নিজেকে মানুষ ভাবতে ঘেন্না হয়

অবরোধের নৃশংসতা
অবরোধের নৃশংসতা

শাহিন এবার ক্লাস টুয়ে উঠল। বাংলায় সে ভালো না। অক্ষর চেনে। সব অক্ষর লিখতে পারে। পড়তে পারে। কিন্তু কোনো একটা শব্দ দেখলে সে পুরোটা উচ্চারণ করতে পারে না। ধরা যাক, সে ‘আ’ চেনে, ‘ম’ চেনে, কিন্তু দুটো অক্ষর একসঙ্গে হওয়ার পরে যে ‘আম’ হয়, এটা সে একবারে বলতে পারে না, অনেকক্ষণ ধরে সে বানান করতে থাকে, স্বরে আ আর ম, স্বরে আর ম...
তখন তার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা প্রথমে ফিসফিস করে বলতে থাকে, আম, আম। তারপর তো একজন জোরেই বলে ওঠে, ওরে গাধা, আম।
কিন্তু শাহিন অঙ্কে সাংঘাতিক ভালো। স্কুলের আবুল কাশেম স্যার বলেন, শাহিন তো প্রডিজি। ও একটা শিশুপ্রতিভা। ওকে যদি বলা হয়, শাহিন বলো তো, ৯৯-কে ৩ দিয়ে গুণ করলে কী হয়? সে বলে দিতে পারে, ২৯৭। ক্লাস টুয়ে কেবল উঠেছে, এখনো ক্লাস টুয়ের ক্লাস শুরুই হয়নি, এই ছেলে কীভাবে এটা পারল? শাহিন বলে, খুব সোজা স্যার, ১০০-কে তিন দিয়া গুণ করলে হয় ৩০০, তাতে তিন কম, ২৯৭ হবে।
প্রথম দিন কাশেম স্যার এই কথা শুনে এমন হাঁ করে ছিলেন যে তাঁর মুখ দিয়ে একটা মাছি ঢুকে যেতেই বসেছিল। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে উঠেছিল, স্যার, মাছি... স্যার, মাছি।
শাহিনের বোনের নাম সাজিনা। সে পড়ে ক্লাস থ্রিতে। মেয়েটার বাঁ পা একটু ছোট। মেয়েটা খঁুড়িয়ে খঁুড়িয়ে হাঁটে। কিন্তু তারও একটা আশ্চর্য প্রতিভা আছে। সে সাঁতার খুব ভালো জানে। গ্রামের পুকুরে এপার-ওপার করা তো তার জন্য কোনো ব্যাপারই নয়, সে চলে যায় বর্ষাবিস্ফারিত নদীতেও।
ছেলেপুলেরা তার সঙ্গে সাঁতারে পারে না। পুকুরে সাঁতার কাটা আর নদীতে সাঁতার কাটা এক কথা নয়। পুকুরের জল স্থির, নদীতে স্রোত থাকে, তুমি এক জায়গায় নামো, তারপর চলে যাবে মাঝনদীতে, তোমার পক্ষে সেই একই জায়গায় ফিরে আসা সম্ভব নয়, স্রোত তোমাকে টেনে নিয়ে যাবে ভাটির দিকে। অন্তত বিশ হাত।
সাজিনার সাঁতার কাটা দেখে হাইস্কুলের শিক্ষক জামালুদ্দিন বলেছেন, এই মেয়েকে অবশ্যই বিকেএসপিতে দিতে হবে। আরেকটু বড় হলে সে ন্যাশনাল টিমে চান্স পাবে। আমাদের জন্য সার্ক গেমসে কিংবা কমনওয়েলথ গেমসে সোনা সে আনবেই। এই মেয়েকে কুড়িগ্রামের উলিপুরের গ্রামে ফেলে রাখা মানেই প্রতিভার অপচয় করা।
স্কুলের স্যার তাকে বলেন, ও সাজিনা বেগম?
জি স্যার।
তুমি ঢাকা যাবা?
ক্যান স্যার?
