সত্যনিষ্ঠা বনাম মিথ্যা এবং ইতিহাসের সাথি যাঁরা

তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা
তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা

তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যেমন পাঠকমহলে বহুল প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি সমালোচিতও হয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থে কেউ কেউ বইটিকে খণ্ডিতভাবে ব্যবহারেরও প্রচেষ্টা করেছেন।
সমালোচনাগুলো যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে এবং মুক্ত মন নিয়ে বইটি সম্পূর্ণ পড়ে করলে তা স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্যই হতো। কিন্তু তার বদলে ব্যাপকভাবে বইয়ের লেখককে ব্যক্তিগত আক্রমণ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নানা মিথ্যা ও অপপ্রচারণা অব্যাহত থাকে। মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কন্যাকে এমন যুক্তি-বুদ্ধি ও সত্যবর্জিত আক্রমণ যে তাঁর বাবা ও পরিবারের ওপরেই আক্রমণ, তা এই অপপ্রচারকারীদের বিবেচনাবোধের মধ্যে নেই, তা বলা বাহুল্য মাত্র।
ভিত্তিহীন অপপ্রচারণার মধ্যে একটি বিষয়কে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে এবং সম্প্রতি সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করে এক পত্রিকার সম্পাদকের লেখায়ও উল্লেখিত হয়েছে যে আমার মিসরীয় বংশোদ্ভূত স্বামী মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা। যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুড মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠন এবং যে দলটিকে বর্তমানে মিসর সরকার সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং যে দলটির সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে গণহত্যার দোসর জামায়াতে ইসলামী দলের আদর্শিক সখ্য রয়েছে, সেহেতু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই প্রচারণাটি নিছক অপপ্রচারণাই শুধু নয়, এটি চরিত্র হননকারী, অনৈতিক, মানহানিকর, যা বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ত।
বইটি প্রকাশের পরপরই হঠাৎ এই তথাকথিত আবিষ্কারটি লক্ষণীয় বটে। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দুই শতাধিক তথ্যসূত্র ও অনেক সাক্ষাৎকারের সমন্বয়ে বাবার জীবনকর্ম সম্পর্কে রচিত এই বইয়ের সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুডের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? অথবা আমার স্বামীকেই বা কেন ব্রাদারহুডের সদস্য প্রতীয়মানের প্রচেষ্টা? অপপ্রচারণাগুলো এত দূরেই গড়ায় যে আমার স্বামীর সঙ্গে তাহরির স্কয়ারে বিজয়ের আনন্দঘন দিনটি, যা উদ্যাপন করতে সারা বিশ্ব থেকেই মানুষ এসেছিল এবং আমরাও আমেরিকা থেকে গিয়েছিলাম, তার সঙ্গেও ব্রাদারহুডের সম্পৃক্ততা করা হয়। আমার হাতে ধরা মিসরীয় পতাকাকে বানিয়ে দেওয়া হয় ব্রাদারহুডের পতাকা। মিসরীয় খ্রিষ্টান-মুসলিম নাগরিকদের সমন্বয়ে ২০১১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির দিনটি ছিল স্বৈরাচারের পতনে সর্বজনীন বিজয় উৎসব। আমার স্বামীর মাতৃভূমিতে, সেদিনের তাহরির স্কয়ারের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার লেখা দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এবং হ্যাঁ, পত্রিকায় বিজয় উৎসবে গণমানুষের সঙ্গে আমার হাতে ধরা মিসরীয় পতাকার ছবিটিও ছাপা হয়েছিল।
