চাষের কই ও চাষের নজরুল

তরিতরকারি বিক্রি করে বেশির ভাগ নোয়াখালীর লোক। ওদের সঙ্গে ‘নওয়াহাইল্যায়’ কথা বলাতে ওরা জানে আমার বাড়ি নোয়াখালী। ওদের ভুল ভাঙাই না। যারা ফরিদপুরের, তারা ভাবে আমি ফরিদপুরের। কেউ ভাবেন জসীমউদ্দীন আমার বাবা। ওদের ভুল ভাঙাই না। পুরান ঢাকায় যতগুলো বাজার, অনেক দিন পর পর গিয়ে হাজির হই। রায়সাহেব বাজারের একজন বললেন, আপনাকে না দেখে ভাবলাম, আপনি নাইক্যা। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল: ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ অর্থাৎ তাঁর কাছ থেকে এসেছি, তাঁর কাছেই ফিরে যাব। এতে দোষ নেই। এক চেনা ব্যক্তি তার নিজ মৃত্যুর পর ইসালে ছওয়াবের আয়োজন নিজেই সমাধা করে ফেলেছে। এতে দোষ নেই। যা দিনকাল পড়েছে, মৃত্যুর পর দরদি লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর বিবেচনায় এই ব্যবস্থা। চকবাজারের পাইকারি বাজারে অনেক ধান-চালের সওদাগর। এদের একজন আমাকে আব্বাসউদ্দীন নামে চেনে। আমি বাধা দিই না। তবু তো আমার বাবার নামটা উচ্চারিত হয়েছে।

মিডিয়া থেকে নজরুল-আব্বাসউদ্দীন-আলাউদ্দিন-জসীমউদ্দীনের নাম উধাও। জন্মদিনে কখনো বা নজরুলের ছবি ভেসে ওঠে। ওদের দয়ার অবধি নেই। জাতীয় কবির এহেন দুর্দিন কেন ঘটেছে তা নিয়ে লেখালেখি করেও কোনো লাভ হয়নি। যা হওয়ার তা হবে। নিজ সম্পদ বিস্মৃত হলে সমূহ বিপদ। অন্যেরা ওত পেতে আছে, সুযোগ পেলেই ওরা উড়ে এসে বসবে জুড়ে। কিছু ভালো খবর এই মুহূর্তে দেওয়া যায়, তা হলো গত দেড় বছরে ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছি, নাম হলো নজরুল ইসলাম: ম্যান অ্যান্ড পোয়েট। চার শ পৃষ্ঠাব্যাপী গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তার সম্বন্ধে পূর্ণ তথ্য বিশ্বের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো সম্ভব হবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, কবির মাত্র তিন শ কবিতা বা গান এযাবৎ ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। আরও ভালো খবর, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক আমার অধীনে আরবিতে কবির জীবনী লেখার উদ্যোগ নিয়েছেন। এটি হবে আরবিতে তাঁর সম্বন্ধে প্রথম জীবনীগ্রন্থ। তেমনি ফরাসি ভাষাতেও আমার একজন ছাত্র এই কাজে ব্রতী হয়েছেন।

বাংলার স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নজরুল পড়ানোর ব্যবস্থা অপ্রতুল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেনদরবার করেও কোনো উত্তর পাইনি। এঁরা নজরুল চেনেন না, নেই তাঁর  প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা এঁদের অন্তরে। জাতীয় কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়েও নজরুল সম্পর্কে নেই উপযুক্ত কর্মকাণ্ডের আয়োজন, সবই যেন এক দিনের জন্য নির্ধারিত। লোকসংগীত সংরক্ষণের কাজে হাটে-বাজারে অসংখ্য নজরুল ইসলামের দেখা পেয়েছি, যারা তার নামকে ধারণ করে অথচ নামের কারণে সামান্যতম বোধোদয় নেই তাদের চরিত্রে।

বহুদিন আগে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম, তা বছর চল্লিশেক আগে। কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁরা কেন এখানে পড়তে এসেছেন। বললেন, ‘অন্যখানে সুযোগ পাইনি, তাই বাধ্য হয়ে এখানে এসেছি।’ কোনোরকমে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে বিশ্বভারতী চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসি, তাই শান্তিনিকেতন আমার স্বপ্নের নিকেতন। তাদের জিজ্ঞেস করলাম, রবীন্দ্রনাথের গান বা সাহিত্য কি তোমাদের এখানে টেনে আনেনি? তারা এমনভাবে উত্তর দিল যেন রবীন্দ্রনাথ এখানে একজন অতিথি অধ্যাপকের বেশি নয়। নজরুল নামাঙ্কিত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তেমনি আমরা খুঁজে ফিরছি শতসহস্র ‘চাষের বিদ্বান’, নজরুলের উত্তরাধিকার সুদূরপরাহত।

চাষের কই দিয়ে শুরু, চাষের গল্প দিয়েই শেষ করি ‘পুড়িব একাকী’ থেকে:

এক কবি এসেছেন গ্রাম থেকে। ভদ্রলোককে আদর করে এক কাপ চা খাওয়াতেই সে গলে গেল। কিন্তু এরপর সে যা বলল তাতে নজরুলের প্রায় ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। বলল, পড়াশুনা করেছি ক্লাশ এইট, বাবরি চুল আপনারই মতন এবং কবিতা পনের হাজার। তা হলে নজরুল ইসলাম হতে পারব না কেন?

নজরুল হতবাক। কথা সঞ্চয় করে বললেন, হক কথা। তোমার কাছে হার মানে এ কবি। এত সহজেই তুমি আমাকে পরাস্ত করেছ যে বলার নয়। যেহেতু কম বয়স্ক বলে মনে হচ্ছে, কদমবুসি করা থেকে বিরত হলাম।

ভদ্রলোক নজরুলের কথা বুঝতেই পারল না। বলল, এই গানগুলো নিয়ে আমি এখন কী করি?

: আমি যা করেছি তাই করুন

: আপনি কী করেছেন?

: আমার সব গান জনগণের কাছে বিলিয়ে দিয়েছি। নিজেই জানি না কত গান লিখেছি, কাকে দিয়েছি, কখন দিয়েছি, কেমন করে দিয়েছি। কিছু গান গ্রামোফোনে রেকর্ড হয়েছে, গীতিকার হিসেবে আমার নাম আছে, বই বেরিয়েছে, সেখানে আমার নাম আছে। বাকি গানগুলো ভক্তরা সারা দিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

ভদ্রলোক ভ্যাবাচ্যাকা। ‘তাহলে গানগুলো শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে যাকে পাই তাকে একটা করে ধরিয়ে দি, কী বলেন?’

নজরুল বললেন, ‘জি, তাই করুন’।

l মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।