বিকেএসপিতে ভর্তি হবা?
বিকেএসপি তো স্যার ঢাকাত নয়। সাভারত।
ওই হলো, ঢাকা আর সাভার তো কাছাকাছি।
যাব স্যার।
কবে যাবা?
আমি তো এখনো স্যার ছোট। বড় হই। বড় হয়া যাব।
কত বড় হলে যাবা?
ক্লাস সিক্স-সেভেনে উঠলে স্যার যাব।
তখন যদি তুমি সাঁতার শিখে বিখ্যাত হও, গ্রামের কথা ভুলে যাবা?
না স্যার, গ্রামের কথা ভুলব না।
একদিন ক্লাসের একটা মেয়ে শেফালি তাকে লেংড়ি বলে ডেকেছিল। তা শুনে স্কুলের হেডমিস্ট্রেস রাজিয়া আপা বলেছিলেন, শেফালি। তুমি সাঁতার জানো?
জি না।
তাইলে তুমি সাজিনা বেগমকে কেন বাজে কথা বলেছ? এখন তোমাকে যদি একটা পুকুরে ফেলে দিই আর সাজিনা বেগমকে ফেলে দিই, কী হবে? তুমি বাঁচবা নাকি সাজিনা বাঁচবে?
সাজিনা বাঁচবে আপা।
কেন, সাজিনা কেন বাঁচবে?
কারণ সে সাঁতার জানে আপা।
তাইলে কে বেশি ভালো।
শেফালি চুপ করে থাকে।
শোনো, ওই কবিতাটা পড়েছ। ষোল আনাই মিছে। সাঁতার জানো বাবু, নারে মাঝি না, বারে মাঝি বাহ্, বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে, তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে! বুঝেছ?
শেফালি চুপ করে থাকে।
হেড আপা এবার সাজিনাকে বলেন, সাজিনা, কথা কি ঠিক?
সাজিনা বলে, আপা, আমাকে আর শিউলিকে যদি একসঙ্গে পানিতে ফেলে দেন, আমরা দুজনেই বাঁচব।
আপা বলেন, কেমন করে? ও তো সাঁতার জানে না।
আমি তো জানি আপা।
আমি ওকে বলব, আমার পিঠের জামাটা খামচে ধরে নাকটা ভাসায়া রাখতে। তাইলেই আমি ওকে কিনারে নিয়া আসতে পারব।
রাজিয়া মিস্ট্রেসের চোখের কোণে পানি চিকচিক করে। সাজিনা মেয়েটা এত মায়াবতী।
শাহিন (সাত বছর) আর সাজিনা (নয় বছর) খুবই উত্তেজিত। কারণ, তারা ঢাকা যাচ্ছে। শাহিনকে আবুল কাশেম স্যার বলেছেন, তোমরা ঢাকা গিয়ে কই উঠবা? শোনো ঢাকাত গেলে কিন্তু গণিত অলিম্পিয়াডে যাবা। সেইখানে গিয়া অঙ্কের বড় বড় প্রফেসরদের কোশ্চেন করবা। দেখো না তাইলে কী রকম হইচই পড়ে যায়।
আর জামালুদ্দিন স্যার সাজিনার বাবা তরকারির ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিনকে বলেন, ঢাকাত যখন যাচ্ছেন, বিকেএসপিতে অবশ্যই মেয়েটাকে নিয়ে যাবেন। ও কত ভালো সাঁতার পারে, এইটা একটু ওদের জানানো দরকার।
শাহাবুদ্দিন বলেন, স্যার, আমি যাচ্ছি ওদের মায়ের চিকিৎসার জন্য। ওখানে ওর খালার বাড়ি আছে মিরপুরে। সেখানে গিয়া উঠব। ওদের মায়ের তো খুব পেটে বেদনা। এখানকার ডাক্তাররা বলেন, ঢাকাত নিয়া যান। তাই যাইতেছি। এগলা করার টাইম কি পাওয়া যাইবে?
