জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠন

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় পরিমাণ ও সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও গুণগত ও কাঙ্ক্ষিত মান কতটুকু হয়েছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। গুণগত মানের দিক থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়টির অধীন ২ হাজার ১৫৪টি কলেজে দেখা দিয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত ও প্রশাসনিক দুর্বলতা, দুর্নীতি এবং পৌনঃপুনিক সেশনজট। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের স্নাতক পর্যায়ের মোট ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে পড়ালেখা করছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ও বেসরকারি কলেজে শিক্ষার্থী রয়েছেন প্রায় ২১ লাখ। এর মধ্যে ২৭৯টি সরকারি কলেজে শিক্ষার্থী ১৩ লাখের বেশি।
গত বছরের ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয় এমন সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। এ বিষয়ে ইউজিসি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং সম্প্রতি এক সভায় উপাচার্যরাও এর পক্ষে মত দেন। ইউজিসির একটি কমিটি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ পুনর্বিন্যাস বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশমালা তৈরির জন্য কাজ করছে। এ বিষয়ে আলোচনা, একাডেমিক বিতর্ক চলমান আছে। প্রতিবছর কয়েক লাখ ছাত্রছাত্রী ভর্তিযুদ্ধে লিপ্ত হন এবং সবচেয়ে মেধাবীরা দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভর্তি হন। কিন্তু বাকি ছাত্রছাত্রীরা প্রধানত ভর্তি হন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর একটি অংশ ভর্তি হয় দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ধনিক শ্রেণির সন্তানদের পছন্দ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আমি তাঁদের আলোচনার বাইরে রাখছি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমস্যা হলো সেশনজট, যা দুই থেকে চার বছর অবধি ব্যাপ্ত। বিশ্ববিদ্যালয়টি চলছে পুরোনো কোর্স পদ্ধতিতে, সেমিস্টার পদ্ধতিতে নয়। যেখানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে সেমিস্টার পদ্ধতি এবং তেমন কোনো সেশনজট নেই, সেখানে কোর্স পদ্ধতিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট কেন হয়? তার একটা কারণ অবশ্যই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সমস্যা এবং এর গঠন কাঠামো। যদিও কর্তৃপক্ষ হরতালে পরীক্ষা বন্ধ রাখার কথাও বলে থাকে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কী কারণে ব্যর্থ হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। শিক্ষাবিদেরা ঘরোয়া আলোচনার সময় বলে থাকেন যে এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটি একটি জাতীয় পরীক্ষা বোর্ড। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে কেবল পরীক্ষা গ্রহণ এবং ফল প্রকাশ ছাড়া আসলে তেমন কিছু করে না। সারা দেশে পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশ করতে গিয়ে এরা নির্ভর করে থাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কলেজের শিক্ষক এবং বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর। তাঁদের নিয়েই পরীক্ষা কমিটি হয়। ফলে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘসূত্রতা ও ফল প্রকাশে বিলম্ব হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকমণ্ডলী, যাঁরা প্রশিিক্ষত ও গুণে-মানে দেশসেরা হবেন, এমন কাজটা করতে পারেননি। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় কাজটা করাটাও বোধ হয় কঠিন। বর্তমান কাঠামো অবিকল রেখে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে এতগুলো পরীক্ষা সমগ্র বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে ও সময়মতো পরিচালনা করা যে কারও পক্ষেই অসম্ভব। বাংলাদেশ কেন, উন্নত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা জাপান—কারও পক্ষে এত বৃহৎ কাঠামোতে এত পরীক্ষা চালানো সম্ভব নয়। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নিয়ে দুর্নীতি ও জালিয়াতির এক ভয়াবহ চিত্র একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ‘তালাশ’ নামক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গুদামে রিক্ষত খাতাগুলো বদলিয়ে নতুন খাতা বসাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণস্থ জালিয়াত চক্র।
ঢাকা এবং তার আশপাশে যানজট তৈরির ক্ষেত্রেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীভূত অবস্থানও কিছুটা দায়ী। প্রায় ২৫ লাখ ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের অভিভাবকেরাসহ প্রায় লাখ খানেক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেককেই গাজীপুরে আসতে হয়।
রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমানতালে কলেজের শিক্ষাব্যবস্থাপনায় জড়িত ছিল। সেই বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাকে শক্তিশালী না করে বরং ঢাকায় আসতে ব্যগ্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন ভিসি ১৯৭১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সহযোগী প্রফেসর এম এ বারীকেই একটি কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যদি সরকারি কলেজের ১৩ লাখ শিক্ষার্থীকে সরিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অানা হয়, তবে ঢাকার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ওপর যেমন চাপ কমবে, তেমনি বিকেন্দ্রীকরণের ধারণাও বিকাশ লাভ করবে। বিকেন্দ্রীকরণের আরও একটি ভালো দিক আছে। আর তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হবে এবং উদার ও মুক্ত গণমাধ্যমের যুগে আলোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমে এ রকম একটি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো খুব কষ্টসাধ্য বিষয় নয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান যে দেশের সব সরকারি ও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে, তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ কি অস্বীকার করতে পারবে? ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন, বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের জরিপ এবং গণমাধ্যমগুলোতে উঠে আসা চিত্র বিশ্লেষণ করলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির দিকটি লক্ষণীয়। ইউজিসির প্রতিবেদনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রিধারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত। বৃহৎ কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থায় গুণগত মান অর্জন বাংলাদেশ কেন, উন্নত বিশ্বের কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন এবং নতুন বিন্যাসের মাধ্যমে একটি বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার উদ্ভাবন।
প্রাসঙ্গিকভাবে আমি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সংস্কারে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসৃত বিশ্বমানের পরীক্ষা পদ্ধতিকে আরও সময়োপযোগী করার দাবিকে সমর্থন করি। প্রতিবছর সবার শেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করে থাকে। যদি প্রস্তাবিত পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারি কলেজগুলোকে ন্যস্ত করা হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষার সময়ই একই সঙ্গে দুটি কাজ করতে পারে। প্রথমত, ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে সবচেয়ে মেধাবীদের নিয়ে একটি তালিকা প্রণয়ন করবে, যাঁরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা কলেজে সরাসরি ভর্তি হবেন। দ্বিতীয় তালিকা থেকে শিক্ষার্থীরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহে ভর্তি হবেন। এতে শিক্ষার্থীদের আর্থিক ব্যয় এবং সময় দুটোই কমে যাবে। কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এখন যেমন একাধিক ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়, তখন একটি পরীক্ষাই দিতে হবে।
আশফাক হোসেন: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।