সত্যসন্ধানী পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে ড. আমর খাইরি আবদাল্লা, যিনি আমার স্বামী, তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড, চরমপন্থী বা সন্ত্রাসী কোনো দলের নেতা, সদস্য বা সমর্থক হওয়া তো দূরের কথা, তিনি শান্তি ও সংঘর্ষ শিক্ষার একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক, প্রশিক্ষক ও গবেষক। গুগুলে DR. AMR KHAIRY ABDALLA-র কর্মকাণ্ড দেখে নিতে পারেন। তাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হয় আমার মা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পুনর্জাগরণের নেত্রী ও দলের দুঃসময়ের কান্ডারি সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের পছন্দ ও ইচ্ছায়। যুক্তরাষ্ট্রের ফেয়ারফ্যাক্স কাউন্টিতে কর্মরত বিচারকেরা, যাঁরা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন, তাঁদের সম্মাননা প্রদান দিবসে আমার মায়ের সঙ্গেই প্রথম আমরের পরিচয় ঘটে এবং সেই পরিচয় পরিণত হয় তাঁর মেয়ের সঙ্গে আমরের বিয়ে হোক এমন আকাঙ্ক্ষায়। আমরের মা ও বাবা দুজনেই স্বনামধন্য বিচারপতি হিসেবে মিসরে কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন। আমরেরও আইনজীবীরূপে কর্মজীবন শুরু হয় কায়রোতে। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হিসেবে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেসে লড়াই করেছেন। ১৯৮১ সালে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অফিসে কর্মরত তিনি ও তাঁর কৌঁসুলি টিম মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ইসলামি জিহাদ মৌলবাদী সংগঠনের সদস্যদের তদন্তের মাধ্যমে বিচারের কাঠগড়ায় নেন। বিশ্বে শান্তি ও সংঘর্ষ শিক্ষার পথিকৃৎ যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মেইসন ইউনিভার্সিটিতে তিনি পরবর্তী সময়ে ডক্টরেট করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। এর পরে জাতিসংঘ নির্দেশিত কোস্টারিকার ইউনিভার্সিটি ফর িপসে (UPEACE) যোগ দিয়ে ডিন ও ভাইস রেকটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ইথিওপিয়ায় আদ্দিস আবাবা ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজে (IPSS) নীতি বিশ্লেষণ ও গবেষণার সিনিয়র অ্যাডভাইজর পদে কর্মরত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের রিসার্চ মেথড পড়িয়েছেন, ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ শিক্ষা বিভাগের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে তিনি সংঘর্ষ ও সন্ত্রাস দমনে সহায়ক শান্তি শিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিক্ষার্থীরা UPSAM-এর বৃত্তি নিয়ে UPEACE থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেছেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারসহ বিভিন্ন স্টেটে সন্ত্রাসী হামলায় মুসলিমদের জড়িত থাকার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে যখন ইসলাম ও মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়ে আমরের সৃষ্ট ‘SAY PEACE’ প্রজেক্ট তৃণমূলে মূলধারার আমেরিকানদের কাছে ইন্টারেক্টিভ কর্মশালার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের শান্তিপূর্ণ নীতিমালার ব্যাখ্যা সফলভাবে প্রদান করে বহুল প্রশংসিত হয়।
আলোচিত বইটি আমার বাবার জীবন, কর্ম, আদর্শ ও আত্মত্যাগের ওপর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত, যেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার প্রেরণা এবং তাজউদ্দীন আহমদকে স্বাধীনতার সফল বাস্তবায়ক বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভিন্ন মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা প্রেরণের একমাত্র জীবিত সাক্ষী ওনার পার্সোনাল এইড বর্ষীয়ান হাজি গোলাম মুরশেদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের মধ্যে তথ্যটি প্রথম এই বইতেই প্রকাশিত হয়। উনি ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