সাজিনা তার ব্যাগ গোছায়। সে একটা আলাদা ব্যাগ নিচ্ছে। তাই দেখে শাহিনও একটা ব্যাগ গোছায়।
ওদের মা একটা বড় ব্যাগে নিজের জিনিসপাতি কাপড়চোপড় নেন। ওদের বাবার জিনিসপাতি নেন। এই প্রথম ঢাকা যাচ্ছেন তারা। ছোট বোনের বাড়ি যাচ্ছেন তিনি। তার জন্য জিনিস নিতে হবে। তার বরের জন্য। একটা মেয়ে আছে তাদের। তার জন্য তিনি নিজের হাতে একটা ফ্রক সেলাই করে নিয়েছেন।
সঙ্গে নিতে হবে খাবার পানি। একটু পরাটা আর মুরগির মাংসও নিয়ে নিলেন বুদ্ধি করে। রাস্তায় বাচ্চারা খেতে চাইলে দিতে পারবেন।
রাত নটায় বাস ছাড়ল।
প্রচণ্ড ঠান্ডা।
কাপড়চোপড় জড়িয়ে নিয়েছেন ঠিকভাবে। শাহিনকে জ্যাকেট পরিয়েছেন। মোটা ফুলপ্যান্ট। রবারের জুতা। মোজা। জ্যাকেটের সঙ্গেই টুপি আছে। সেটা দিয়ে কান ঢাকা যায়। শাহিন বারবার টুপি ফেলে দিচ্ছে।
মা বলেন, এই শাহিন, কান ঢাক। ঠান্ডা লাগবে।
শাহিন বলে, গরম লাগে মা।
সাজিনা বলে, মা, আমরা কি কালকা সকালে ঢাকাত পেঁৗিছ যাব নাকি ভোরবেলা।
ক্যান? সে কথা ক্যান? মা জিজ্ঞেস করেন।
সাজিনা জবাব দেয় না। শাহিন বলে, ওমা বোঝো নাই কথাটা। বাস তো বিকেএসপির সামনে দিয়া যাবে, তখন আপা বিকেএসপি দেখবে জানলা দিয়া। দেখো না জানলার পাশের সিটে আপা বসছে।
বাবা তো এরই মধ্যে ঘুম। তার নাক ডাকার শব্দ আসে। বাসের ইঞ্জিনের শব্দের চেয়েও বাবার নাকের ইঞ্জিনের শব্দ বেশি।
সাজিনা আর শাহিন খিলখিল করে হাসে।
কিন্তু সেই হাসির শব্দ ঢেকে যায় বিকট শব্দে।
তারা দেখতে পায়, বাসের সামনের দিকে আগুন জ্বলছে।
তারা আর্তনাদ করে ওঠে।
সাজিনা বলে, শাহিন, ওঠ, ওঠ। আগুন লাগছে।
বাবারও ঘুম ভেঙে যায়। বের হওয়ার রাস্তা সামনের দিকে।
এখন একটাই উপায়। জানালা দিয়ে লাফ দেওয়া।
জানালায় কাচ। সরানো যাবে। কিন্তু দুজন সামনের দিক দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করে আটকে গেছে। কাচ সরছে না।
ওদের মা পায়ের কাছের টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিটা তুলে কাচে বাড়ি মারেন। কাচ ভাঙে না।
আগুনের লেলিহান শিখা ছুটে আসে এদিকে।
চিৎকার করে ওঠে শাহিন। মা মরি গেলাম।
বাবার গায়ের চাদরে আগুন। তিনি সেটা ছুড়ে ফেলে জড়িয়ে ধরে শাহিনকে। শাহিনও জ্বলে। বাবাও জ্বলতে থাকেন।
মা মেয়েটাকে তুলে ধরে আছাড় মারে কাচের জানালায়। কাচ ভেঙে মেয়ে পড়ে যায় বাইরে।
মা পুড়তে থাকেন ভেতরে।
সাজিনার পায়ের দিকটা পুড়ে গেছে। বাইরে পড়ে গিয়ে তার মাথা ফেটে যায়। সে অজ্ঞান হয়ে যায়।
