একজন শিক্ষক কমে গেল

হাতে–কলমে শেখাচ্ছেন এমদাদুল হক
হাতে–কলমে শেখাচ্ছেন এমদাদুল হক

শরীরে ক্যানসারের বিষ। ভাঙা হাতখানা কাঁধে ঝোলানো। এ শরীর নিয়েই কথা বলছেন ক্লাসে। এক হাত দিয়ে লিখছেন ব্ল্যাকবোর্ডে। তখন চলছে ঈদের ছুটি। নিজের চিকিৎসা করাতে গিয়ে কিছুদিন তাঁর পক্ষে ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয়নি। বন্ধের দিনে সেই ক্লাস পুষিয়ে দিচ্ছেন। তিনি আমাদের শিক্ষক এমদাদুল হক। অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের পিছিয়ে পড়া শিশুদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য রাতের বেলায় আরেক দফা পাঠদান করতেন।
তিনি বলতেন, ‘ক্লাস না করে সরকারের টাকা নিয়ে আমার চিকিৎসা করাব, তার চেয়ে বিষ খেয়ে মরে যাব।’ এ কথা মাত্র তিন মাস আগের। তাঁকে বিষ খেয়ে মরতে হয়নি। শরীরে যে ক্যানসারের বিষ ছিল, তা-ই তাঁকে শেষ করে দিয়েছে। গত শুক্রবার সকালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছে, একজন শিক্ষক কমে গেল।
গত ১১ অক্টোবর ‘থেমে যাবে রাতের পাঠদান!’ শিরোনামে প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ছবিসহ তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন পড়ে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণের পাঠক তানভীর সিদ্দিকী লিখেছিলেন, ‘স্যার, আপনাকে সালাম দিয়ে খাটো না করে জাতীয় পতাকার সম্মানের মতো সম্মান দিতে ইচ্ছা করছে। স্যার, আপনার পায়ের ধুলো মাথা পেতে নিতে চাই। মনে পড়ে গেল স্কুলের সেই জীবন, স্যারের শাসন ও মমতার আদর।’
বিপ্লব রায় নামের আরেকজন লিখেছিলেন, ‘স্যার, আপনার মতো মানুষগুলো এখনো নীরবে বেঁচে আছেন বলেই এই সমাজে এখনো আলো জ্বলে। আপনাকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। বিধাতা আপনার মতো মহান মানুষকে রোগমুক্তি দিন।’ খান রহমত উল্লাহ নামের এক পাঠক লিখেছিলেন, ‘স্যার, আপনাকে হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আমাদের কলুষিত সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে আপনার মতো মানুষদের বেঁচে থাকা খুবই দরকার। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আপনাকে সুস্থ করে তোলেন।’
অনেকের মতো বড় আশা করে শহীদ আলম লিখেছিলেন, ‘আশা করি, সরকার সঠিক কাজটি করবে। এমদাদুল হকের উন্নত চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা করবে।’ খুবই হতাশার কথা। এই আশার কোনো প্রতিদান শিক্ষক এমদাদুল হকের পরিবার পায়নি।
সে সময় তাঁর স্ত্রী শহিদা বেগম বলেছিলেন, ভাঙা হাত আর শরীরে ক্যানসারের জীবাণু নিয়ে তিনি ক্লাস করার জন্য ছুটে যান। আর ফিরে এসে বিছানায় যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। ইতিমধ্যে তাঁদের সাত লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। এখন প্রতি মাসে এক লাখ টাকার ওষুধ লাগছে।
তাঁর ছেলে মাহামুদুল হক বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রতিবেদক। মেয়ে ইরিন জামান রাজশাহী কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে সম্মান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
এমদাদুল হকের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পীরগাছা গ্রামে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাঘা উপজেলার ধন্দহ অমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অসচ্ছল ও অমনোযোগী শিক্ষার্থীদের জন্য তাঁর রাতের বেলার পাঠদানের প্রচেষ্টা চলছিল অনেক বছর ধরে। এ নিয়ে ২০০৯ সালের ১৭ অক্টোবর প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘রাতের বেলায় আরেক দফা পাঠদান’ শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এরপর বিষয়টি সরকারের নজরে আসে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাঁকে বিদেশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-২-এর অধীনে ‘স্কুল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিটি পার্টিসিপেশন’ প্রকল্পের আওতায় সাত দিনের জন্য তাঁকে জাকার্তায় পাঠানো হয়।
গত মে মাসে তাঁর সঙ্গে রাস্তায় দেখা। মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে গাড়ি থামালেন। মুখে সেই অমলিন হাসি। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘চিকিৎসকেরা বলছেন, আমার নাকি ক্যানসার হয়েছে।’ এমনভাবে বললেন, যেন ক্যানসার তাঁর কাছে কিছুই নয়। তখনই তাঁর একটি ছবি তুলি। ৩০ মে প্রথম আলোয় ছাপা হলো, ‘বাঘার সেই শিক্ষক ক্যানসারে আক্রান্ত’।
কলকাতায় গিয়ে ধরা পড়ে তাঁর ‘বোন ক্যানসার’ হয়েছে। একদফা চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে আসার পর পড়ে গিয়ে তাঁর একটি হাত ভেঙে যায়। তাঁর অস্থিতে ক্ষয় ধরে গিয়েছিল। এ জন্য সেই হাতের ভাঙা হাড় আর জোড়া লাগেনি। এরপর পা ভেঙে যায়। তিনি আর হাঁটতে পারেননি। কিন্তু তিনি মানুষের মধ্যে থাকতে খুব পছন্দ করতেন। ক্যানসারের যন্ত্রণা ভুলে থাকতে পারতেন। তাই শেষের দিকে তাঁকে একটি হুইলচেয়ারে বসিয়ে স্থানীয় বাজারে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে সবার সঙ্গে হাসিমুখে গল্প করতেন, যেন কিছুই হয়নি।
এমদাদুল হক আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু যতবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, ততবার মনে হয়েছে, তাঁর কাছ থেকে নতুন কিছু শিখলাম। চলে আসার সময় মনে হয়েছে, তাঁর কাছ থেকে আরও শেখার রয়েছে।
এখন বারবার মনে হচ্ছে, চারদিকে শিক্ষার নামে যখন বাণিজ্য চলছে, তখন তিনি শরীরে ক্যানসারের বিষ নিয়ে শিক্ষার আলো ছড়ানোর জন্য কী প্রাণান্ত চেষ্টাই না করে গেলেন!
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ: সাংবাদিক।