একজন অসাধারণ মানুষের প্রতিকৃতি

কমরেড অমল সেন
কমরেড অমল সেন

১৭ জানুয়ারি কমরেড অমল সেনের দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামীর সেই সংগ্রাম বিস্তৃত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাল পর্যন্ত। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর ওই সংগ্রামের ভিত্তিভূমিতে ছিল কৃষকের সংগ্রাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাঁর তেভাগার সংগ্রাম কেবল কৃষকের দাবি-দাওয়ার মধ্যেই সীমিত ছিল না, ওই সংগ্রাম যুক্ত হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধের সংগ্রামে। ভারত ভাগের প্রাক্কালে চল্লিশের যাত্রার শুরুতেই সাম্প্রদায়িকতার যে নির্মম প্রকাশ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে চরম বিরোধ সৃষ্টি করেছিল, সৃষ্টি করেছিল পরস্পরের প্রতি অনাস্থা আর অবিশ্বাসের, সেই সময় কমরেড অমল সেনের নেতৃত্বে নড়াইলের তেভাগা সংগ্রামীরা ওই সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দিয়েছিলেন। ওই টালমাটাল সময়ে তেভাগার সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল যেমন জমিদার জোতদারের বিরুদ্ধে, তেমনি তাঁদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সেখানে গড়ে উঠেছিল ‘স্বাধীন পঞ্চগ্রাম’, যেখানে সমাজের সবচেয়ে নিম্নবর্গের লোকেরা দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল রাষ্ট্র ও সমাজের। তার পরিধি যত ছোটই হোক, তাৎপর্যের দিক দিয়ে তা ছিল সুদূরপ্রসারী।
ভারত বিভাগ তেভাগার কৃষক সংগ্রামকে আর এগোতে দেয়নি। একই সঙ্গে ওই তথাকথিত স্বাধীনতা-উত্তরকালে কমিউনিস্ট পার্টি ভ্রান্ত রণকৌশল (ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়, সাচ্চা আজাদি দিলকে লও) ওই কৃষক সংগ্রাম কেবল শোষণ মুক্তির সার্বিক সংগ্রামকেই জনগণ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।
কিন্তু কমরেড অমল সেন দমে যাননি। ভারত বিভাগ ও তৎপরবর্তী পাকিস্তানে মুসলিম লিগ শাসনের চরম নির্যাতন যখন এ দেশের কমিউনিস্ট সংগ্রামীদের দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল, সেই সময় কমরেড অমল সেন মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন স্বদেশে। যে কৃষকেরা তাঁর সংগ্রামের সাথি ছিল, তাদের তিনি পরিত্যাগ করেননি। বরং দেশভাগের নতুন বাস্তবতায় পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের আক্রমণকে মোকাবিলা করে এ দেশে নতুন করে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। এ কারণে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাঁকে ছাড়েনি। পাকিস্তানের অস্তিত্বের ২৪ বছরের ১৯ বছরই তাঁকে কারান্তরালে থাকতে হয়েছে। যেটুকু সময় বাইরে থাকার সুযোগ হয়েছে তার বৃহদংশই আবার আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীবিরোধী ক্রমবিকাশমান লড়াইয়ের অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝেছিলেন যে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটি টিকবার নয়। তাই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিতে।
কিন্তু এখানেও কমরেড অমল সেনকে হোঁচট খেতে হয়েছে। পাকিস্তানের যাত্রা শুরুতে যেমন কমিউনিস্টরা ভুল রণকৌশল নিয়েছিল। এবারও কমিউনিস্টদের বাম অংশ ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’ তত্ত্বে জনগণ ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল।
এই হঠকারিতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কমরেড অমল সেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি, কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার গ্রুপ), বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্রকে এককাট্টা অন্যদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি করেছিলেন, ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’। অনুপস্থিতিতেই যার প্রধান করা হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে। ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ ভারত সরকারের অবিশ্বাস-সন্দেহ, প্রবাসী সরকারের অসহযোগিতার পরও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে তুলেছিল মুক্ত এলাকা, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ নরসিংদী জেলার শিবপুরের মুক্তাঞ্চল এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের অসীম সাহসী লড়াই।
বাংলাদেশ উত্তরকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এসব কমিউনিস্ট সংগঠনকে একত্র করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী), যা পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তন করে হয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
এই পার্টির তিনি ছিলেন সভাপতি। তাঁর নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বাস্তবতায় এই পার্টিকেও ভাঙন-ঐক্যের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তা মোকাবিলায় তিনি পার্টির ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। বর্তমানের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি তাঁর সেই দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের উত্তরাধিকার।
কেবল সংগ্রাম নয়, আদর্শিকভাবেও এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন তাঁর কাছে ঋণী। তেভাগা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘জনগণের বিকল্প শক্তি’ গড়ে তোলার যে তাত্ত্বিক বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তা এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথচলার নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে। এর বাইরে ষাটের দশকের বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিতর্ককেও তিনি তাত্ত্বিকভাবে মোকাবিলা করেছেন তাঁর দুটি ঐতিহাসিক দলিলে: একটি ‘বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা প্রসঙ্গে’, অপরটি ‘কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিতর্ক প্রসঙ্গে’র দুটি রচনায়।
কমরেড অমল সেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারেননি। কিন্তু কি দর্শন, কি বিজ্ঞান, কি চিকিৎসাশাস্ত্র—সব ক্ষেত্রেই ছিল তাঁর সমান ব্যুৎপত্তি। কবিও ছিলেন তিনি। কৃষকের সংগ্রাম নিয়ে লিখেছেন কবিতা। জেলখানায় মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে বিশিষ্ট ভূমিকায় তাঁর অভিনয় পারদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। অকৃতদার এই কমিউনিস্ট বিপ্লবী সমাজ সংসারের এমন সাধারণ জ্ঞান রাখতেন, যা পারিবারিক জীবনে অভ্যস্ত অনেকের কাছেই অজানা।
কমরেড অমল সেন কেবল একজন কমিউনিস্ট নন, পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন। প্রতি মৃত্যুবার্ষিকীতে তাই সারা দেশের মানুষ সমবেত হন তাঁর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনের জন্য।
কমরেড অমল সেন চিরজীবী থাকবেন আমাদের মাঝে। লাল সালাম কমরেড।
রাশেদ খান মেনন: সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী, বাংলাদেশ সরকার।