখাচ্ছিলেন, সেই মন্ত্রীকে বিরোধী দলের এক নেতা ‘পাগলা মেহের আলী’ বলে খোঁটা দিয়েছিলেন। আর আমাদের এই ভবঘুরে ‘মেহের আলী’ রাজনীতির অভিশপ্ত প্রাসাদের বাসিন্দাদের শাসিয়ে যাচ্ছেন ‘তফাত যাও, তফাত যাও, সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।’
কান পাতলেসাধারণ মানুষের মনের এই ধিক্কার দেশের হর্তাকর্তারাও শুনতে পাবেন। সেই সৎ সাহস তাঁদের হোক বা না হোক, মেহের আলীরা আসছে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]