গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর আগে ভাবুন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আবার শুরু হয়েছে পেট্রলবোমার নারকীয় তাণ্ডব। বলি হচ্ছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ক্ষমতার যুদ্ধে এদের কোনো অংশগ্রহণ নেই, নেই কোনোভাবে লাভবান হওয়ার আশাও। তবু আগুনে জীবন্ত পুড়ে অঙ্গার হতে হচ্ছে এদের। আক্রান্ত হচ্ছেন বিরোধী দলের নেতারাও। বিএনপির নেত্রীর উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানের ওপর বর্বরোচিত হামলা হয়েছে ১৩ জানুয়ারি রাতে। তিনি চারটি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তাঁর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে সে রাতে মারা যেতে পারতেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর গাড়ি থেকে বের হতে না পারলে পোড়া লাশে পরিণত হতে পারতেন।
রিয়াজ রহমানসহ যেকোনো মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু বিএনপির নেতারা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায়ও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাক্ষ্য-আলামত ছাড়াই উল্টো বিএনপিকে দায়ী করা হচ্ছে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের নেত্রী
শেখ হাসিনার ওপর পাশবিক গ্রেনেড হামলা এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী এস এম এ কিবরিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন বিএনপির সরকারকেও আমরা এমন চরম দায়িত্বহীন মন্তব্য করতে দেখেছিলাম। আবার পেট্রলবোমার ঘটনায় বিএনপি বলছে, এটি আওয়ামী লীগেরই কাজ। এ ধরনের চরম নিষ্ঠুর মন্তব্য আমরা বিএনপির আমলে বিরোধী দল হিসেবে নৈরাজ্যকর কর্মসূচি পালন করার সময় আওয়ামী লীগকেও করতে দেখতাম।
বাংলাদেশে আমরা রাজনীতিতে এ রকম বহু সংঘাতময় ও কদর্য ঘটনা দেখছি। বাংলাদেশ কোনো আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। তাই আমরা ধরে নিই যে কিছু সংঘাত আর কিছু বিচ্যুতি এখানে ঘটতে পারে। সমস্যা হয় যখন এটি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সমস্যা হয় যখন আমরা বিভিন্ন আমলে ভিন্ন মাপকাঠি ব্যবহার করে ঘটনাবলি বোঝার চেষ্টা করি।
বাসে, গাড়িতে কিংবা রাস্তায় মানুষের ওপর টার্গেটেড আক্রমণ মাত্রাহীন ও সীমাহীন বর্বরতা। এমন বর্বরতায় কারও কোনো অনুশোচনা না থাকলে, এর কোনো সঠিক তদন্ত ও বিচার না হলে, সর্বোপরি এসব নৈরাজ্যের রাজনৈতিক কার্যকারণ উপলব্ধি করে সমঝোতার চেষ্টা না করা হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজতে দেরি নেই হয়তো আর।

২.
আমরা গত কিছুদিন যাবৎ যেসব ভয়াবহ হামলার ঘটনা দেখছি, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশের ওপর সরকারের যে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেখছি, ভিন্নমত দমনের জন্য যেভাবে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে দেখছি, তা ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক। কিন্তু এর পরও এগুলো আসল সংকট নয়, এগুলো সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আসল সংকট হচ্ছে প্রধান দুটো রাজনৈতিক মহল কর্তৃক একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার প্রবণতা।
সরকারি দলের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে বিএনপিকে নিঃশেষ করার মধ্যেই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান রয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করে। বিএনপিকে ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের জন্য দায়ী করা, হত্যাকারীর সঙ্গে হত্যার শিকার পক্ষের কোনো সমঝোতা হতে পারে না, তাদের সঙ্গে আলোচনাই হতে পারে না এমন কথা প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে। তারেক রহমান বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে চরম আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন, তাই বিএনপিকে সভাই করতে দেওয়া হবে না এমন কথাও বারবার বলা হচ্ছে। খালেদা জিয়াকে নানাভাবে অপদস্থ করা, বিরোধী দলের নেতাদের ওপর গণহারে হামলা-মামলা, অব্যাহত অপপ্রচারণা এবং বিরোধী দলকে ভাঙার চেষ্টা আগেও ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে এসে তা আরও প্রকাশ্য, আরও খোলামেলা রূপ নিয়েছে। বিএনপি নয়, শুধু জাতীয় পার্টির মতো একটি দুর্বল, ফাঁদে পড়া ও আত্মবিশ্বাসহীন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের কাম্য এটি সরকারের কর্মকাণ্ডে পরিষ্কার হয়ে উঠছে।
বিরোধী দলে থেকে বিএনপির পক্ষে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। কিন্তু অতীতে এই চেষ্টা বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে করেছে। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের নেতারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এবার আরও জোরেশোরে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করবে। নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা শুরু হলে অন্য পক্ষ সুযোগ পেলে একই কাজ করবে এই আশঙ্কা খুবই যৌক্তিক। বিএনপি ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিডিআর হত্যাকাণ্ড, ক্রসফায়ার, গুম আর বিভিন্ন দুর্নীতির জন্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিচার করার ঘোষণাও বিভিন্ন সময় দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের এবারের সরকার দমন-নিপীড়নের মাত্রা যেভাবে বৃদ্ধি করেছে, ক্ষমতায় এলে সেসব মানদণ্ড বা অত্যাচারের কৌশল ব্যবহার করে বিএনপি প্রতিশোধ নেবে এই আশঙ্কা করা অযৌক্তিক নয়।
