দোহাই, আর আগুনে পোড়াবেন না

পুলিশ এই আগুন নেভাতে বা সামাল দিতে পারবে না
পুলিশ এই আগুন নেভাতে বা সামাল দিতে পারবে না

মানুষ হত্যা হয়। মানুষে মানুষ মারে। রাগে, লোভে, প্রতিশোধে—প্রতিনিয়ত মানুষে মানুষ মারে। পুলিশ সহজে হিসাব দেয় না। ধারণা করি, বছরে সারা দেশে তিন থেকে চার হাজার মানুষ খুন হয়। বিচার বোধ হয় ৩০০-এর বেশি হত্যাকারীর হয় না। পুলিশ-রাষ্ট্র হিসাব দেয় না। আমরাও হিসাব চাই না। যার নিকটজন খুন হয়, সে বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘোরে। একসময় হাল ছেড়ে দেয়। অন্য অনেক কিছুর মতো বেশির ভাগ খুনেরই হয়তো বিচার হয় না।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ৪২-৪৩ বছরে যত খুন হয়েছে, তার বোধ হয় ৫ শতাংশেরও বিচার হয়নি। যদিও এসব খুনের প্রতিটি ঘটনা ফলাওভাবে সংবাদমাধ্যমে আসে। বছর দশেক ধরে প্রথমে র্যা ব আর ক্রমান্বয়ে পুলিশ মানুষ মেরেই যাচ্ছে। গ্রাম পুলিশ, আনসার হত্যাযজ্ঞে এখনো যোগ দেয়িন। তাদের বন্দুক দিলে তারাও হয়তো পিছপা হবে না।
অবশ্য এর আগে ২০০২-এর অক্টোবর থেকে ২০০৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ অভিযানে তৎকালীন সেনা, পুলিশ ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীর হাতে যাঁরা নিহত, আহত, পঙ্গু এবং অন্যান্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাঁরা কোনো আদালতে কোনো ধরনের বিচার চাইতে পারবেন না বলে ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩ (২০০৩ সালের ১ নম্বর আইন) সংসদ পাস করেছিল। এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে না বলে যে দায়মুক্তি আইনটি হয়েছিল, সেটা ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ, সংসদে পাস করা আইন নয়। বলা বাহুল্য, যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইনটি পাস হয়েছিল গত বিএনপি সরকারের আমলে। সে সময়ের পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী সেই ‘অপারেশন ক্লিনহার্টে’ নিহত হয়েছিলেন ৫৭ অথবা ৫৮ জন।
ওপরের কথাগুলো প্রকারান্তরে অতীতের লেখায়ও উল্লেখ করেছি। কিছু কিছু ব্যাপারে পুনরাবৃত্তি দোষণীয় নয়, সে বিশ্বাস থেকেই পুনরাবৃত্তি।

২.
মানুষ মারা সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ। ঠান্ডা মাথায় মাঝরাতে কোনো নির্জন মাঠে নিয়ে গুলি করে মারা আরও নিকৃষ্ট। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন এবং খুন করে লাশ যেভাবে গুমের চেষ্টা হয়েছিল, সেটা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে যে সম্ভব, সেটা সেই ঘটনার আগে বেশির ভাগ মানুষই হয়তো বিশ্বাস করতে পারত না।
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী-রাজাকারদের দ্বারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাড়া ঘেরাও করে পেট্রল-কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্য দেখেছিলাম। কিন্তু এখন নির্বিচারে বাস-ট্রাকের যাত্রী, চালক, হেলপারদের যেভাবে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, তাতে অতীতের সব বর্বরতা-নৃশংসতা প্রায় ম্লান হতে যাচ্ছে; পাকিস্তানি বাহিনী-রাজাকারদের পশুত্ব ছাড়া।
শিশুও রেহাই পাচ্ছে না, রেহাই পাচ্ছে না কেউই। রিয়াজ রহমানের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল তাঁকে গুলি করার পর। কয়েক মাস আগে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে গাড়িতে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
যারা নির্বিচারে আগুনে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারে, তারা তো মানুষ হতে পারে না। এ দেশে এত পশু কোথা থেকে এল?
তবু, দোহাই তোমাদের, এভাবে মানুষ মেরো না!