ক্ষুদ্র স্বার্থসংশ্লিষ্ট অপপ্রচারণা, মিথ্যা অপবাদ ও খণ্ডিত উপস্থাপনার বিপরীতে বইটি পাঠ করে বরেণ্য পণ্ডিত ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব, যাঁরা তাঁদের মতামত দিয়েছেন, তা আজকের লেখার পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরা হলো।
১৯৭১ সালে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের আইজি গোলক মজুমদার, যিনি প্রথম বাংলাদেশ সরকার ও আমার বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন, তিনি বইটি সম্পর্কে নিজ হাতে লেখেন, ‘শারমিন আহমদ রচিত বইটি পড়ে আমি মুগ্ধ। পিতার ভাবমূর্তি কন্যা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন এই বইতে। বইটিতে কোনো অত্যুক্তি নেই, নেই কোনো উচ্ছ্বাস। প্রতিটি ছত্রে তাজউদ্দীন সাহেবের উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করি।’
যশস্বী লেখক ও গণিতের পণ্ডিত ড. মীজান রহমান বইটি সম্পর্কে লিখেছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা এমন একটি গ্রন্থ, যাতে পাঠক তার দেশের মাটিতে জন্মলব্ধ একজন প্রায়-অজ্ঞাতনামা বিশাল নেতাকে তাঁর বিশাল মূর্তিতেই দেখতে পাবে, সঙ্গে দেখতে পাবে তাঁর সৌম্য-স্নিগ্ধ পিতৃমূর্তিটাকেও। এ বই তাদের মনে নতুন উদ্দীপনা জোগাবে দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে, তাজউদ্দীনের স্বপ্নকে, যার একাংশও তাঁর পক্ষে সফল করা সম্ভব হয়নি, বাস্তবে পরিণত করার উদ্যোগ নিতে।’
বইটি সম্পর্কে ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান উল্লেখ করেন, ‘লেখক নানা দলিলপত্র, রচনা, সাক্ষাৎকারের সাহায্যে সত্যের যত দূর কাছে পৌঁছা যায়, সেই চেষ্টা করেছে। এই চেষ্টার জন্য, প্রয়াসের জন্য তাকে বিশেষ করে অভিনন্দন।’ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘বইটি লেখার যে প্রেক্ষিত, এটি অপূর্ব। আমি এ রকম প্রেক্ষিতে লেখা বই আর হাতে পাইনি। যে চ্যালেঞ্জগুলোর বাংলাদেশ আজ মুখোমুখি হচ্ছে ৪৩ বছরে, সে কথাগুলো কিন্তু এর মাঝে পরিস্ফুট হয়েছে।’ অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার প্রয়োজন মেটাবে বইটি...এই বইটি আমার মনে হয় আমাদের সবার পড়তে হবে।’ ডেইলি স্টার পত্রিকার তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ বদরুল আহসান লেখেন, ‘A remarkable focused work that will enable students and scholars of Bangladeshe’s history to understand the legacy of the Bengali struggle for freedom better. History must be presented to the nation in its’ entireity. And you, Sharmin Ahmad have done a superb job of it through yor book.’ সাংবাদিক ও কবি সোহরাব হাসান বইটিকে মূল্যায়ন করেন এভাবে, ‘এই বইয়ে তিনি কেবল একজন স্নেহশীল পিতার প্রতিকৃতিই নয়, একটি জাতির জয়-পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন...শারমিন ইতিহাস বিচারে যথাসম্ভব বস্তুনিষ্ঠ থাকতে চেষ্টা করেছেন।’
বাংলাদেশের প্রকট রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে অখণ্ডিত ও সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিক ঘটনাবলির উপস্থাপনা সুকঠিন সংগ্রাম। তা সত্ত্বেও ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয় যে সত্যকে কখনো মিথ্যা প্রচারণা ও অপবাদ দিয়ে চিরকাল ঢেকে রাখা যায় না। বোদ্ধা ও দূরদর্শী যাঁরা, তাঁরা সে কথা স্মরণে রেখে ইতিহাসের গতি রুদ্ধ করার চেষ্টা করেন না। তাঁরা ইতিহাসের সাথি হন। ইতিহাসের সঙ্গে যান। স্বাধীনতার আকাশে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি যে নক্ষত্রটি দীপ্তিমান, তা হলো তাজউদ্দীন। তাঁর অসাধারণ কীর্তি এবং মহৎ জীবনাদর্শ নিয়ে লেখা তাঁর মেয়ের বইটি বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান কারও উদ্বেগের কারণ হতে পারে না।
শারমিন আহমদ: লেখক, গবেষক, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।