সহিংস রাজনীতি, উত্তরণের উপায়

মানুষের এক নম্বর আকাঙ্ক্ষা জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা। প্রধানত এ কারণেই মানুষ সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপন শুরু করে, রাষ্ট্র গঠন করে। যৌক্তিকভাবেই সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তার বিষয়টি মানুষের অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। সরকার গঠন ও প্রতিপালন করার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের নিরাপত্তা বিধান। একইভাবে প্রতিটি মানুষ নিজস্ব জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তায় সমাজের কার্যকর ভূমিকা আশা করে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সহিংসতা চলছে, প্রতিদিন জানমালের ক্ষতির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রতিটি নাগরিক নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তায় জীবনযাপন করছে। অর্থাৎ সরকার তার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। একই সঙ্গে বিবদমান রাজনৈতিক দলসমূহ মানুষের নিরাপত্তা লাভের অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
সরকার এসব হিংসাত্মক কাজের সহযোগী ও উদ্যোক্তা হিসেবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোটকে দায়ী করছে। সরকারদলীয় সংগঠনসমূহ এমনকি সরকারি প্রশাসনে জড়িত ব্যক্তিবর্গ থেকে প্রচার অভিযান চালানো হচ্ছে: মানুষকে পুড়িয়ে মারা রাজনীতির ভাষা হতে পারে না, বিরোধী রাজনৈতিক জোট সন্ত্রাসী, কাজেই তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসা যায় না, তাদের প্রয়োজনে নির্মূল করতে হবে ইত্যাদি।
সরকারবিরোধী জোট থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছে। তাদের মতে, সরকারি দল আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নিজেরাই সহিংসতা সৃষ্টি করছে। পাল্টা অভিযোগ করা হচ্ছে, সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের সহায়তায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মিথ্যা অজুহাতে গ্রেপ্তার, হয়রানি, অত্যাচার, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে নিঃশেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের ব্যঙ্গোক্তি হলো, এটা কী ধরনের রাজনীতি, জনগণের ভোট না নিয়েই সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ইত্যাদি হওয়া ও সেটা টিকিয়ে রাখতে জনগণের ওপর নিপীড়ন নিষ্পেষণ চালিয়ে যাওয়া।
মনে হচ্ছে, সমস্যাটি দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে ও ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা যায়, দুটি বিবদমান রাজনৈতিক শক্তি পরস্পরকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। দুই পক্ষের জনসমর্থন যথেষ্ট ও সে শক্তিতে কাছাকাছি। কাজেই একতরফা ও কম সময়ে সহজেই যুদ্ধ জয় কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারবিরোধী প্রতিপক্ষের অভিযোগ, সরকারি দলের সঙ্গে সরকারি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকায় তারা নিজেকে অধিকতর শক্তিশালী মনে করছে এবং কোনো সমঝোতার মনোভাব দেখাচ্ছে না। সরকারি বাহিনীসমূহকে ঢালাও ক্ষমতা প্রয়োগের নির্দেশ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে বিরোধীপক্ষকে নির্মূলের অভিযানে নামানো হয়েছে। কাজেই তাদের লড়াই অস্তিত্বের। কার্যত তাদের পিঠও দেয়ালে ঠেকে গেছে। আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের কাছে কোনো বিকল্প নেই।
সমস্যার কারণ চিহ্নিত করতে হলে, মূল বিষয় হিসেবে দেখা যায়, বর্তমান সরকার কর্তৃক গত মেয়াদে সংবিধানের ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন–প্রক্রিয়ায় ব্যাপক রদবদল এবং নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের পূর্ব থেকে এ বিষয়ে সরকারবিরোধী জোটের আন্দোলন চলছিল। বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জন করে এবং তা সত্ত্বেও নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়।
সরকারবিরোধীদের বক্তব্য, সে নির্বাচনে সিংহভাগ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার ব্যবস্থা করা হয়। নির্বাচনী তফসিল ও ফলাফল ঘোষণা ছাড়া সেসব স্থানে বাস্তবে কোনো নির্বাচনী কর্মকাণ্ড ঘটতে দেখা যায়নি। বাকি কিছু আসনে যেখানে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড হয়েছে বলা হচ্ছে, সেখানকার জনগণ ও প্রার্থীদের অধিকাংশের মতে, ভোটারের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। তাদের অভিযোগ, সে নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে ও প্রকৃত ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যার ভিত্তিতে নয়, পূর্বনির্ধারিত ফলাফল অনুযায়ী ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাদের মতে, ভবিষ্যতে সব নির্বাচনে একইভাবে সরকারি দল নির্বাচনী ফলাফল নিজের পক্ষে নেবে বলে আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। ফলে তাদের দাবি হচ্ছে, সংবিধানের নির্বাচনের পদ্ধতিসংক্রান্ত ওই সংশোধনী বাতিল করে আগের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অথবা আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে অন্য কোনো পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। সে প্রক্রিয়ায় যথাশিগগির সম্ভব একটি মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে নতুনভাবে সংসদ ও সরকার গঠন করার উদ্যোগ নিতে হবে।