সব রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন, দয়া করে সমস্বরে বলুন, ‘এভাবে পুড়িয়ে মানুষ মারাকে আমরা ঘৃণা করি। এটা আমাদের রাজনীতি না।’
‘আমরা যাচ্ছি কোথায়’ শিরোনামে লেখায় মিজানুর রহমান খান (প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি, পৃষ্ঠা ১০) গত কয়েক বছরের রাজনীতির হানাহানি, খুনের কিছু হিসাব তুলে ধরেছেন। সব খুনই জঘন্য, তবে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পুড়িয়ে মারা জঘন্যতম অপরাধ। দোহাই, এটা বন্ধ করো।

৩.
তবে এটাও ঠিক, হানাহানি বাড়বে। প্রশ্ন বা অমীমাংসিত ব্যাপার অন্য জায়গায়, হানাহানি কতটা বাড়বে। যা আছে, আগামী দু-চার সপ্তাহে তার তুলনায় অনেক কমে যাবে, অল্পস্বল্প কমবে, নাকি বেড়ে যাবে? আর যদি বেড়েই যায়, তাহলে সেটা কি অল্পস্বল্প বাড়বে, নাকি বাড়বে অনেক বেশি। ইদানীং বলাবলি, লেখালেখির জন্য অকাতরে মামলা হচ্ছে। রোগবালাইতে জীর্ণ ষাটোর্ধ্ব শরীর নিয়ে জেলবাসের কোনো বাসনাই অধমের নেই। তাই বলে বলা-কওয়া, লেখালেখি, সেমিনার-আলোচনা বাদ দিয়ে ঘরে অবরুদ্ধ হয়ে থাকব, সেটাও সম্ভব নয়। তাই আগেভাগে ব্যাখ্যা।
সহিংসতা বাড়বে। তথ্য আছে, জানি, আমাকে কেউ বলে গিয়েছে, অতএব রিমান্ডে নিয়ে আচ্ছা করে ধোলাই দিলে সব জানা যাবে, বাবারে এসব কিছু না। বহু বছর ধরে বুঝে না–বুঝে ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি পড়েছি, কিছু কিছু আইনও। সেই সুবাদে তাত্ত্বিকবিদ্যা, যার সবটাই ভুল হতে পারে।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষত প্রধান দুই দলের (আওয়ামী লীগ আর বিএনপি) অবস্থান স্পষ্ট। তৃতীয় যে দল, অর্থাৎ সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা জাতীয় পার্টির ব্যাপারে এ কথা বলা যায় না। কেননা, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাদের অবস্থান এত ঘন ঘন পাল্টায় যে কোনো ব্যাপারে তাদের পজিশনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। অবশ্য একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়, কোনো ব্যাপারে আজকে তাদের যে অবস্থান, সেটা আগামীকাল না হলেও পরশু নিশ্চিতভাবে বদলাবে। এমন বিচিত্র দল খুব কম দেশেই পাওয়া যাবে। আদৌ পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।
মূল দলগুলোতে ফিরে যাই। মূল দুটি দল তাদের নিজ নিজ অবস্থান সার্বিক সর্বতো ও সর্বাঙ্গীণভাবে সঠিক বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এ কথায় বড় দাগে বলতে হলে অবস্থানগুলো এরূপ: আওয়ামী লীগ সর্বতোভাবে মনে করে যে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তারা পাঁচ বছর দেশ চালানোর ম্যান্ডেট জনগণের কাছ থেকে নিঃশর্তভাবে লাভ করেছে। তদুপরি বিএনপি-জামায়াত গং ক্ষমতা পেলে দেশের বারোটা বাজাবে। অতএব, শুধু ক্ষমতায় আসতে না দেওয়াই নয়, বরং দল হিসেবে ক্রমাগতভাবে দুর্বল করার চেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত একটা নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
অন্যদিকে বিএনপি ও শরিক দলগুলো সর্বতোভাবে বিশ্বাস করে যে ৫ জানুয়ারিতে কোনো নির্বাচনই হয়িন। সরকার অবৈধ ও ফ্যাসিবাদী। অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক বা তত্ত্বাবধায়ক গোছের কোনো ব্যবস্থায় নির্বাচন হতে হবে। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ‘সঠিক’ নির্বাচন হলে তারা জিতবে। বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগ প্রতিদিনই ঘোষণা দিচ্ছে যে মধ্যবর্তী বা আগাম নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পরবর্তী নির্বাচন ২০১৯ সালে।