দ্বন্দ্ব তাই শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়। দ্বন্দ্ব হচ্ছে কে অত্যাচার-নিপীড়ন করবে আর কে এর শিকার হবে, এটি মীমাংসার। এই দ্বন্দ্ব ভদ্রোচিতভাবে মোকাবিলার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা এ ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। এই সরকারের অধীনে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের চারটি নির্বাচনে দুবার বিএনপি আর দুবার আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়েছিল। ফলে অত্যাচার ও নিপীড়নের মধ্যেও একধরনের সাম্য ছিল। এই সরকারব্যবস্থা একতরফাভাবে বাতিল করে ২০১৪ সালে একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করেছে। অত্যাচার-নিপীড়ন করার মাত্রা এরপর বাড়িয়েছে এবং এই সংকেত দিয়েছে যে ২০১৯ সালেও তারা একই ধরনের নির্বাচন করবে। অর্থাৎ বিরোধী দলের কাছে বার্তা হচ্ছে যেভাবেই হোক আওয়ামী লীগকে হটাতে না পারলে অনাদিকাল যাবৎ হত্যা, গুম, মামলা আর হামলার শিকার তাদেরই হতে হবে।
বিরোধী দলের মরিয়া অবরোধ এ কারণেই। সরকারের সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগও প্রতিশোধ ঠেকানোর যেকোনো সম্ভাবনা নিশ্চিহ্ন করার জ​ন্য।
৩.
হানাহানির আসল কারণ কদর্য। কদর্যের কথা বলা সম্ভব নয়, তাই আদর্শিক দ্বন্দ্বের কথা বলা হয় বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও তার সুবিধাভোগীদের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগ এটিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সংগ্রাম হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে এটি মেনে নেওয়ার উপায় নেই।
আমরা জানি, একতরফা নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট ও দলীয়করণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চরম পরিপন্থী। তাহলে এসব যারা করে, তারা কেমন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার দাবিদার হয়? সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও যারা রাষ্ট্রধর্ম রেখে দেয় বা বেকায়দায় পড়লেই যারা ধর্মীয় গেঁাড়াবাদীদের সঙ্গে সমঝোতা করে, তাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা কতটা নিখাদ? ছয় বছর ধরে ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগের সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করছে না কিংবা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না, এসব ইস্যু যত দিন সম্ভব বাজারে রেখে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য—এটি বিশ্বাস করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ধর্ম বা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিএনপির প্রচারণাও একই ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাবাদ।
যাঁরা বলেন এটি আদর্শের লড়াই, একপক্ষকে যেভাবেই হোক নিশ্চিহ্ন করা জায়েজ, তাঁদের বক্তব্য তাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটি বরং রাষ্ট্রক্ষমতার লড়াই এবং ক্ষমতার জোরে শিকারি হওয়ার লড়াই। এই লড়াই ভয়ংকর। এতে একটি পক্ষের বিনাশ হলে রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়, দেশে চরম ফ্যাসিজম নেমে আসে। কোনো পক্ষই জয়ী না হলে বা দীর্ঘকাল যাবৎ লড়াই চলতে থাকলে দেশের শক্তি, সম্ভাবনা ও সম্মান নিঃশেষ হয়, ভিন্নপথে ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত হয়, গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে।
এই মৃত্যুঘণ্টা বাজার আগে আমাদের রাজনৈতিক অধিকর্তারা সতর্ক হবেন কি? পৃথিবীতে পাশবিক বর্ণবাদী আর দখলদারদের মধ্যেও আলোচনা ও সমঝোতার নজির আছে, পারমাণবিক বোমা বা গণহত্যার শিকার রাষ্ট্রও বৃহত্তর স্বার্থে অপরাধী পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। পৃথিবীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পর্যন্ত তার জনপ্রিয়তা প্রমাণ ও ক্ষমতায় আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
সবার ওপর সত্য মানুষের মতামত, মানুষের সম্মতি। অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের সত্যিকারের মতামতের ভিত্তিতে একটি সরকার গঠনের লক্ষ্যে আলোচনা শুরু না হলে, এমন নির্বাচনকে অনেকাংশে হলেও মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি না হলে এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
এ দেশে আগেও এমন সংকট হয়েছে। কিন্তু তখন অচিরেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনরায়ে সরকারের শাস্তির এবং বিরোধী দলের বিজয়ের সম্ভাবনা থাকত। এখনো যদি এমন একটি নির্বাচনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করা যায়, তাহলেই কেবল আপাত শান্তি ফিরে আসা সম্ভব। নির্বাচনে বিজয়ী পক্ষ দেশে সুশাসন স্থাপন করলে আর বিরোধী মহলগুলোকে অন্যায় নিপীড়ন না করলে এই শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
এমন সুন্দর সম্ভাবনা দেশে আসলেই আছে কি এখন?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।