এ দাবিগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারপক্ষের দায়িত্বশীল নেতা-নেত্রীদের বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে যে সরকার এ ব্যাপারে কঠোর পথ অবলম্বন করেছে। বিরোধীপক্ষকে নির্মূল করে হলেও তারা সেভাবেই সমস্যা সমাধান করবে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নয়। ফলে কী ঘটছে তা আগেই বলা হয়েছে। অধিকন্তু, অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সরকারবিরোধী দলগুলোর জোট সাংগঠনিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী ও তাদের জনসমর্থনও কম নয়। কেননা, যেকোনো জাতীয় নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যায় তারা মোট ভোটের এক-তৃতীয়াংশের ওপরে ছিল। এ ধরনের একটি দলকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব বলে মনে হয় না। আন্দোলন আপাতত যেকোনো প্রক্রিয়ায় যদিওবা দমন করা যায়, পরিস্থিতির স্বাভাবিকত্ব খুব বেশি দিন ধরে রাখা যাবে না বলে আশঙ্কা হয়। ফলে সরকারের তরফ থেকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না। তা ছাড়া, এ ধরনের কার্যক্রম গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিপন্থী। প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার মালিক দেশের প্রতিটি জনগণ। তাদের একটি বৃহৎ অংশের মতামতকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা বাঞ্ছনীয় নয়।
সরকারের এবং সরকারদলীয় জোটের কাছে এখন সমস্যা সমাধানের একটিমাত্র পথই খোলা আছে, সেটি হলো বিরোধীপক্ষের সঙ্গে উপরিউক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা। একই সঙ্গে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের সংস্কৃতি গড়ে তোলার স্বার্থে আরও কিছু রাজনৈতিক বিষয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মতৈক্যের ভিত্তিতে সুরাহার প্রচেষ্টা নেওয়া যেতে পারে। এ অবস্থায়, বিবদমান ওই জোট দুটির বাইরের অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি বৃহত্তর সংলাপের আয়োজন করা যেতে পারে।
নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়সমূহ, যেমন: নির্বাচনপদ্ধতি নির্ধারণ, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, মধ্যবর্তী নির্বাচন এসব বিষয়ে মতৈক্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। উপরিউক্ত নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ের বাইরেও আরও কিছু বিষয় নিয়ে সংলাপ হতে পারে। যেমন সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর একক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি এবং জবাবদিহির ব্যবস্থা রেখে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো ভবিষ্যতে যাতে সহিংস না হয় সে বিষয়ে মতৈক্যের ভিত্তিতে কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। নির্বাচনের পরে বিরোধী দল কর্তৃক সংসদ বর্জনের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সে বিষয়টিও মতৈক্যের ভিত্তিতে সুরাহা করা যেতে পারে। বর্ণিত বিষয় ছাড়াও সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার স্বার্থে আরও যদি কোনো বিষয় থাকে, সেগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে।
অতীত ঘটনাবলির বাস্তবতা অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে মতৈক্যের সম্ভাবনা খুব একটা আশা করা যায় না। অনেকে ঠাট্টা করে বলে থাকেন, রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে ‘সালিস মানি কিন্তু তালগাছ আমার’ নীতিতে বিশ্বাসী। সে কারণে, যদি কোনো বিষয়ে মতৈক্য না হয় তখন পৃথক মতগুলোর ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত করা যায়। এ ক্ষেত্রে জনগণ যে মত দেবেন তা সব পক্ষ মেনে নেবে, এ মতৈক্যটি শুধু প্রয়োজন হবে।
আমাদের এ দেশের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। এখানে জনগণ সব ক্ষমতার মালিক। ফলে জনগণের মতামতের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়াটাই দলমত-নির্বিশেষে সবার জন্য যুক্তিসংগত ও বাধ্যতামূলক। এ বিষয়ে দ্বিমত করার অবকাশ দেখি না।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের: সাবেক মন্ত্রী, প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় পার্টি।