হত্যাযজ্ঞ মহাপাপ ও জঘন্য অপরাধ

ধর্ম
ধর্ম

‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের মূল্যবান জীবন তথা জানমালের নিরাপত্তা বিধান আল্লাহর আমানত রক্ষার শামিল। কোনো পাষণ্ড দুর্বৃত্ত যদি আমানতের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো নিরপরাধ মানুষকে প্রকাশ্যে হত্যা, বিচারবহির্ভূত গুপ্তহত্যা, জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ বা পেট্রলবোমা মেরে পুড়িয়ে মারে, তবে এমন মানবতাবিরোধী জঘন্য হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। কাউকে অকারণে প্রাণনাশ করলে শরিয়তের বিধানে ‘কিসাস’ বা হত্যার বদলে হত্যার মতো ভয়ানক কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। অথচ দেশে হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাত্রীবাহী বাস তথা যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে বা পেট্রলবোমা মেরে বা গুলি করে নিরীহ লোকদের ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে হত্যা করা হচ্ছে। প্রতিদিন সংবাদপত্রের শিরোনামে ভেসে ওঠে এসব নির্মম হত্যাযজ্ঞের বীভৎস চিত্র। অথচ নরহত্যা এমন একটি অমার্জনীয় মহাপাপ ও জঘন্য অপরাধ, যা আল্ল­াহর কাছে কঠিন ও মারাত্মক গুনাহ হিসেবে বিবেচিত। যেমনভাবে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্ল­াহর কাছে ঘৃণ্যকাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ (তিরমিজি)
বিদায় হজের ভাষণে বিশাল জনসমুদ্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের রক্ত তথা জীবন ও সম্পদ পরস্পরের জন্য হারাম এবং অন্যের জানমালের ক্ষতিসাধন করাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কাউকে অহেতুক হত্যা করা সামাজিক অনাচার ও জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। তাই তো অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকে সবচেয়ে বড় গুনাহ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নরহত্যার ভয়ানক পরিণাম সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নরহত্যা বা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ (সুরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৩২)
পরিবারের কোনো একজন সদস্য অকালে নিহত বা হত্যাযজ্ঞের শিকার হলে গোটা পরিবারের ওপরই নেমে আসে শোকের কালো ছায়া। তা ছাড়া, পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক নানাবিধ সমস্যা তাদের ওপর চেপে বসে। সর্বোপরি মাতৃস্নেহ ও পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় নিহতের সন্তানসন্ততিরা। বিধবা হন স্ত্রী অথবা স্বামী হন স্ত্রীহারা। মা-বাবা হারান তাঁদের কলিজার টুকরা সন্তান। পৃথিবীতে নরহত্যার চেয়ে বিরাট বড় জুলুম আর কী হতে পারে? তাই তো আল্লাহ তাআলা জালিমকে অবকাশ দেন, এরপর যখন হত্যাকারীকে পাকড়াও করেন, তখন আর তাকে ছাড় দেন না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়, তাদের জন্য কঠিন শাস্তি।’ (সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ৪২)
শান্তির ধর্ম ইসলামে সব ধরনের হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাত, অরাজকতা, সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই কিয়ামতের দিন নরহত্যার বিচার করা হবে সর্বাগ্রে, তারপর মানুষের অন্যান্য অন্যায়-অপরাধের শাস্তি পর্যায়ক্রমে প্রদান করা হবে। অহেতুক রক্তপাত ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ থেকে মানুষকে বিরত ও দূরে থাকার নির্দেশ দিয়ে রাসুলুল্ল­াহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে প্রথম যে মোকদ্দমার ফায়সালা হবে, তা হলো রক্তপাত বা হত্যা-সম্পর্কিত।’ (বুখারি, মুসলিম) হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতা ও হত্যাকারীর জন্য কঠোর শাস্তির ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীর চুলের মুঠো ও মাথা ধরে আল্লাহর সামনে এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে তখন তার রগগুলো থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে। সে ফরিয়াদ করবে, হে আমার প্রভু! এই ব্যক্তিই আমাকে হত্যা করেছে। এ কথা বলতে বলতে সে আরশের নিকটবর্তী হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি, নাসাঈ)
মানবতা ও নৈতিকতার কোনো স্তরেই নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও অহেতুক রক্তপাতকে সমর্থন করা হয় না। মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পবিত্র কোরআনে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা কোরো না।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৩) কোনো মুসলমান যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অবৈধ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না হবে, ততক্ষণ দীনের পাকড়াও থেকে মুক্ত থাকবে। অবৈধ হত্যার আগ পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহর রহমতের মধ্যে বিচরণ করতে থাকে। যখনই কেউ অবৈধ হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়, তার ওপর থেকে আল্লাহর রহমত উঠে যায় এবং গজব নেমে আসে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একজন প্রকৃত মুমিন তার দীনের ব্যাপারে পূর্ণ প্রশান্ত থাকে, যে পর্যন্ত সে অবৈধ হত্যায় লিপ্ত না হয়।’ (বুখারি)
নরহত্যাকারী বোমাবাজদের ভয়ে মানুষ রাস্তাঘাটে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। সামাজিক জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তাই মানুষের সব অন্যায়-অপরাধ মাফ করলেও আল্লাহ তাআলা হত্যাকারীকে ক্ষমা করবেন না। হত্যাকৃত ব্যক্তি ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যুবক-বৃদ্ধ, অসহায় নারী-শিশু যে রকমই হোক না কেন, হত্যাকারীকে এর প্রতিফলস্বরূপ দুনিয়ায় প্রচলিত আইনে ও আখিরাতে জাহান্নামের কঠোর মহাশাস্তি পেতেই হবে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যদি আসমান-জমিনের সব অধিবাসী একজন মুসলমানকে অবৈধভাবে হত্যা করার জন্য একমত পোষণ করে, তবে আল্ল­াহ তাদের অবশ্যই জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)
পেশিশক্তির জোরে কোনো ধরনের সহিংসতা, নৃশংসতা, অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়, হানাহানি, উগ্রতা, বর্বরতা, খুন-খারাবি, হত্যাযজ্ঞ ঘটানো বিবেকবান ও ধর্মপ্রাণ সভ্য মানুষের কাম্য নয়। ইসলাম এমন জঘন্য অপরাধ থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। তাই সব ধরনের নাশকতা, হত্যাকাণ্ড, ফেতনা-ফাসাদ, জ্বালাও-পোড়াও, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সংঘাতমুক্ত দেশের প্রয়োজনে ইসলামের শান্তিপ্রিয় মর্মবাণীর আদর্শে জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় ঐকমত্য, বিভিন্ন দলমতের পারস্পরিক সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমে মানুষের জীবন-জীবিকা তথা জানমালের নিরাপত্তা বজায় রাখা এখন সময়ের দাবি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]