দুই দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হিসেবে প্রয়াত আব্দুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়া একসময় বেশ কয়েক সপ্তাহব্যাপী ‘সংলাপ-সংলাপ’ খেলা খেলেছিলেন। সে সময় ছাগলের তৃতীয় ছানার মতো ‘লাইভ টেলিভিশন’-এ অধম ধারাবিবরণী দিয়েছিলাম।
জলিল সাহেব আলোচনাকক্ষে প্রবেশ করছেন, মান্নান সাহেব আসছেন। এই তো মান্নান সাহেবকে দরজার সামনে দেখা যাচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি কত কী।
সুদূর অতীতে প্রায় ২০ বছর আগে কমনওয়েলথের স্যার নিনিয়ান, ২০১৩-এর শেষ দিকে জাতিসংঘের তারানকো প্রমুখ মধ্যস্থতাকারীও চেষ্টা-চরিত করেছিলেন। ফলাফল শূন্য।
অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় উভয় দলের অবস্থান এখন আরও অনেক বেশি অনড়। তার থেকেও বড় কথা, উভয়েই তাদের নিজ নিজ অবস্থানের যৌক্তিকতা ও সঠিকতা নিয়ে আরও বেশি দৃঢ়। এবং উভয়েই মনে করছে যে তাদের নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে প্রচুর জনসমর্থন রয়েছে। আর শেষত, এখন নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে গেলে বা ছাড় দিলে সেটা হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল।
সংলাপ হবে না, কেউ ছাড়ও দেবে না। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, নাইজেরিয়া, মিসর, কলম্বিয়া অনেক দেশে যে সহিংসতা দৈনন্দিন ব্যাপার, সেসব দেশের সরকারই কিন্তু ‘নির্বাচিত’। বিবিসি হিসাব দিয়েছিল, ওই সব দেশে শুধু নভেম্বর মাসে বোমা ইত্যাদি সহিংসতায় পাঁচ হাজারের বেশি নিরীহ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিল।
এক কথায় বলতে হলে বলতে হবে, মূল কারণ হলো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অনড় অবস্থান। সরকারগুলো মনে–প্রাণে বিশ্বাস করে, দেশ রক্ষা করতে তাদের ক্ষমতায় থাকতেই হবে। আর তাদের বিরোধীরা সমদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে সরকারকে হটাতেই হবে। আর হটানোর জন্য গণতান্ত্রিক পথ বন্ধ প্রায়। তাই যেকোনো পন্থাই জায়েজ। ফলাফল, অনবরত সহিংসতা। আর প্রধান দলগুলোর হানাহানির কিছু সময় পর ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান। ফলে আরও বেশি রক্ত। গত মাসে পাকিস্তানে স্কুলে ঢুকে ঠান্ডা মাথায় এক এক করে গুলি করে প্রায় ১৫০ ছাত্রছাত্রী হত্যা।
অনড় অবস্থানে থাকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। সেই অনড় অবস্থা জন্ম দেয়, সুযোগ করে দেয় সন্ত্রাসী জঙ্গিদের।
যারা সরকারে থাকে, তারা সব সময়ই মনে করে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগানো যাবে। আর এত ন্যক্কারজনকভাবে ফৌজদারি বিচার ্যবস্থার অপব্যবহার, অপপ্রয়োগ অতীতে কখনোই হয়নি। লোকমুখে শুনেছি, সত্য-মিথ্যা জানি না, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে নাকি এখন ৭৮টি মামলা আছে। অর্থাৎ সরকার সর্বতোভাবে বিশ্বাস করে উনি চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী, বোমাবাজ, বোমার কারিগর, পেট্রলবোমা মেরে লোক পোড়ান, দেশদ্রোহী এবং আরও অনেক কিছু। না-হলে এত মামলা কীভাবে হয়?
অবস্থান অনড় থেকে অনড়তর হচ্ছে। আলাপ-আলোচনা, ছাড়, মধ্যস্থতা—এসবের সব সম্ভাবনা এখন তিরোহিত। ঠিক একই রকম অবস্থা বহু দেশে হয়েছে। ফলাফল, ক্রমবর্ধমান সহিংসতা।
তাই শেষের কথা, সহিংসতা আমাদের পিছু ছাড়বে না, যত দিন অবস্থান অনড় থাকবে।
তাই প্রশ্ন শুধু মাত্রা নিয়ে। তবু আবেদন করজোড়ে—দোহাই, মানুষ পোড়াবেন না। মানুষ পোড়ালে দেশ পুড়বে। আমরা সবাই ছারখার হয়ে যাব।
এটাও সত্য, পুলিশ এই আগুন নেভাতে বা সামাল দিতে পারবে না।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট এবং অধ্যাপক, স্কুল অব ল ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।