ভেতরে পুড়তে থাকে শাহিন, তার গণিতের প্রতিভা নিয়ে; পুড়ে যান শাহিনের মা, তাঁর পেটব্যথা সমেত; পুড়ে যান তরকারি বিক্রেতা শাহাবুদ্দিন, তাঁর বুকের মধ্যে আগলে রাখা পুত্রসন্তান সমেত।
আরও পুড়ে যায় অনেক যাত্রী। কেউ ভস্ম, কেউ বা অঙ্গার। কেউ বা পোড়া ক্ষত নিয়ে অকথ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলে, হে আল্লাহ, রহমত করো, আমার জানটা তুমি নিয়ে নাও। আল্লাহ সহ্য করতে তো পারতেছি না মাবুদ। আমাকে মেরে ফেলো। আমাকে মেরে ফেলো।
তখন একজন মানুষের মোবাইলে মেসেজ আসে, ডান।
তিনি আরাম করে ঘুমোতে যান।
সকালবেলা উঠে তিনি টেলিভিশন অন করেন।
হুঁ। পাঁচজন মারা গেছে। ২৩ জন পুড়ে গেছে। শাবাশ। এরপর দেখি, কী করে করে দুইয়ে দুইয়ে পাঁচ হয়।
তিনি বলেন, পরাটা ভাজো। কিন্তু তেল ছাড়া। আর শোনো ডিমটা রাখবে একটু কাঁচা কাঁচা। পেঁয়াজ বেশি করে।
তাঁর মেয়ে তাঁর কাছে আসে। আব্বু, আমার খাতা কিনা লাগবে। টাকা দাও।
তিনি মেয়ের চিবুকে হাত রেখে বলেন, খালি টাকা নিলে হবে? লেখাপড়া করা চাই ঠিকমতো।
ওপরের কাহিনিটা আমি বানিয়ে লিখলাম। কিন্তু যে পাঁচজন পুড়ে মারা গেছে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকাগামী বাসে, মিঠাপুকুরের কাছে দেওয়া আগুনে বা পেট্রলবোমায়, তাদের যাত্রীদের প্রত্যেকেরই তো একটা করে জীবন ছিল, পোকামাকড়ের নয়, মানুষের জীবন। প্রত্যেকেরই হাত ছিল, পা ছিল, চোখ ছিল, পেটে খিদে ছিল, চোখে স্বপ্ন ছিল, বুকে আশা ছিল। প্রত্যেকেরই বাবা আছেন, মা আছেন, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন আছে, জন্মের ইতিহাস আছে, বেড়ে ওঠার কাহিনি আছে, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আছে। সবটা নিয়ে তারা অঙ্গার।
আর যিনি নির্দেশ দিলেন যাও, আগুন জ্বালো, যারা যারা বোমা মারল, তারাও মানুষ। ফিরে গিয়ে তারাও পানিতে হাত ধোবে। বিছানায় ঘুমোবে। সকালে নাশতা করবে।
প্রিয় রাজনীতিবিদগণ, আপনারা কেউ ক্ষমতায় থাকবেন, কেউ ক্ষমতায় যাবেন, সে জন্য আমাদের মারেন কেন? আপনার সুদিন মানে আমার মৃত্যু। আর এমন ঘটনা আপনারা ঘটাচ্ছেন যেখানে জীবিত ব্যক্তিরা ঈর্ষা করছে মৃতকে? এই কি মুক্তি? এই কি সুদিন? এই কি গণতন্ত্র? এই কি মানুষের মুখে হাসি ফোটানো?
ধিক। ধিক। এখন নিজেকে মানুষ ভাবতেও ঘেন্না হয়, যখন ভাবি, ওই পেট্রল কেনা, পেট্রল ঢালা, পেট্রলবোমা বানানো, পেট্রলবোমা ছুড়ে মারা প্রাণীগুলোও নিজেদের মানুষ বলেই পরিচয় দেবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।